২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ভূমিকম্প দিয়ে গেল সতর্কবার্তা

ভূমিকম্প দিয়ে গেল সতর্কবার্তা
ভূমিকম্প দিয়ে গেল সতর্কবার্তা - ছবি : নয়া দিগন্ত

মিয়ানমারের হাখা শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ৫.৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে গতকাল শুক্রবার ভোর ৫টা বেজে ৪৫ মিনিটে। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে খুব কাছে ভূমিকম্পটি সংঘটিত হয়েছে বলে দেশের সর্বত্র বেশ ভালো ঝাঁকুনি অনুভূত হলেও বাংলাদেশের কোথাও কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। তবে মানুষের মধ্যে সামান্য সময়ের জন্য আতঙ্ক ছড়িয়েছে। ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার কিছু আগে ও পরে বাংলাদেশের অনেক মানুষ ফজরের নামাজে ছিলেন অথবা নামাজের প্রস্তুতিতে ছিলেন। বার্ষিক পরীক্ষা ও এইচএসসি পরীক্ষার এ সময়ে শিক্ষার্থীরা পড়ায় ব্যস্ত ছিল। সে কারণে ভূমিকম্প অনেক বেশি মানুষ অনুভব করতে পেরেছেন। বিভিন্ন স্থান থেকে সংবাদদাতাদের পাঠানো সংবাদ থেকে জানা যায়, ক্ষয়ক্ষতি না হলেও আতঙ্কে এবং এরপর আরো বড় ঝাঁকুনি আসতে পারে এই ভয়ে তড়িঘড়ি নিজ নিজ বাসস্থান বের হয়ে উন্মুক্ত স্থানে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। কেউ কেউ উঁচু ভবন থেকেও সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেছেন। নেমে গিয়ে দেখেন সব কিছু শান্ত, আর কোনো ঝাঁকুনি আসেনি। তবে হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে কেউ কেউ সামান্য আঘাত পেয়েছেন। মাত্রাগতভাবে এই ভূকম্পন ভয়াবহ না হলেও বিজ্ঞানীরা বলছেন, ক্রমান্বয়ে প্রবল হওয়া ভূকম্পন ভবিষ্যতে বড় বিপদের সতর্কবার্তা দিয়ে গেছে।

আমেরিকার ভূতাত্ত্বিক অধিদফতর ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) ভূমিকম্পটিকে ৬.২ মাত্রার বললেও বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদফতরের ভূমিকম্প বিভাগ ৫.৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে বলে বলেছে। ভূমিকম্পটি ঢাকার আগারগাঁওয়ের আবহাওয়া অফিস থেকে ৩৪৭ পূর্ব ও দক্ষিণপূর্বদিকে সংঘটিত হয়েছে। পরে ইউএসজিএস ভূমিকম্পটির মান ৬.১ থেকে বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ৬.২ মাত্রার করে সংশোধন করেছে।

ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৩২ কিলোমিটার গভীরে। গতকালকের ভূমিকম্পটি যে স্থানে সংঘটিত হয় সে স্থান থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ৫.৫ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছিল গত ৮ অক্টোবর। ভূমিকম্পটি ৮ অক্টোবরের ভূমিকম্পটি অপেক্ষা ০.৭ বেশি মাত্রার এবং বেশি শক্তিশালী হলেও অক্টোবর মাসের ভূমিকম্পটি অপেক্ষা অনেক বেশি কম্পন অনুভূত হয়। ইউএসজিএস বলছে, ভূমিকম্পটি মাত্র ০.৭ বেশি মাত্রার বেশি হলেও অক্টোবরের ভূমিকম্পটি ভূমিকম্পের স্কেল অনুসারে প্রায় ৫ গুণ বড় ছিল। কিন্তু গতকালের ভূমিকম্পটি থেকে অনেক বেশি শক্তি নির্গত হয়েছিল। ইউএসজিএস বলছে, ৮ অক্টোবরের ভূমিকম্পটি অপেক্ষা প্রায় ১১ গুণ বেশি শক্তি নির্গত করেছে।

কানাডার আবহাওয়া গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩২ কিলোমিটার গভীরে। পক্ষান্তরে ৮ অক্টোবরের ভূমিকম্পটি সংগটিত হয়েছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে ১১০ কিলোমিটার গভীরে। গতকালকের ৬.২ মাত্রার ভূমিকম্পটি ভূপৃষ্ঠ থেকে অল্প গভীরতায় সংঘটিত হয়েছে বলে এই ভূমিকম্প থেকে নির্গত শক্তি অনেক বেশি পরিমাণে ভূপৃষ্ঠে পৌঁছেছে। ফলে ভূপৃষ্ঠের তরঙ্গ বেশি সৃষ্টি হয়েছে বলে গতকালকের ভূমিকম্পটি আগেরটার চেয়ে বেশি পরিমাণ ঝাঁকুনি সৃষ্টি করেছে।

মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, ভূমিকম্পটি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে চট্টগ্রাম বিভাগের মানুষ ভূমিকম্পটি প্রায় সাড়ে ৫ মাত্রার ঝাঁকুনি অনুভব করেছে। আরো কাছে থাকলে আরো বেশি মাত্রার ঝাঁকুনি অনুভূত হতো। ভূমিকম্প বিজ্ঞান অনুসারে, আগামী কিছু দিনের মধ্যে একই স্থানে পাঁচ বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার আরেকটি আশঙ্কা রয়েছে। ভূমিকম্প বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, মিয়ানমার ও ভারতীয় সীমান্তের নিচ দিয়ে যে ফল্ট লাইন বা চ্যুতি রেখা রয়েছে এর যেকোনো স্থানে যেকোনো সময়ে ৮ মাত্রা অথবা এর চেয়ে কিছুটা কমবেশি মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। ভবিষ্যতে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প পাশের বঙ্গোপসাগরে সুনামির সৃষ্টি হতে পারে। অতীতে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে বঙ্গোপসাগরে সুনামির কিছু আলামত বিজ্ঞানীরা গবেষণায় প্রমাণ করেছেন।

একই ফল্ট লাইনের ওপরে চলতি বছরের ৯ জুলাই ৪.৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছিল সিলেট জেলা থেকে পূর্ব দিকে ভারতের মনিপুর রাজ্য ও মিয়ানমারের সীমান্তসংলগ্ন স্থানে। ওই ভূমিকম্পটির উৎপত্তি স্থল ছিলও ভূপৃষ্ঠ থেকে ৯৬ কিলোমিটার গভীরে।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভয়ের কথা এই যে জুলাই মাসের ভূমিকম্পটি অপেক্ষা অক্টোবর মাসের ভূমিকম্পটি শক্তিশালী ছিল। একইভাবে অক্টোবর মাসের ভূমিকম্পটি অপেক্ষা গতকালের ভূমিকম্পটি আরো বেশি শক্তিশালী ছিল।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, নিকট অতীতের সবচেয়ে তীব্র ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিতে কেঁপেছে পুরো বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও আশপাশের জেলাগুলো। আবহাওয়া অফিসের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী গতকাল শুক্রবার ভোর ৫টা ৪৫ মিনিট ৪১ সেকেন্ডে সংঘটিত ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ২।

আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে- ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের মিজোরাম সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের ফালাম জেলা শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে চীন প্রদেশের রাজধানী হাখা শহরের কাছে। ঢাকা থেকে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব ৩৩৯ কিলোমিটার বলেও এতে উল্লেখ করা হয়েছে।

গতকাল ভোরে বেশির ভাগ মসজিদেই ফজরের নামাজের জামাত চলছিল। সে সময়ই তীব্র ঝাঁকুনিতে কেঁপে ওঠে পুরো বন্দরনগরী। এ সময় ভবনগুলো দুলতে থাকে। বাসাবাড়ির জিনপত্রগুলোও দুলতে থাকে।

ভূমিকম্পে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির খবর না মিললেও কয়েকটি স্থানে ভবন হেলে যাওয়ার অসমর্থিত তথ্য পাওয়া গেছে।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) আর্থকোয়েক ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ সেন্টার ইতঃপূর্বে তাদের গবেষণায় চট্টগ্রাম শহরের ৭৮ শতাংশ ভবনই ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে মর্মে ইতঃপূর্বে গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।

সিলেট ব্যুরো জানায়, ভোর রাতে মানুষ যখন গভীর ঘুমে মগ্ন, ঠিক তখনই ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল সিলেট। শুক্রবার ভোর ৫টা ৪৫ মিনিট ৪১ সেকেন্ডে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। তবে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

সিলেট আবহাওয়া অফিস জানায়, রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎপত্তি মিয়ানমার-ভারত সীমান্তে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬০ কিলোমিটার গভীরে ছিল এর অবস্থান। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থাও (ইউএসজিএস) রিখটার স্কেলে ভূকম্পনের মাত্রা ৫ দশমিক ৮ ছিল বলে জানিয়েছে।

সংস্থাটির মতে, ভূমিকম্পের গভীরতা ছিল ৪২.১ কিলোমিটার গভীরে। এই ভূমিকম্প সিলেট, ঢাকা, চট্টগ্রাম এলাকায় অনুভূত হয়েছে।

গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) সংবাদদাতা জানান, গতকাল ভোর রাতে ভূমিকম্পনের প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ ও পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ চমকে ওঠে। এ সময় ঝাঁকুনির শব্দে প্রায় প্রত্যেক বাড়ির লোকজনের ঘুম ভেঙে যায়। এতে তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। গোয়ালন্দ ১নং পৌরসভার অলিমদ্দিন পাড়ার বাসিন্দা শামসুল হক বলেন, হঠাৎ আমার বসতঘরের আসবাবপত্রসহ পুরোঘর কাঁপতে থাকলে চমকে যাই। পরিবারের অন্যান্য লোকজনসহ ঘরের বাইরে এসে বড় বড় গাছপালা দোল খেতে দেখে বুঝতে পাড়ি ভূমিকম্পন হচ্ছে। তবে ভূমিকম্পে কোথাও কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।


আরো সংবাদ



premium cement