১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বন্দিনী

-

সুরাইয়া রাত ১২টায় বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। সারা দেহে ক্লান্তি আর শ্রান্তির ছাপ। ক্লান্ত দেহে শুতে না শুতেই তন্দ্রা আসে তারপর ঘুম।
কোমর অবধি চুল বালিশ ছাপিয়ে খাটের নিচে ছড়িয়ে পড়ে
খোলা জানালায় অমবশ্যার আঁধার কু ডেকে যাচ্ছে। সুরাইয়া হাত-পায়ে লাফ দিয়ে ওঠে, তার ঘুম পাতলা হয়ে আসে এবং কান্নায় চোখ ভেসে যায়...
কী ভয়ঙ্কর সে দৃশ্য!
এক পাশে একাই এক ব্যক্তি প্রতিবাদ করছে অন্য পাশে দুশো মানুষের বেশি তাকে আক্রমণ করছে!
সুরাইয়া থরথর কেঁপে ওঠে
থামো, থামো, থেমে যাও! চলো চলো তোমাকে বদর উদ্দীন ডাকছে। সারা শরীর তার পাথর হয়ে গেছে, জিহবা শুকিয়ে কাঠ, ঠোঁট নাড়াতে পারছে না। হাত দিয়ে কেবল ধাক্কিয়ে যাচ্ছে থেমে যাও!
উত্তেজিত মানুষগুলো সুরাইয়ার দিকে ধেয়ে আসে। কে? কে তুমি?

সুরাইয়ার সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে সবার সম্মুখ হতে মানুষটিকে আড়ালে নিয়ে যেতে চায়। এক একটি মানুষ এগিয়ে আসে আর তার চোখের সামনে এক একটি আকাশের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। দরজায় প্রবেশের যতই চেষ্টা করুক সিরাজউদদৌলার মতো ক্রমেই সে হারিয়ে যেতে থাকে। বাকরুদ্ধ সুরাইয়া কেবল এ দরজা থেকে ও দরজায় ছুটে যায়। তন্ত্রের এতো শক্তির সাথে তার পারার কথা নয়।
মানুষগুলোর মুখ তার কাছে শিকারে ব্যর্থ বন্য জানোয়ারের মতো বীভৎস মনে হয়। ওদের নখের আছড় তাকে রক্তাক্ত করে, ওরা দাঁতালো কামড় বসায়। সুরাইয়া জীবন্ত লাশের মতো চলতে থাকে। কোথাও কেউ নেই!
নবীন তাহলে কোথায়? তাকে আরশের কোন টর্চার সেলে বন্দী করেছে? সে কী প্রকাশ করেছে সে বিবিসির সংবাদ প্রযোজক? সে কী প্রকাশ করেছে সে একটি বার্তা সংস্থার সম্পাদক ও প্রকাশক? না মনে হয়। আজ তো সে সাংবাদিকতায় আসেনি। সে তো এসেছে সুরাইয়ার ডাকে। নিতান্তই আটপৌরে ভাবনায়, অসুস্থ সুরাইয়াকে আগলে রাখার জন্য। আজ তার সাথে তার কার্ড থাকার কথা নয়, তার প্রেস ক্লাবের মেম্বারশিপ কার্ড থাকার কথা নয়
কিংবা ছয় ডিজিটের নম্বরটিও মনে থাকার কথা নয়। তবে তাকে নিয়ে তন্ত্রের মালিক, প্রভুরা কী করছে? উদ্বিগ্ন সুরাইয়া জমে যায় এন্টার্কটিকার মতো। বিশালাকার মহাদেশ শূন্যতায় ঢাকা। সেখানে কারো চিৎকার পৌঁছে না। হালাকু খান কতো আর ভয়ঙ্কর! কত আর বাগদাদ ধ্বংস করেছে তার চেয়ে বেশি নিষ্ঠুরতম বিধ্বংসী কাজ তো আজকের তান্ত্রিক হালাকু খানেরা করে যাচ্ছে। এরা দিনকে রাত করছে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সরকার এদের লালন করে জনগণকে যাতে সরকার সেবা দিতে পারে।
আচ্ছা সরকারি সেবা জনগণের কাছে কে পৌঁছায়? তন্ত্রের প্রভুরা নাকি ফিল্ডে যারা ঘাম ঝরাচ্ছে, জনগণের সাথে যারা সরাসরি সম্পৃক্ত তারা? তবে এ সব প্রভুরা, আরশের মালিক কিভাবে হয়! সুরাইয়া চিন্তা করতে পারছে না। তার রক্তের প্রবাহ থেমে গেছে যেন! যেন সময় দেখতে পাচ্ছে আজরাইল তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, লোমশ হাত, ধারালো নখ তার দিকে এগিয়ে আসছে, কে তুমি? কে? এ কে? কেন এসেছ এখানে? জবাব দিতে পারছে না কারণ তার রুটি এখানে জিম্মি! তার ভাত এখানে জিম্মি! তার কাপড় এখানে জিম্মি! পৃথিবীতে একদিনও বাঁচতে হলে দরকার ভাত-কাপড় -রুটি। সুতরাং স্থির থাকো, ভেঙে পড়ো না। জমে যাও প্রবাহিত হইও না।
সুরাইয়া নিজেকে আবিষ্কার করে টয়লেটে। আশ্চর্য! এখানে এলো কেন? কিভাবে এলো? তার সারা দেহ শ্রাবণে ভেসে যাওয়া রক্ত জবার মতো নিঃস্ব, স্থবির। কাকে সে ডাকবে? কেউ কি তাকে ডাকতে পারে না?

সপ্ত আসমান থরথর কাঁপছে। কোথাও ফাঁক ফোকর পাচ্ছে না সে। হঠাৎ আরশের মালিক দুস্থ এক সিপাহিকে পাঠাল,
‘তোমাকে একান্ত রুমে ডাকছে।’ সুরাইয়ার আত্মা তখন বেরুবার জন্য পথ খুঁজছে। চারতলা থেকে তিন তলা
তিন তলা থেকে চার তলা সুরাইয়া ছুটছে। আসমানের একটি মাত্র দরজা কিছুক্ষণের জন্য খুলে গেছে। সুরাইয়াকে সেখানে স্কট করে নেয়া হয়- সুরাইয়া পৌঁছেই ডাহুকের মতো কেঁদে উঠলো, স্যরি স্যার। বুঝিনি এমন পরিস্থিতি ক্রিয়েট হবে,আমিই দায়ী! আমি এসেছি চার তলায়। আমার পাওনা বুঝে নিতে।
সিংহ যেন গর্জন করল কিসের পাওনা?
-কোভিড পরিস্থিতিতে শিখন নিয়ে প্রভুদের প্রজেক্টে কাজ করেছি। যখন লকডাউনে রাস্তায় কুকুরও ছিল
না। তখন হেঁটে, সাইকেলে চড়ে, অতিরিক্ত টাকা খরচ করে আমরাই, আমিই কাজ করেছি নীরবে। মাননীয়, আপনারা সে জন্য আমাদের ঝুঁকি ভাতা তো দূরে থাক, প্রাপ্য ন্যায্য হিস্যা দিতেও দেরি করেছেন। মহোদয় যুগ এখন ডিজিটাল। আপনারা লেনদেন কেন ডিজিটালি করেননি? আমার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিলে আমাকে তো এই আরশের মালিকদের কাছে আসতে হতো না! কথাগুলো সুরাইয়া বলতে পারেনি। কারণ পেট তো! বার বার সিগন্যাল দিচ্ছে ক্ষুধা লেগেছে! ক্ষুধা অব্যাহত থাকবে!
আরশের মালিকরা বাজখাই গলায় আবারো সাউট করছে। সুরাইয়ার বারবার টয়লেটে যাওয়ার তাগিদ অনুভূত হচ্ছে।
পেছন থেকে একজন ডাকল, এই সুরাইয়া এ দিকে আসুন। খুব পরিচিত কণ্ঠ খুব চেনা বাতাস। সুরাইয়ার চোখের তারা নড়ে উঠল। এবার নিশ্চয়ই নবীনের খবর মিলবে!

সুরাইয়া সাহস করে বলল, পুরো ব্যাপারটি আসলে কী আমার জানা নেই। কিন্তু দিপ্তি বলল, নবীনের বিন্দুমাত্র দোষ ছিল না। তাকে বারংবার উত্ত্যক্ত করা হয়েছে। আরশের মালিকের আশপাশে যেসব সিপাহি থাকে তারা মালিকের চেয়ে শক্তিশালী। একজন কম্পিউটার অপারেটর নবীনকে সাঁড়াশি আক্রমণ করেছে কারণ সে পায়ের ওপর পা তুলে বসেছে। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর সে জবাব দিয়েছে। আল্লাহপ্রদত্ত তার ভলিউম বেশি। তাতেই পুরো তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ সপ্তম আকাশ একাকার হয়ে তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।
সুরাইয়া গড়গড় আউড়ে যায়, নবীন অমুক... অমুক...অমুক...। পরিচিত স্বরটি খানিকটা থতমত খেয়ে বলল, তাহলে সে এত চেঁচাচ্ছে কেন? সুরাইয়া বলল, আমি কিছুই জানি না। সে তো এত চেঁচানোর কথা নয়! চেনা স্বরটি কাগজ হাতে দিয়ে বলল, যান, লিখে নিয়ে আসেন। সুরাইয়া স্তম্ভিত হয়ে যায়। কী বলে? নবীন আন্ডার টেকেন দেবে? আমার সামনে? ছিঃ লজ্জা! এ পুরো তন্ত্রের লজ্জা! এ পুরো আরশের লজ্জা। বদর উদ্দীন না হলে হয়তো সুরাইয়ার আজ চাকরিই যেত। কিন্তু দোষ কোথায় তা খুঁজে পাওয়া গেল না!
এর নাম ক্ষমতা যার জমিও তার! সুরাইয়ার ইচ্ছা হলো ধরণী দ্বি-ধা হও আমি সীতা হবো!
পায়ের ওপর পা তুলে বসা অন্যায় কী? শিষ্টাচারের কথা বলবেন? নবীনের তো তোমরা প্রভু নয়। প্রভু আমার। আমি তো পাথর, নতজানু, বন্দিনী! আমি তো বলতে পারি না আমরা যারা মাঠে আমরা কী মানুষ নই? ইনোভেশন নিয়ে কাজ করছো, কই তোমাদের দরজার সামনে ফকিরের মতো দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া তো আমাদের উপায় থাকে না!
আমি তো চিৎকার করতে পারছি না- তোমাদের গেস্টরুম নেই কেন? আমাকে কেন করিডোরেই অপেক্ষা করতে হচ্ছে? আমার সাথে, এমন কী যে কোনো ভিজিটরের সাথে গেস্ট থাকতে পারে সে গেস্ট কোথায় বসবে? কোথায় অপেক্ষা করবে প্রভুর ডাক শোনার জন্য? আমি তো বলতেই পারছি না, আমাকে কেন ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হচ্ছে? গেস্ট আমার কে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমার গেস্টকে তোমরা অপমান করেছো,আমি তো সপ্তর্ষিজালে বন্দী। আমার হাত-পা-চোখ-কান বাঁধা। আমি মাকড়সার মতো চার দিকের চাপে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছি। আর কী চাও? পাঁচ নম্বর প্রভুর সাক্ষাৎ পেয়ে প্রাণে প্রবাহের ক্ষীণ ধারা দেখা দিলো।

নবীনের দেখা পেলাম। তাকে কী বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না... চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। আমার জন্য শুধু আমারই জন্য তাকে অহেতুক ঝামেলায় পড়তে হলো!
টকটকে ফর্সা মুখটি ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সারা দিন আমারো পেটে দানাপানি পড়েনি নবীন খাবে কোথা থেকে! অভুক্ত আমি অভুক্ত সে। কতোগুলো দানবের মিথ্যাচারে ক্লান্ত নবীন ক্লান্ত আমি। কোনো রকমে বললাম, শুধু আমার জন্য... লজ্জায় নুয়ে গেছি। আমারই সহকর্মী অথচ কেউ প্রভু কেউ ভৃত্য! কেউ বরযাত্রী কেউ মিসকিন! আমারই সহকর্মী একযোগে আমার দিকে তীর নিক্ষেপ করছে। প্রতিটি তীর অর্জুনের ভিমের চেয়ে কঠিন। যেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ! একে একে লাশ হচ্ছে গান্ধারী ছেলে। কৌরব বংশ ধ্বংস হয়ে গেল।
মন্ত্রণালয় অধিদফতর কেন রেখেছে? দফতর সঠিকভাবে পরিচালনা করা নাকি ফিল্ডের মানুষদের অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য করা। অপমান করা? তাদেরকে ঘোরানো? তাদের ন্যায্য পাওনা যথাসময়ে বুঝে না দেয়া? তুই তোকারি করা? সহকর্মী কিভাবে আরেক সহকর্মীকে তুই তোকারি করে? মহাপ্রভু অপারেটরে ফিল্ডেই ফিরে আসো। তোমরা আসলে আমাদের হাত-পা শীতল হয়ে যায়। আমরা স্টোভ জ্বালিয়ে উষ্ণ করি, তোমাদের জন্য আমরা আমাদের বেনারসি শাড়ির আঁচল দিয়ে চেয়ার মুছে দিই।
আমাদের জন্য একটি গেস্টরুমের ব্যবস্থাও করতে পারো না?

তোমরা ব্রাহ্মণ আমরা শূদ্র
তোমরা নবাব আমরা ফকির আবার
তোমরা শোষক আমরা শোষিত....
আমাদের দীর্ঘশ্বাসের ওপর তোমরা আরামে ঘুমাও... হ্যাঁ, আমি বন্দিনী তাই নবীনকে বলতে পারিনি তুমি প্রফেশনাল হলে না কেন? সেও পারেনি নিজেকে প্রকাশ করতে। কারণ ক্ষুধা যে...তীব্র ক্ষুধা... বাঁচার আকুল ইচ্ছা এবং আমি যে... আমাকে যে সে ভক্তি করে, সম্মান করে, আগলে রাখতে চায়।
পৃথিবীর দেয়া আঘাত হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে চায়। আমার একান্ত নির্ভরতা যে... সুরাইয়া আর ভাবতে পারে না।
রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে এটা স্বাধীন দেশের প্রশাসন নাকি পরাধীন! এটা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা নাকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্লাইভের খঞ্জর!
ডাক্তার বার বার জানতে চায় সুরাইয়ার লাইফস্টাইল। তা না হলে তাকে সঠিক ট্রিটমেন্ট দেয়া যাবে না, কেন সে ট্রমায় আক্রান্ত হলো... কেন সে চমকে উঠেই অস্থির হয়ে যায়..


আরো সংবাদ



premium cement