সুগন্ধি
- নূরুন্নাহার নীরু
- ০৭ জুন ২০২৪, ০০:০৫
আজ একটু বেশিই ত্রস্ততা নাদিরার। ডিসি অফিস থেকে খবর এসেছে, আগামী দিন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস।’ প্রতিবারের মতো এবারেও দিবসটিকে কেন্দ্র করে নানা আয়োজন রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দিবসকেন্দ্রিক একটি আর্টিকেল লিখতে হবে নাদিরাকে।
ছাত্রীজীবনের এই লেখালেখির অভ্যেসটা এখন চাকরি জগতে এসে দিবসভিত্তিকই আটকে আছে।
তবুতো লিখছে! তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে সে প্রস্তুতিই নিতে হবে নাদিরাকে। তাইতো আজ আর কারোর জন্য অপেক্ষার সুযোগ নেই। সঙ্গী সহকর্মীটি আজ ফিরবেন একটু দেরি করে। তাই আজ একাই পাড়ি দিয়ে যেতে হবে এই বদ্ধ গ্রামটি। রাস্তাঘাটও খুব সুবিধের নয়। চলতে পথে রাস্তার ধারে একটা পচা ডোবা আছে, যা অতিক্রম করতে নাদিরা দুর্গন্ধে বেহুঁশ প্রায় হয়ে পড়ে। আছে কাঁচা গোবরের ঢিবি আর যত্রতত্র মলমূত্রের খোলা চিত্র। তবু চলতে হবে। ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ বলতে আমাদের জাতি শুধু গাছ লাগানোর চিন্তাটাই মাথায় রাখে; কিন্তু পাশাপাশি পরিবেশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাসহ দেহমনের সার্বিক যতœ নেয়াও যে একটা পরিবেশবান্ধব বিশেষ কিছু- এ ভাবনাটা নেই বললেই চলে; এমন ভাবনাটাই মাথায় খেলছিল নাদিরার।
দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ, কখনো সরষে ফুলের গালিচা অথবা লালশাক আর পালংশাকের লাল-সবুজের মেলা দেখতে দেখতে পথচলা। গ্রামীণ পথে চলতে গিয়ে এ দৃশ্য ওকে বিমোহিত করে তোলে। গ্রামে চাকরিস্থলের কষ্টটা অনেকটাই ভুলে যায় বটে। কিন্তু যত বিড়ম্বনা গ্রামের ওই সীমানাটুকু পাড়ি দেয়া। অফিস থেকে বের হয়ে ছোট্ট এই গ্রামটা পাড়ি দিতে ওর তিনবার বাহন বদলাতে হয়। সে না হয় হলো কিন্তু যে নোংরা পরিবেশের মধ্যে দিয়ে আসতে হয় তা আর দ্বিতীয়বার মনে করার মতো নয়। এর মধ্যে বৃষ্টি হলেতো আর যায় কোথা! কাদামাটি, দুর্গন্ধ আর নোংরা জিনিসের ছড়াছড়ি ওকে বিষিয়ে তোলে একদম।
কেবলই ভ্যান থেকে নেমে মোবাইলে সময় দেখে নিলেন নাদিরা বেগম। এবার তার উঠতে হবে অটোরিকশায়। এতে পার হবে গ্রামের উপকণ্ঠ। এরপর রিকশায় উঠবে শহরের উদ্দেশে যা একেবারে বাসার সামনে নিয়ে থামাবে। ‘ভাগ্যিস বাসাটা শহরে ঢুকতেই!’
অফিস থেকে বের হয়ে ভ্যানের উদ্দেশ্যে কিছুদূর হেঁটেই এগোতে হয় নাদিরার। আর সেইটুকুন রাস্তাতেও কী জঘন্য অবস্থা! মনে করতেই নাদিরার বমি আসে। তবু প্রতিদিন সেই কাঁচা গোবরের ঢিবি, রাস্তার পাশেই ত্যাগ করা মল, সবই অতিক্রমের সাথে সাথে রীতিমতো সহ্য করেই পথ চলতে হয় নাদিরাকে। এ নিয়ে কতবার গ্রামের গণ্যমান্যদের মাধ্যমে গ্রামবাসীর সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছে, পাড়ায় পাড়ায় উঠোন বৈঠক করেছে, জনসমাবেশ করেছে যা তার অফিসিয়াল কর্মসূচির আওতাভুক্ত। কিন্তু কে শোনে কার কথা! পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা জাতির নৈতিক দায়িত্ব। সে কি আর ঘাড় মটকে হয়!
‘পরিবেশকে সুস্থতার সাথে বাঁচিয়ে রাখা নাগরিক দায়িত্ব। এ পরিবেশ বলতে নিজের শারীরিক পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে চতুর্দিকের সব ধরনের অবস্থাকেই যে বোঝায়। আপন মনেই বিড় বিড় করে ওঠে নাদির। কিন্তু ওদের ভাবখানা এমন যেন বকে যাক আর শুনে থাকি, ব্যাস।
ওইতো একটা অটো আসছে। পুরুষ লোকে ঠাসাঠাসি। তবু একটা সিটের যাত্রী নেমে যাওয়াতে তাতেই উঠে বসলেন নাদিরা। অন্যদিন হলে আরো একটু সময় অপেক্ষা করে প্রায় খালি অটোতে আয়েস করে যেত নাদিরা। এমন ঠাসাঠাসি করে বসা গাঁয়ের লোকদের শরীরের দুর্গন্ধ নাকে নিয়ে দূরের রাস্তা পাড়ি দেয়া খুবই বিচ্ছিরি, অনাকাক্সিক্ষত বিষয়।
পরিবেশবান্ধব কর্মী হিসেবে একটা এনজিওতে চাকরি নিয়েছে নাদিরা। দেশের খুব পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলোতে তাদের কাজ। সে রকমই একটি ছোট্ট জেলা শহরের এক প্রত্যন্ত ইউনিয়নে তার কর্মস্থল বিধায় প্রতিদিনই তার এই নোংরা পথে চলা গ্রামের মুখটি দেখতে হয়। তথাপি সে এখানকার জনগণের সাথে একরকম একাত্মা হয়ে উঠছে যেন দিন দিন।
এই যে শুনুন! সিগ্রেটটা ফেলে দিন দয়া করে। পাশেই বসা গেঁয়োলোকটি বাধ্য অনুগত বালকের ন্যায় সুখটান ছেড়ে দিয়ে একটু নড়েচড়ে বসল। যাক কিছুটা হলেও বদলেছে জগৎ। পরিবেশবিধ্বংসী এ ব্যাপারটাতে কাউকেই ছাড় দেন না নাদিরা। জনগণও বেশ সহজেই মেনে নেয় ওর কর্কশ কণ্ঠের নির্দেশনা। টুঁ শব্দটি না করে জ্বলন্ত সিগ্রেটটি ফেলে দিলো লোকটা একটা বোকার হাসি হেসে দিয়ে।
‘উহ্ কী দুর্গন্ধ!’ রাস্তার পাশেই কোনো বাড়ির খোলা পায়খানা। বৃষ্টির ছিটায় দুর্গন্ধ আরো প্রকট হয়ে বাতাসে বয়ে বেড়াচ্ছে। গ্রামের লোকগুলোর এই আরেক সমস্যা। বাড়িঘরে, সংসারে-পোশাকে ইদানীং তারা যতই আধুনিকতার ছোঁয়া লাগানোর প্রতিযোগিতায় মেতে উঠুক না কেন- ওই স্বতঃসিদ্ধ কাজটার ব্যাপারে ততটাই উদাসীন। ওটাকে ঘেরাও দেয়া, লোকচক্ষুর অন্তরালে নেয়া, সেনিটারির পারিপাট্যতায় নিয়ে আসা- এসবে তাদের ভ্রƒক্ষেপ মাত্র নেই। নোংরা জিনিসটাকে কোনোমতে নোংরাভাবে ছেড়ে এলেই যেন বাঁচা গেল, পরবর্তীর চিন্তা আর থাকেই না ওদের। উন্নত জীবনে মলমূত্র ত্যাগের উন্নয়নও যে পরিবেশের একটি বিশেষ বিষয় এ ব্যাপারে গ্রামবাসীদের এমন নিস্পৃৃহতা নাদিরাকে মর্মাহত করে।
‘আরে বাপু এটাতো রুচিরও ব্যাপার। বাড়ির ভেতরের দিকের কাজটি বাইরে একেবারে রাস্তার ধারে নিয়ে এসে বসায় কী করে?’ ‘ওই যে পানি ব্যবহারের শব্দটা পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে। কী মূর্খতা!’ স্বগোক্তিতে মনটা বিষিয়ে ওঠে নাদিরার।
ওদিকে সামনের সিটে বসা দুই যাত্রী অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে, কথার ফাঁকে কাশছে, হাঁচি দিচ্ছে- আর সে সাথে তাদের মুখের দুর্গন্ধ! উপরন্তু ঘামে সিক্ত শরীরের ভাপসা গন্ধ নাদিরার নাকে এসে লাগছে অব্যাহত। বাধ্য হয়ে ওড়না দিয়ে নাক চেপে ধরতেও সঙ্কোচ লাগছে ওর। লোকগুলো না জানি কী ভাবে! অন্য সময় হলে এ রকম দুর্গন্ধ এড়াতে হাতব্যাগে যতেœ রাখা বডিস্প্রেটা বের করে টুপ করে নিজের নাকে লাগিয়ে দিত।
কিন্তু আজ! আজ কী হবে? এতটা পথ কিভাবে বয়ে যাবে? দুর্গন্ধে নাড়িভুঁড়ি উল্টে যাচ্ছে যে! একে তো সারা দিনের অনাহার তদুপরি এমনি গন্ধের বাহার! রাস্তা থেকে আরেক মহিলা উঠে বসেছে নেমে যাওয়া যাত্রীটির খালি সিটে। মহিলার নাক-মুখ নেকাবে ঢাকা। পরিচিতির সূত্র ধরে সেই দুই যাত্রীর সাথে কথোপকথনে মেতে উঠেছে মহিলাটি। দুর্গন্ধজনিত সমস্যার কোনো বালাই নেই মহিলাটির!
নাদিরার মনে পড়ে গেল মাস্ক না পরার অমনোযোগিতার কথা। করোনা শিখিয়েছে আমাদেরে মাস্কের উপকারিতা। মহিলাটির নেকাবই সে কাজটির সহায়তা করছে। ধীরে ধীরে ওড়নার আঁচলটি মাথায় তুলে নাক-মাথা ঢেকে পরিপাটি হয়ে বসল নাদিরা। বাহ! এতক্ষণের দুর্গন্ধ নেই তো! বরং সকালে ওড়নাতে লাগানো পারফিউমের সুগন্ধিটাই ওকে মোহিত করে তুলছে মুহূর্তে। নিজের মনেই হেসে উঠল পরিবেশবান্ধব কর্মী নাদিরা। নিজকে বড্ড বোকা মনে হলো। এ যে ‘জুতা আবিষ্কারের’ চেয়ে কোনো অংশে কম নয়!
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা