১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০১ মাঘ ১৪৩১, ১৪ রজব ১৪৪৬
`

এক শুক্রবারের ভয়ঙ্কর রাত

-

এ কথা আগে থেকেই জানি কবি মানে হলো পাগল। আমি পাগলের সংসার করছি কয়েক বছর হলো। মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হয় পাগল রেখে চলে যাই অন্য কোথাও কিন্তু দুটো সন্তান রেখে কীভাবে যাব? তাই জীবনের মায়া ছেড়ে পড়ে আছি এই পাগলের সংসারে। আপনাদের বলে রাখতে পারি, আমি কার ঘর করে দিন দিন মরে যাচ্ছি বেদনায় হতাশায়। না থাক নাম গোপনই রাখি।
তাকে আমিও পাগল মনে করি, কারণ তার কোনো কমনসেন্স নেই। এই যে দেশের এই মর্মান্তিক ভয়াবহ সময় অতিক্রম করছে তাতেও তার কোনো বোধ হলো না। সে এমন সব কবিতা গল্প লিখে রাখে যা প্রায়ই সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়। আমি তাকে বলি- কেন ওসব ছাইপাশ লিখছ? তোমার লেখা কী কেউ পড়ে নাকি ওটা দিয়ে তুমি আমাকে কিছু উপকার করতে পারো। সংসারে কি দিয়েছো চারটাকা আজ পর্যন্ত?
সে বিকেলের চায়ের সাথে মুড়ি চিবুতে চিবুতে বলবে- আরে বাবা, দিব দিব, এক সময় দেখবে আমি বিখ্যাত রাইটার হয়ে যাব। সরকার চিরদিন থাকে না। পটপরিবর্তন হলেই আমার কদর বেড়ে যাবে।
তার এসব বোধহীন কথায় আমার রাগ আরো বেড়ে যায়। আমি পুরোনো জামার উড়না কেটে কেটে মেয়ের জন্য ঘরে পড়ার জামা তৈরি করতে থাকি। কিন্তু আমি ব্যস্ত হলেই কী হবে পাগল তো বিরতি দেয় না। সে লিখতে থাকে গেলো কদিন আগে যে আবু সাঈদ নামের যুবকটিকে পাখির মতো গুলি করে মারল সেই হৃদয়বিদারক প্রেক্ষাপটের কবিতা। আমি তাকে বলি- কেন লিখছ এসব কবিতা? তোমাকে মার্কিং করে রাখবে সরকার।
তার দৃঢ় জবাব। সে বলে- শোনো, কবি সবসময় সত্যবাদী হয়। কবিরা সত্যবাদী না হলে রাজ্য ঠিক থাকে না। কবির কলমেই ভালো কথা ওঠে আসে। তারা যুগে যুগে ক্ষুরধার কথাকে বাণীর মতো করে উল্লেখ করে যায়। দেখো না নজরুল রবীন্দ্রনাথ সুকান্ত কতটা তেজস্বী কবিতা দিয়ে মানুষকে, রাষ্ট্রকে জাগিয়ে দিয়েছেন। তাদের কবিতার বাণী যেকোনো সরকারের পথ চলার পাথেয় হয় একসময়।
আমি আর পারি না। এখন অনেক রাত হয়েছে। স্বামীকে থামাতে পারি না। সে প্রতিদিন দেশের এই অবস্থা নিয়ে লিখছে। সে লিখছে চট্টগ্রামের কথা কুমিল্লার কথা টাঙ্গাইলের কথা। তার কবিতায় ওঠে আসছে বৈষম্যবিরোধী ছেলেদের আন্দোলনের কথা। কোটা সংস্কার আন্দোলনের জন্যে তার ভেতরের পরাণ পাখিটা যেন আহত হয়ে আছে। তাই ফেসবুকে লিখে রাখে এমন সব কথা যাতে ছেলেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সততার সাথে সামনে এগোতে পারে।

কিন্তু আর কত? এর মধ্যেই কতগুলো ছেলের জীবন চলে গেল। কত মায়ের চোখের জল শুকিয়ে গেল। আর ছেলেদের এই আন্দোলনের সুযোগে অন্যসব দুর্বৃত্তরা রাষ্ট্রের অনেক ক্ষতি করে বসল। তারা রাজপথে গাড়ি ধ্বংস করল, রেলপথ ও সরকারি অনেক অফিস আদালত পুড়িয়ে শেষ করল। কোটি কোটি টাকার সম্পদ শেষ করল।
অবশ্য আমার এই পাগলের একটি বিষয় আমার ভালো লাগে- সে কখনো কোনো রাজনৈতিক দলকে সাপোর্ট করে না। স্পষ্ট করে আমার সাথে তর্ক জুড়িয়ে দেয়- আমি কেন আমার কোনো সন্তান যেন কখনো বাংলাদেশে রাজনীতি না করে তুমি খেয়াল রেখো। একটি গরিব দেশের রাজনীতিবিদরা চুরি করে টাকা পাচার করে। এই দেশের সচিব মন্ত্রী টাকা পাচার করে, এই দেশের ব্যবসায়ীরা ভেজাল করে গাড়ি বাড়ি তৈরি করে, সম্পদের পাহাড় গড়ে, সেই দেশে রাজনীতি মানায় না আমার।
আমি পাগল কবির এই বিষয়টি নিজেও সম্মান করি। আসলেই এই দেশের মানুষের বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের কারো যেন দেশের প্রতি কোনো দায়িত্ব নেই। নেই কোনো প্রকৃত দেশপ্রেম। না হলে কী করে তারা সামান্য ক্ষমতার জন্যে দেশের সম্পদ নষ্ট করে? কিন্তু আমার ভেতর ভয় লেগে থাকে আমার স্বামীকে না জানি এসব সত্য কথার জন্য উল্টো ফাঁসিয়ে দেয় কেউ। তাই আমি বারবার তাকে বারণ করি- লেখা বাদ দাও। তুমি ছাড়াও অনেক আছে যারা লিখবে। তোমার কিছু হলে আমরা পথে বসব।
না সে আমার কথা শুনবে না। সে বলে রাখে- জীবনের ঝুঁকি নিতে না পারলে অনেক সময় সত্য প্রতিষ্ঠা করা যায় না। আমি না লিখলে বা অনেকেই না লিখলে দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র কীভাবে টিকবে বলো?
পারি না। পারি না তার সাথে, যুক্তি দিয়ে পারি না। সে লিখতে থাকে রাজপথের কথা। লিখতে থাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তার কলম অব্যাহত থাকে প্রতিরোধে প্রতিবাদে। তার মন-মগজ যেন সবসময় প্রস্তুত অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলতে। ক’দিন যাবত কত ভয়ানক ঘটনা ঘটছে দেশের সবখানে। এটিএম বুথে আগুন, বিটিভি ভবনে আগুন, ইন্টারনেট অফিসের ক্যাবলে আগুনের শর্টসার্কিট, গাড়ি পুড়ে ছাই। মানুষ হত্যায় চলছে প্রতিযোগিতা। আমার পাগল স্বামী, সংসার আর জীবনের প্রতি যে উদাসীন বছরের পর বছর- সে এসব নিয়ে লেখায় ব্যস্ত। আমি নিষেধ করি, ঝগড়া বাধাই ক্ষণে ক্ষণে তার সাথে। তাকে বলি- সংসারে মন দাও। নিজের সন্তানের দিকে স্থির হও। অথর্ব পাগল কবি কিছুই কেয়ার করে না...
আজ শুক্রবার। চারদিকে মিছিল আগুন আগুন প্রতিরোধ প্রতিবাদ। পুলিশ র‌্যাব বিজিবি আনসার বসিয়েও লাভ হচ্ছে না। এরই মধ্যে আন্দোলন আরো শাখা ছড়িয়েছে দেশের সবখানে। বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে মিছিলের প্রকট ধ্বনীতে আকাশের মেঘের গতি সরে যাচ্ছে। উৎকণ্ঠিত মানুষ গুটিয়ে যাচ্ছে অফিস আদালতে। কোথাও কোথাও আবারো শকুনের উৎপাত শেয়ালের আনাগোনা।

আমাদের ঘরের পাশেই শহরের প্রধান সড়ক। প্রতিদিন মিছিল মিটিং আগুন টিয়ারশেল বোমার ভয়। এই নিয়েই ভয়ে থাকি দুটো সন্তানকে আঁকড়ে ধরে। কিন্তু আমার পাগল স্বামী আছে তার কবিতা গল্প নিয়ে। হঠাৎ রাত ১০টার দিকে বাসার গেটে জোরে জোরে আঘাতের শব্দ। কলিংবেল টেপার শব্দ। সবাই ভয়ে আঁৎকে ওঠি। কি করব বুঝতে পারছি না। ঘরের লাইট বন্ধ করে রাখি। ছেলেমেয়েরা কখনো যুদ্ধ দেখেনি। তারা হয়তো যুদ্ধের ছবি বা গল্পগ্রন্থে পাঠ করেছে। তারাও ভয়ে গুটিশুটি মেরে রইল এক রুমে। আমার স্বামীও আজ ভয়ার্ত স্বরে ফিসফিস করতে লাগল- না কোনোভাবেই দরোজা খোলা যাবে না।
বাইরে বোমার শব্দ, আকাশ ভেঙে পড়ার শব্দ, শহর কাঁপানো শব্দ। আমরা গুটিয়ে যাচ্ছি। দোয়া দরুদ পড়ছি। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি মরে গেলেও আর পথের পাশে বসবাস করব না। আর নয় শহরের কেন্দ্রে বসবাস। এবার বাঁচাও আল্লøাহ আমার সন্তানদের রক্ষা করো।
অনেকক্ষণ পর শব্দ কমলেও কান পেতে রাখি ওরা উপরে যাচ্ছে। সিঁড়ি ভাঙছে আর সিড়ির জানালার কাচগুলো ভেঙে পড়ছে। ওরা উপরে উঠছে আর প্রতিটি দরোজায় আঘাতে আঘাতে এলাকাতে ত্রাস তৈরি করে দিচ্ছে। ওরা কারা কোন দলের জানি না। ওদের প্রকৃত দল নেই। কারা এই হায়েনা চিনি না। শুধু এই ভয়ানক রাত পার করার প্রার্থনায় আছি।
অনেকক্ষণ। অনেকক্ষণ আমরা মৃত ছিলাম। আমরা এই শহরে ছিলাম না। আমরা কবরের নীরবতায় কবরে শুয়েছিলাম। মৃত্যুদূত এসে আমাদের জান কবজ করে গেছে, হয়তো আগামীকাল দৈনিক কাগজগুলোতে ছাপানো হবে আমাদের লাশের গল্প।
উৎকণ্ঠায় ভোর হলে শান্ত দেখি চারপাশ। পরে জানতে পারি শেষ পর্যন্ত ওরা সাত তলায় একটি ফ্লোরে গিয়ে সব তছনছ করে গেছে। লুটপাট করে এলাকা স্বাধীন করে বাংলাদেশকে আরেকবার শত্রুমুক্ত করে গেছে।
আমি আর আমার পাগল স্বামীকে নিয়ে পারছি না আগেই বলেছি। জানি না সে আর কতকাল অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরবে। জানি না আর কতকাল তার বোধজ্ঞানহীন জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকব আমি আর আমাদের সন্তানের জীবন। তবে আজ মনে হলো এই ভয়ঙ্কর রাতের কথা আমিও লিখে রাখি। স্বামীর মতো আমিও পাগল হই, কবি হই। আর রাষ্ট্রকে বলি- আর কত রক্ত ঝরলে তোমাদের বোধ হবে কবির মতো?


আরো সংবাদ



premium cement