গবেষণা সাহিত্য ও প্রবন্ধ সাহিত্য
- গাজী গিয়াস উদ্দিন
- ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০৫
কল্পনা শক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিকে কাজে লাগিয়ে লেখক যে নাতিদীর্ঘ সাহিত্যরূপ সৃষ্টি করেন, তাই প্রবন্ধ। বিষয়বস্তুর প্রদান্য থাকলে তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ বলে। এর প্রকারভেদ : বিবৃতিমূলক প্রবন্ধ, ব্যাখ্যামূলক, বিতর্কমূলক, চিন্তামূলক ইত্যাদি। বস্তুনিষ্ঠ বা মন্ময় প্রবন্ধে লেখকের পাণ্ডিত্য, জ্ঞানের গভীরতা সফলভাবে প্রকাশ পায়। তন্ময় তত্ত্বমূলক ও মন্ময় আবেগমূলক। প্রবন্ধকার সমাজের সমস্য তুলে ধরেন এবং সমস্যা থেকে উত্তরণের পথও নির্দেশ করেন। পাঠকের জ্ঞানতৃষ্ণা পরিতৃপ্ত করতে, গদ্যভাষায় পাঠককে অজানা বিষয় জানানো প্রবন্ধের লক্ষ্য।
কয়েকটি প্রবন্ধের উদাহরণ : রবীন্দ্রনাথের ‘আত্মপরিচয়’, সত্যজিৎ রায়ের ‘জীবনস্মৃতি’, নীহার রঞ্জন রায়ের ‘বাংলার ইতিহাস’, আশা পূর্ণা দেবীর ‘গোপন কথা’, মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ‘মানব সমাজ চাইতে বিজ্ঞান’। বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধ গ্রন্থের সংখ্যা ১৩টি। তন্মেধ্যে ১। হঠাৎ আলোর ঝলকানি (১৯৩৫), ২। উত্তর তিরিশ (১৯৪৫), ৩। কালের পুতুল (১৯৪৬), ৪। স্বদেশ ও সংস্কৃতি (১৯৫৭), ৫। মহাভারতের কথা (১৯৭৪), ৬। কবিতার শত্রু ও মিত্র (১৯৭৪)।
ড. আহমদ শরীফ বলেন, সাহিত্য ও শিল্প কিংবা ইতিহাস ও দর্শন সম্পর্ক এ-যুগে বিদ্বানদের ধারণা বদলে গেছে। যেহেতু মানুষ তার সমকালীন স্বদেশে আনন্দ ও যন্ত্রণা এবং সম্পদ ও সমস্যা নিয়েই বাঁচে, সেজন্যে তার সাহিত্যে ও শিল্পে কিংবা ইতিহাসে ও দর্শনে দেশ-কাল-সমাজ-প্রতিবেশপ্রসূত চেতনার স্বরূপ বিধৃত হবে। পাঠক-দর্শক এই প্রত্যাশাই রাখে। কেননা উপযোগই সব সাধনার ও গুরুত্ব নিরূপণের মাপকাঠি। উল্লেখ্য, প্রতিবেশ বলতে বোঝায়-পরিবেশের সাথে প্রাণিজগতের যে আন্তঃসম্পর্ক। দেশগত কালিক জীবন প্রতিবেশের উন্মোচন ও বিশ্লেষণই গবেষকের লক্ষ্য। স্থানিক ও কালিক পরিবেশ, নৈতিক চেতনা, আর্থিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক মান, ধার্মিক প্রত্যয় ও সামাজিক ব্যবস্থা প্রভৃতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সামষ্টিক প্রভাব জন-চৈতন্যে কিভাবে প্রতিফলিত এবং ভাবচিন্তা-কর্মে কিরূপে অভিব্যক্ত তা দেখা-জানা-বোঝা প্রাবন্ধিকের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ।
ড. আহমদ শরীফ মনে করেন, গবেষণা আমাদের দেশে আজো বিশ^বিদ্যালয়-উচ্চতম উপাধি পরীক্ষার স্তর অতিক্রম করেনি। পেশাগত প্রয়াস নেশাগত না হলে আমাদের গবেষণার ক্ষেত্র অভীষ্ঠ ফসল প্রসূ হবে না। পত্রপত্রিকার প্রয়োজনে প্রবন্ধও প্রায় গল্প-কবিতার মতোই অজস্র লিখিত হয়। কিন্তু এদের প্রবন্ধ কচিৎ রচনার স্তর অতিক্রম করে। তার কারণ প্রবন্ধ যে প্রতিবেশ সচেতন লেখকের জ্ঞান, মন, প্রজ্ঞা ও ব্যক্তিত্বের সমন্বিত অভিব্যক্তির ধারক তা তারা বোঝেন না। যে প্রবন্ধ পাঠক চেতনায় নতুন দৃষ্টি দান করে এবং বলবার মতো বক্তব্য প্রকাশে আবেগ সৃষ্টি করে, সে প্রবন্ধই পাঠকের প্রত্যাশা পূরণ করে। প্রবন্ধ সুচিন্তিত, সুযৌক্তিক ও সুলিখিত হবে। সমকালীন সমাজজীবনের ও জীবিকার যেকোনো বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ রচিত হতে পারে। জ্ঞানগর্ভ ও নৈতিক-তাত্ত্বিক প্রবন্ধই কেবল দীর্ঘায়ুর দাবিদার।
প্রমথ চৌধুরীকে বাংলা সাহিত্যে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও সাহত্য সমালোচক হিসেবে অভিহিত করা হয়। তিনি মূলত সাধারণ পাঠকদের কথা মাথায় রেখে সাহিত্য রচনা করতেন। পাঠকের মনোভাব উপলব্ধি করে তাদের অব্যক্ত কথাগুলো তিনি তার ছোট গল্প ও প্রবন্ধে লিখেছেন। ব্যক্তি আক্রোশ তার সমালোচনায় ছিল না বললেই চলে। তিনি সাহিত্যের গঠনমূলক সমালোচনা করতেন। যা এখনো তাকে প্রথম শ্রেণীর সমালোচকের আসনেই অপরিবর্তিত রেখেছে। তিনি ছিলেন মননশীল ও প্রচ- যুক্তিবাদী। তিনি বলেছেন, মনোজগতে বাতি জ্বালানোর জন্যে সাহিত্যচর্চার বিশেষ প্রয়োজন। তিনি মানসিক যৌবনকেই সমাজে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেয়েছেন। লেখকের ‘যৌবনে দাও রাজমুকুট’ প্রবন্ধের জ্বলন্ত সাক্ষী। সবুজপত্র পত্রিকার মাধ্যমে প্রমথ চৌধুরী বাংলা গদ্যে নবরীতি অর্থাৎ চলিত বাংলা রীতি প্রবর্তন করেন। তিনি রবীন্দ্র যুগে নিজেকে অত্যন্ত সফলতার সাথে স্বতন্ত্র ভাবে উপস্থাপন করেছেন এবং প্রশংসিত হয়েছেন। পরবর্তী যুগে সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আহমদ ছফা প্রমুখ গবেষণা ও প্রবন্ধে সমুজ্জ্বল অবদান রাখেন। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে ব্যতিক্রম আরো নৈতিক প্রগতিশীল প্রাবন্ধিক-গবেষক জাতি প্রত্যাশা করে।
রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও কাব্যিক। ভারতের ধ্রুপদি ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তার রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনিসমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের (১৮৬১-১৯৪১) প্রবন্ধগ্রন্থ ‘কালান্তর’-এর ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধ তিনি তার ৮০তম জন্ম বার্ষিকীতে পাঠ করেন। মানবমৈত্রী ভিত্তিক ইংরেজ সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ছিল রবীন্দ্রনাথের আজীবনের অভিজ্ঞতা। কিন্তু ইংরেজ রাজশক্তি আমাদের এ দেশে ‘শক্তিরূপ দেখালোও মুক্তিরূপ দেখাতে পারেনি’। তাদের আগ্রাসীরূপ রবীন্দ্রনাথের মর্মমূলে যে বেদনা সৃষ্টি করেছে, তাতে তিনি ইংরেজ সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ঘৃনাবোধে আক্রান্ত হন। ইংরেজদের শাসন শোষণের যাঁতাকল, ভারতীয় জাতিসত্তাকে দ্বিধাবিভক্ত করা এবং হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ দেয়াল সৃষ্টি তিনি গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন।
গবেষণা বা জবংবধৎপয কী? জ্ঞান সন্ধানের মানসম্মত পদ্ধতি। জ্ঞানের যেকোনো শাখায় নতুন তথ্য খুঁজে পাওয়ার সযতœ অনুসন্ধান।
গবেষণার বৈশিষ্ট : সমস্যা চিহ্নিতকরণ, বস্তুনিষ্ঠতা (ব্যক্তিগত চিন্তার ঊর্ধ্বে কাজ করা) সৃশৃঙ্খল, তত্ত্বসৃষ্টি ও মানব কল্যাণ। গবেষণায় ঐুঢ়ড়ঃযবংরং (প্রকল্প) মানে পূর্ব জ্ঞানের সাময়িক সিদ্ধান্ত (প্রচ্ছন্ন প্রমাণ বা অনুমান) যা সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখে। গবেষকের অনুসন্ধানমূলক কাজের ভিত্তি হচ্ছে প্রকল্প।
আলবার্ট আইনস্টাইনের ভাষ্য : সব গবেষণাই হলো মানুষের ধারণা (ওফবধ) এবং জগৎ ও প্রতিভাসের (চযবহড়সবহধ) জগতের মধ্যকার পার্থক্য (এধঢ়) কমিয়ে আনা। গবেষণাপদ্ধতি শাস্ত্রের পূর্বশর্ত : দর্শন, গণিত, পরিসংখ্যান, বিজ্ঞান ও ভাষাজ্ঞানের দখল থাকা।
ভালো ঈড়হঃবহঃ লেখার জন্য ভালো পাঠক হতে হবে। জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করা। সঙ্কীর্ণতা পরিহার করা। কালোত্তীর্ণ চরিত্র বা কাহিনী আবিষ্কার করার ক্ষমতা। আন্তর্জাতিক জার্নাল থেকে ভালো কন্টেন্ট বাছাই করা।
মনে রাখতে হবে- একজন প্রাবন্ধিক মানেই গবেষক। গবেষণাশাস্ত্রের জ্ঞান লাভ করেই এবং গবেষণার সূত্র মেনেই প্রবন্ধ রচনা আধুনিক সচেতনতার দাবি। প্রবন্ধ সাহিত্য ও গবেষণা সাহিত্য সম্পর্কে জানার জন্য সহায়ক গ্রš ’: ১। বাংলা প্রবন্ধ ও সমালোচনা-বিদিশা সিনহা (রকমারী), ২। নির্বাচিত প্রবন্ধ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ৩। গবেষণা পদ্ধতি ও প্রয়োগ-ড. মুহাম্মদ আকরাম উজ্জামান।
বুদ্ধিমান ব্যক্তি নিজের খরসরঃধঃরড়হ বোঝেন। বুদ্ধিমান দেশ বোঝে গবেষণার গুরুত্ব। গবেষণায় বিপুল অর্থব্যয় করে সেরা দশটি দেশের মধ্যে পরিসংখ্যান ২০১১ অনুযায়ী প্রথম যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় বাজেটের ২.৭ শতাংশ এবং দশম রাশিয়া ১.০ শতাংশ ব্যয় করে। ৭২টি দেশের মধ্যে ভারত, পাকিস্তানের নাম থাকলেও বাংলাদেশের নাম ছিল না। সাহিত্য গবেষণায় রাষ্ট্রকে মনোযোগী হবার পাশাপাশি লেখক সাহিত্যিকদের ও অধিকতর মনোযোগী হওয়া আবশ্যক।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা