২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

উত্তর আধুনিক সাহিত্য বৈঠক-২ অনুষ্ঠিত

উত্তর আধুনিক সাহিত্য বৈঠক-২ অনুষ্ঠিত - ছবি : সংগৃহীত

রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডস্থ 'কবিতা ক্যাফে'তে শুক্রবার বিকেল ৪টায় উত্তর আধুনিক সাহিত্য বৈঠক-২ অনুষ্ঠিত হয়েছে। 'শিকড়ায়ন বাংলাদেশ' -এর আয়োজনে, উত্তর আধুনিক সাহিত্য আন্দোলন, ঢাকা'র সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধান বক্তা ছিলেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক ড. মাহবুব হাসান।

তিনি কবি জসীম উদদীন স্মারক বক্তৃতা করেন। বক্তব্যের বিষয় ছিল- 'উত্তর আধুনিক কবিতায় লোকজ উপাদান'। সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব, কবি ও নাট্যকার ড. গোলাম শফিক।

পূর্বনির্ধারিত আলোচক হিসেবে আলোচনা করেন কবি শান্তা মারিয়া ও কবি মুহাম্মদ আব্দুল বাতেন। উত্তর আধুনিকতা বিষয়ক গবেষক, কবি আজিজ রাজ্জাকের সঞ্চালনায় বৈঠকে কবি জসীম উদদীন স্মরণে 'কবর' কবিতা আবৃত্তি করেন বাচিকশিল্পী ও অভিনেত্রী ফ্লোরা সরকার।

স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কবি শামীমা চৌধুরী, কবি লিলি হক, কবি কামরুজ্জামান, কবি ও সম্পাদক তাপস চক্রবর্তী, কবি ফাতিমা তামান্না, কথাশিল্পী মাহমুদা আক্তার, কবি জহির আহমেদ, কবি ও সম্পাদক আমিনুল ইসলাম সেলিম, কবি শাদমান শাহিদ, কবি শাহিদুল ইসলাম, কবি শাহীন ওমর, কবি ফরিদুজ্জামান, কবি নুরুন্নাহার ডলি প্রমুখ।

এছাড়া কবি বোরহান উদ্দীন ইউসুফ 'উত্তর আধুনিক সাহিত্য আন্দোলনের কথকতা' বিষয়ে আলোচনা রাখেন। বৈঠকে আমিনুল ইসলাম সেলিম সম্পাদিত 'নিজের নির্জনে আশুতোষ ভৌমিক' স্মারকগ্রন্থের পাঠ ও মোড়ক উন্মোচন করা হয়।

এছাড়া অন্যান্যদের মধ্যে কবি হাসনাইন সাজ্জাদী, কবি মুহাম্মদ জসীম উদ্দীন, কবি পলিয়ার ওয়াহিদ, কবি নুর মুহাম্মদ, কবি ও সম্পাদক কাদের বাবু, কবি শব্দনীল, কবি হেলাল উদ্দীন হৃদয়, মুশতাক আহমেদ, আসহাবে কাহাফ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

প্রধান বক্তা ড. মাহবুব হাসান তার আলোচনায় লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান-প্রকরণ, বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যে লোকজ উপাদানের সরব উপস্থিতি, উত্তর আধুনিক সাহিত্যে লোকজ উপাদানের প্রাসঙ্গিকতা ও সংশ্লেষণ নিয়ে আলোচনা করেন।

এ সময় তিনি নিজের লেখা (পিএইচডি অভিসন্দর্ভ) 'বাংলা একাডেমী' থেকে ২০০৫ সালে প্রকাশিত 'বাংলাদেশের কবিতায় লোকজ উপাদান' বই থেকে বিভিন্ন উদাহরণ ও রেফারেন্স তুলে ধরেন।

লোকজ সংস্কৃতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উত্তর আধুনিক কবিতার বীক্ষাকাশ যারা লক্ষ্য করেছেন তারা উপলব্ধি করতে পারবেন যে কবিরা হাজার বছরের যাপিত জীবনের সাথে আধুনিক চিহ্নিতকালের মধ্যে সংযোজন করতে চান। সৃষ্টি করতে চান নতুন প্রেক্ষণ, নতুন কবিতার দর্শন-নিদর্শন। উত্তর আধুনিকরা সেই প্রেক্ষণ অন্বেষী, যা বৃহত্তর মানবসত্তার সংস্কৃতিতে বহমান রয়েছে। সেখানে পাওয়া যায় সেই জীবনীসুধা- যা রিরংসাতাড়িত, বিবিক্তিশাসিত নগরজীবনের খর্বত্বকে বিশাল প্রাকৃত, লোকজীবনসাগরে নিয়ে যাবে। উত্তর আধুনিক চিন্তাবৃত্ত তাই লোকসংস্কৃতির নতুন ব্যবহার, নতুন বিন্যাস করতে চান কবিরা আধুনিক কৃৎকৌশলের মাধ্যমে। তবে সেখানে নগরভাষার আধিপত্যকে খর্ব করে লোকভাষার প্রাধান্য যেমন থাকবে তেমনি লোকজ্ঞানের লোকজ্ঞানের উপাদানসমূহের পুনর্বিন্যস্ত ব্যবহারও কবিতার আত্মায় দেবে শাশ্বত জীবন-প্রতিবেশ।

এছাড়া উত্তর আধুনিক কবিতায় ধর্মের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ধর্ম হচ্ছে মানবসংস্কৃতির সবচেয়ে বৃহৎ ও প্রাগ্রসর শাখা, যা চলমান বাস্তবতাকে তার ঈশ্বরসম চৈতন্য-অভিঘাতে আন্তর্বয়নের ভেতর দিয়ে বয়ে নিয়ে চলেছে। এই বহমানতা অন্তরজাত এবং লোকজ ফল্গু হিসেবেই যাকে চিহ্নিত-চিত্রিত করা যায়, করা উচিত।

তিনি জন লুইসকে উদ্ধৃত করে বলেন, নাস্তিক্যবাদ যদি মানুষের অনাবশ্যক সত্তার অস্বীকৃতি হয় তাহলে তার কোনো অর্থই থাকে না, কারণ নাস্তিক্যবাদ হচ্ছে ঈশ্বরকে অস্বীকার এবং ঈশ্বর মানুষের শুদ্ধসত্তার প্রতিনিধি- যে সত্তা থেকে পুঁজিবাদ তাকে বঞ্চিত রেখেছে। সম্ভবত এ কথা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। পক্ষান্তরে আমাদের তা বুঝতে হবে মানুষের বিচ্ছিন্নতাকে জয় করে, আর তারপর ঈশ্বরের কথা বলার কিংবা ঈশ্বরের স্বপ্ন দেখার কোনো সুযোগই হবে না। ততক্ষণ ধর্ম মানুষের আশা ও কল্পনার ছবি তুলে ধরবে যা তাকে চরম হতাশা মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করবে। এই পর্যায়ে ধর্ম অবশ্যম্ভাবী এবং অপরিহার্য...। তা নিপীড়িত মানুষের কাছে আশার প্রতীক, নিষ্করুণ বিশ্বে করুণা স্বরূপ, ক্ষয়িষ্ণু জীবনে উজ্জীবনের মন্ত্র।

কবি মুহাম্মদ আব্দুল বাতেন উত্তর আধুনিক কবিদের লোকজ উপাদানের পাশাপাশি লোকদর্শনের অন্তর্ভুক্তি ও আন্তর্বয়নের উপর গুরুত্বারোপ করেন।

কবি শান্তা মারিয়া তার আলোচনায় লোকজ উপাদানের গুরুত্ব তুলে ধরে পূর্বসূরি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, জসীম উদদীন ও আল মাহমুদের অনিবার্যতা ব্যক্ত করেন। তিনি অবক্ষয়ী আধুনিকতা ও ঔপনিবেশিকতার কারণে নষ্ট হয়ে যাওয়া লোকজ সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ ফেরত আনার ব্যাপারে উত্তর আধুনিক কবিদের প্রতি আলোকপাত করেন।

তিনি বলেন, ঔপনিবেশিক পূর্ব আমলে সুলতানি বাংলা, মুঘল আমলের সুবাহ বাংলা ভারতবর্ষে এমনকি পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল, আমাদের সেসব নিয়ে গর্ববোধ করতে হবে। তারও আগে গঙ্গা রিডস এর যে বীরত্বগাথা, যে কারণে বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডারকে এসে থেকে যেতে হয়েছিল এবং আর্যরাও এই ভূখণ্ডে পা দেয়ার সাহস করেনি, আমাদের সেই বাংলার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস স্মরণ করতে হবে।

উত্তর আধুনিকতা বিষয়ক গবেষক, কবি আজিজ রাজ্জাক বৈঠকের সঞ্চালনা সূত্রে অবক্ষয়ী আধুনিকতার সীমাবদ্ধতা, উত্তর আধুনিকতার কতিপয় লক্ষণ, লোকজ সংস্কৃতি সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন।

সভাপতির বক্তব্যে ড. গোলাম শফিক, বিভিন্ন আলোচকের আলোচনার সারাংশ ও প্রাসঙ্গিকতা উল্লেখের পাশাপাশি আধুনিকতা ও উত্তর আধুনিকতার কতিপয় পার্থক্য নির্দেশ করেন এবং উত্তর আধুনিক কবিতায় লোকজ সংস্কৃতির ব্যবহারের ধারণা সুসংহত করার পরামর্শ রাখেন উত্তর আধুনিক কবিদের প্রতি।
প্রেস বিজ্ঞপ্তি


আরো সংবাদ



premium cement