১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

জোছনা মহল

-

বদরুলের দাদা নামীদামি মানুষ। সুপুরুষ। লোকমুখে শোনা যায়, তার পূর্বপুরুষ জমিদার ছিলেন। এখন জমিদারি না থাকলেও জমিদারি ভাব আছে। চলনে-বলনে খানদানিত্বের ছাপ। খুব শৌখিন। বেশ পুরাতন আলিশান বাড়ি ওনার। গাছপালায় সুশোভিত। বাড়ির অলি-গলিতে আভিজাত্য ফুটে আছে। সব কিছুই মুগ্ধ হওয়ার মতো। জোছনা আর কুয়াশা তার খুব পছন্দ। জোছনা আর কুয়াশা দেখার জন্য তেপান্তরে আলাদা একটি বাড়ি বানিয়েছেন। বাড়ির চারপাশে সুনসান নীরবতা। দক্ষিণ দিকে শানবাঁধানো পুকুর। পশ্চিমে বাঁশবাগান। উত্তরে শিমুল বাগান। প্রতি মাসে জোছনার শুরুতে বদরুলের দাদা মানে সদরুল আমিন সাহেব ওই বাড়িতে অবস্থান করেন। ওই বাড়িটি তিনি বানিয়েছিলেন বিয়ের পরপরই। এ বাড়ি তৈরির পর বলেছিলেন, ‘এটা আমাদের নিধুবন।’ নতুন বউ বাড়ি দেখে মুগ্ধ হয়ে নাম দিলেন ‘জোছনা মহল’। তবে অধিকাংশ সময় তিনি একাই এ বাড়িতে থাকেন। যখনই এ বাড়িতে আসেন দুনলা বন্দুক সাথে নিয়ে আসেন। এসব বদরুল ছোটকাল থেকে দেখে আসছে। এখন সে অনেক বড় হয়েছে। নাকের নিচে পাতলা গোঁফ। তার শরীরের গড়ন তার দাদার মতো সুঠাম। তার দাদাকে বললেন, ‘এবার জোছনায় আমি জোছনা মহলে একা থাকব। তোমার বন্দুকটা আমাকে দিও।’ সদরুল আমিন সাহেব চোখ তুলে তাকালেন বদরুলের দিকে। নাতি বেশ বাহাদুর হয়েছে। মৃদু হেসে বললেন, ‘পারবি না, ভয় পাবি। বিয়ের পর বউ নিয়ে যাস।’ বদরুল গোঁ ধরল যাবেই। হাতের পেশি ফুলিয়ে দাদাকে দেখিয়ে বলল, ‘আমি কোনো কিছুকেই ভয় পাই না। আমার সামনে কিছু এলে তাকে ভর্তা বানিয়ে ছাড়ব।’ অবশেষে সদরুল সাহেব কিছু পরামর্শ দিলেন নাতিকে। কিছুতেই দক্ষিণ দিকে পুকুরপাড়ে যাবি না। গভীর রাতে ঘরের বাইরে বেরোবি না। পিঠে চাপড় দিয়ে দুনলা বন্দুক হাতে ধরিয়ে দিলেন। দাদার সামনে যত সাহস দেখিয়েছে, তাতে ভাঙন ধরতে লাগল। মনে নানা ভয় দানা বাঁধতে লাগল। কোনো ভয়কে পাত্তা না দিয়ে বদরুল চলে গেল জোছনা মহলে।

খুব সাজানো গোছানো ঘর। বেড রুমটা ঝকঝকে। বিছানার চাদরটা ধবধবে সাদা। দাদা বলেন, ‘জোছনায় সাদা চাদর একটি আবেশ তৈরি করে।’ সত্যিই তাই। পুবের জানালা খুলতেই ঘরটা জোছনায় ভেসে গেল। এই ঢেউ বদরুলের মনেও লাগল। দাদার কলের গান ছাড়লেন। এই কলের গানটা দাদা পেয়েছেন বংশপরম্পরায়। এটি দাদার খুব শখের জিনিস। এতে তার পূর্বপুরুষদের ছোঁয়া আছে। সেই কলের গানে বেহালায় রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে। অপার্থিব এক সুরমূর্ছনা তৈরি হয়েছে। চারপাশটাও অপার্থিব লাগছে। জীবনটাকে অনেক সুন্দর মনে হচ্ছে। অনেক দিন বাঁচতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ ‘পানি পানি’ বলে চিৎকার শোনা যাচ্ছে। চিৎকারটা আস্তে আস্তে স্পষ্ট হচ্ছে। পরে একসময় গোঙানির মতো শোনা যাচ্ছে। দাদা বলেছিলেন পুকুরপাড়ে না যেতে। গোঙানির শব্দটা সেখান থেকেই আসছে। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। এত রাতে এখানে কারো আসার কথা নয়! কিন্তু ভয় পেলে চলবে না। ঘরে বসে থাকলে ভয় তাকে পেয়ে বসবে। ভয়কে জয় করতে হবে। দুনলা বন্দুকটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। চারদিকে ঢলনামা জোছনা। পুকুরের নিস্তরঙ্গ পানিতে জোছনার প্লাবন। কোথাও কেউ নেই। গোঙানির শব্দটা আসছে কোত্থেকে! পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় এক চিলতে হোগলার বন। সেখান থেকেই গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে। বদরুল বন্দুক তাক করে আস্তে আস্তে কাছে গেল। কোনো শব্দ নেই। চলে আসার পর গোঙানির শব্দটা আবার বেড়ে গেল। ভয়টা মনে জেঁকে বসল। আর বাইরে বেরোবার সাহস পেলো না। ইচ্ছে হচ্ছে জানালাটাও বন্ধ করে দিতে। আড় চোখে জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধু শব্দটাই শোনা যাচ্ছে। বদরুল মনকে শক্ত করার চেষ্টা করল। আবার বেহালায় মন দেয়ার চেষ্টা করল। আচমকা হাসির শব্দ শুনতে পেলো। মনে হলো জানালার পাশেই কে যেন হাসল। বদরুল চমকে উঠল। ভয়ে কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা। ইচ্ছে হচ্ছে আকাশ বিদীর্ণ করে চিৎকার দিতে। বন্দুকটা হাতে নিলো। তখন মনে হচ্ছে পুকুরপাড় থেকেই হাসির শব্দটা আসছে। গল্পের রাজকন্যা যেন তার সখিদের নিয়ে জলকেলি খেলছে আর হাসিতে চারদিক মুখরিত করছে। ভাবল, পুকুর বরাবর গুলি করে দেবে। আবার গুলি করতেও ইচ্ছা করল না। হঠাৎ হাসির শব্দ থেমে গেল। চারদিকে সুনসান নীরবতা। কার্তিকের জোছনা। শীত মোটামুটি টের পাওয়া যাচ্ছে। কুয়াশা পড়ছে। চারদিকে কাফন রঙের কুয়াশা। জোছনাকে আস্তে আস্তে ঢেকে দিচ্ছে। এর মধ্যেও বদরুলের গা ঘামছে। বুক ঢিপঢিপ করছে। ভয়ে ভয়ে পুকুরের দিকে তাকাল। দেখল একটি কালো ছায়া। পুকুরের পানিতে পড়ে আছে। পুকুরপাড়ে কোনো গাছ নেই। ছায়া কোত্থেকে এলো! আস্তে আস্তে ছায়াটা তার ঘরের দিকে আসছে। বদরুল দরজা-জানালা শক্ত করে লাগিয়ে দিলো। ভাবল, চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়বে। বাইরের কোনো কিছু আর দেখবে না।

চাদর মুড়ে শুয়ে আছে বদরুল। তার ঘুম আসছে না। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় কে যেন তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে, কোনো রকমে রাতটা পার করতে পারলে আর জিন্দেগিতে এখানে আসবে না। এমন সময় শুনতে পেলো জানালার পাশে ছাতিম গাছের ডালে বাতাসের হুড়োহুড়ির শব্দ। অন্য কোথাও ঝড় নেই। শুধু ছাতিম গাছের ডালে ঝড়। ঝড়ে ডাল ভেঙে ফেলছে। মনে হচ্ছে গাছসহ উপড়ে ফেলবে। তার সাহস এখন শূন্যের কোঠায়। আস্তে আস্তে ঝড় থেমে গেল। জোছনা আস্তে আস্তে ঘোলা হয়ে আসছে। রাত আর বেশি নেই। বদরুলের চোখের পাতায় ঘুমের আনাগোনা। শরীরে ক্লান্তি এসে ভর করছে। তন্দ্রার মতো এসেছে। এমন সময় সে টের পেলো তার খাটে কে যেন বসল। কট করে শব্দ হলো। বদরুল চোখ খোলার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। একটি হাত তার চাদর ধরে টান দিচ্ছে। চাদর বুক পর্যন্ত নামিয়ে ফেলল। বদরুল এক চিৎকারে উঠে বসে পড়ল। সারা শরীর কাঁপছে। খাট থেকে নামতে পারছে না। বেডসুইচ দিয়ে আলো জ্বালাল। ঘর আলোতে ভরে গেল। ঘরে কিছু নেই। তার চিৎকারের শব্দ বাতাসে ভাসছে। তরঙ্গায়িত হয়ে চলে যাচ্ছে দূরে, বহুদূরে।
সদরুল আমিন সাহেবেরও রাতে ঘুম হয়নি। তিনি জানেন, বদরুলকে অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হবে। সে ভয় পাবে। তারপরও তাকে পাঠিয়েছে। তার মতো যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। জীবন তো একটি যুদ্ধক্ষেত্রই। এখানে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করতে হয়। এ যুদ্ধে যে বিজয়ী, সে আলোকিত। সদরুল সাহেব জীবনযুদ্ধে বিজয়ী এক সৈনিক। তিনি তার একমাত্র নাতিকে সেভাবেই গড়তে চান। তিনি খুব ভোরে জোছনা মহলে চলে গেলেন। গিয়ে দেখেন, বদরুল ঘুমের ঘোরে আবোল-তাবোল কথা বলছে। বিড়বিড় করে বলছে, ‘কালোছায়াটা কোত্থেকে এলো?’ তিনি বদরুলের কপালে হাত রাখলেন। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। কপালে বিশ্বস্ত হাতের ছোঁয়া পেয়ে বদরুল চোখ মেলে তাকাল। ‘দাদু তুমি এসেছ’ বলে কাঁদতে লাগল। অভিমানের মেঘ কান্না হয়ে ঝরে! দাদুর প্রতি তার অনেক অভিমান। তিনি জেনেশুনে তাকে কেন আসতে দিলেন। দাদু চোখ-মুখ শক্ত করে বললেন, ‘কাঁদবি না। কান্না তোকে মানায় না। এর চেয়ে ভয়ানক জিনিস তোকে মোকাবেলা করতে হবে। এ জন্যই তোকে এভাবে গড়ে তোলা। আমি জানি তুই কী শুনেছিস? কী দেখেছিস? বদরুল বলল, ‘ওই কালো ছায়াটা কী?’
‘ওটা আমিও জানি না। আমি একবার ছায়াটা লক্ষ্য করে গুলি করেছিলাম। কিছুই হয়নি। তবে ছায়াটা খুব কদাচিৎ দেখা যায়। কারো কোনো ক্ষতি করে না। আমার ওসব গা সওয়া হয়ে গেছে। একদিন তোরও হবে। এ কথা বলেই তিনি বললেন, ‘চল, আজ বাড়ি যাই। আরেক দিন তোর সাথে আমিও আসব।’


আরো সংবাদ



premium cement
ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচারে ৫৩ নাগরিকের উদ্বেগ ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে দুর্নীতি কে প্রশয় দেয়া হবে না : জাতীয় নাগরিক কমিটি ফতুল্লা থেকে অপহৃত ২ শিশু বরিশাল থেকে উদ্ধার মহানবী সা:-কে নিয়ে কটূক্তি করা শিক্ষককে চাকরিচ্যুতের দাবি টাইম ম্যাগাজিনের বর্ষসেরা ব্যক্তি ট্রাম্প আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য দিবসে রিকের র‌্যালি ও মানববন্ধন অনলাইন এডিটরস অ্যালায়েন্সের সভাপতি হাসান শরীফ, সাধারণ সম্পাদক সোহেল চুয়েটে র‌্যাগিংয়ের দায়ে ১১ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার ঢাকায় উচ্চমাত্রার হর্ন ব্যবহার না করতে ডিএমপির নির্দেশনা তামিমের ঝড়ে জয় পেল চট্টগ্রাম তথ্য উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়ে ধোঁয়াশা, কর্মকর্তা প্রত্যাহার

সকল