কিছু কথা কবিতার
- মতিন বৈরাগী
- ০২ জুন ২০২৩, ০০:০৫
কবিতা অনেক সময় জাগতিক যুক্তিকে অতিক্রম করে এক রহস্যময়, অধরা ও দুরূহ ভাষাঅর্থ উপস্থাপন করে। একটি কবিতা থেকে সত্য উদ্ধারে পাঠকের যোগ্যতা ও কৃতী যে ভূমিকা নিয়ে উপস্থিত থাকে তার প্রস্তুতির আয়োজনে পাঠক কবিতার সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে। কবিতা মূলত ভাবের প্রকাশ- ভাষায়। ভাষা কবির মনোভঙির গোচর, তাকে আবিষ্কার করতে হলে চিন্তাকাঠামোর গভীরতম দিকগুলোর দিকে যতœ নিতে হয়। বলা যায় কবিতা শব্দকে চেঁছে নিয়ে সুঠাম করতে হয় অর্থের নতুন দ্যোতনা দিতে, ভাষ্যের পঙ্ক্তিতে শব্দের আগপিছ, গঠনক্রিয়া, প্রত্যাশিত অর্থসংযোজনায় প্রয়োজনীয় শব্দের জোগান, যা অর্থকে ভিন্ন মাত্রা দেয়। যেমন কেউ বললেন ‘আমার এখন বাড়ি যাওয়ার সময়’, সাধারণভাবে যে কেউ মনে করতে পারে বক্তা তাঁর বাড়ি যাওয়ার কথা বলছেন, কিন্তু অর্থদ্যোতনা লক্ষ করলে বোঝা যায়, তিনি মৃত্যুর কথা বলছেন। এই অর্থ সচরাচর বা প্রাত্যহিক নয়, যদিও প্রচল শব্দেই এর গঠনকাঠামো। কাঠামোবাদী তত্ত্বে সব সৃষ্টির মৌলিক একই এবং ভাষার হেরফেরে নতুন হয়ে ওঠে। শব্দের একমুখিনতাও কাঠামোবাদী ক্রিয়ারই প্রকাশ যা কাব্যে অধিকই ব্যবহৃত হয় এবং এরকম জনপ্রিয় কবিতাও বিস্তর রয়েছে বা সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিদিন। কিন্তু জনপ্রিয়তা আর সার্থক কবিতা শত প্রশ্নের এক উত্তরে নয়। যে শব্দ দ্যোতনার দিক থেকে সময়কে ধরতে পারে না বা গতির মুখে প্রতিস্থাপন করতে পারে না, গুণগ্রাহীকে সেগুলো গতানুগতিক, সেকালের এবং আধুনিকতা থেকে বিস্তর দূরবর্তী রাখে। বাস্তবে এরকম কবিতায় সমসাময়িকতা যুক্ত থাকে অতীতের রুচি অভ্যাসের সাথে যুক্ত হয়ে। সম্মিলিত সঙ্গতিতে আগামীর বোধবুদ্ধি, বিজ্ঞানচেতনার সংযুক্তির কোনো সঙ্কেত থাকে না। কেবল পাঠ-আনন্দ ছাড়া এই কবিতায় আর কোনো অনুসন্ধান পাঠককে সমৃদ্ধ করে না; বরং কবিতা ও বিবৃতভাষা পরস্পর থেকে দূর বিন্দুতে লগ্ন হয়। দার্শনিক হাইডেগার তাঁর নন্দনতত্ত্বে ‘কবিতা’ শব্দটির মূল্যায়ন করেছেন নতুনভাবে। তিনি মনে করতেন ‘যেকোনো শুদ্ধ শিল্প সত্যের সন্ধান দিতে পারে। কবিতা-শিল্পের রূপ ও স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে হাইডেগার ওপেন (খোলামেলা) শব্দটির ওপর জোর দিয়েছেন কারণ সত্তার গহিনে যে গোপন তাকে উন্মোচন করাই হলো শিল্পের কাজ।’ তাঁর বক্তব্যানুসারে মানুষের সত্তার নিবাস হলো তার ভাষায়। মানুষ ভাষার রাজ্যে বসবাস করে এবং ভাষাই তার মন গঠনক্রিয়াকে প্রকাশঋদ্ধ করে। জীবনের সব কিছুই শব্দে গ্রথিত আর সে কারণে তার সৃষ্টিকে বুঝতে হলে সত্তার মর্মার্থকে অনুসন্ধানে নেয়ার প্রয়োজন। ফ্রয়েডের মতে, মানুষের মন ভীষণভাবে গতিশীল এবং তাড়না, বিরোধ, বাসনা, অবদমন ইত্যাদির মতো ক্রিয়া দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। আমাদের চারপাশের বাস্তবতাকে এসবের প্রেক্ষায় বিশ্লেষণ করে সৃষ্টির গহিনকে খানিকটা উপলব্ধিতে আনা সম্ভব। এই তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে জ্যাক লাকাঁ যে ধারণা উপস্থিত করেছেন তা আমাদের বর্তমান চেতনাকাঠামো গ্রাহ্য এবং যৌক্তিক বলে মনে করেন তত্ত্ববিদরা।
সপ্তদশ শতাব্দীতে নন্দন তাত্ত্বিক গবেষণার প্রসার ঘটতে থাকে। নতুন নতুন শব্দের ব্যবহার পুরাতন শব্দের নতুন অর্থ যোজনায় নতুন করে উপস্থাপনা এবং শিল্প বিষয়ে নানারকম সমালোচনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে থাকে। এই সময় রুচি, বুদ্ধি, কল্পনা, দুর্বার কল্পনা, অনুভূতিগুলোর গভীরতম বিশ্লেষণ শুরু হয়ে যায় এবং তা শিল্পের নানা আলোচনায় ছড়িয়ে পড়ে। ‘পাদ্রি মুরাটোরি’ যে কল্পনার কথা বলেছেন তা পুরোপুরি ইন্দ্রিয়জ। তার মতে বল্গাহীন কল্পনা যদি প্রজ্ঞার (ইনটেলেক্ট) নিয়ন্ত্রণহীন হয় তা হলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। দেকার্ত এ্যলিগরি বা রূপকে সাগ্রহ সমর্থন জানিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন যুক্তিবাদের প্রবক্তা। দেকার্তপন্থীরা আইডিয়া বা ভাবভাবনায় পরিবতর্নযোগ্য ধারণার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। ইতালীয় লেখক ‘কন্টির’ মত ছিল- কবিদের সব কিছুই চিত্রকল্পের (ইমেজ) মাধ্যমে বলা উচিত।
এভাবেই কবিরা সমাজে কখনো হয়েছেন রূপবিলাসী, কখনো তিমির হনন প্রত্যাশী, কখনো বিমূর্ত ভাবধারায় নিমজ্জমান ভাবনা বিলাসী এবং কখনো নৈতিকতার শুদ্ধস্বর।
‘ইংরেজি লেখার মধ্যে বাংলা গুঁজতে গিয়ে
আলিঙ্গনের মুহূর্তে ফিরে আসে ফায়ার (ঋরৎব)
লাভের অংশ নিয়ে ভালোবাসা ফেরি করছে কিউবি কনডোম
বাংলায় বোমা ফাটছে
আর খিল এঁটে বাচ্চা শুয়োরেরা হিসি দিচ্ছে
তিস্তার পানি বণ্টনে একটি চিতা থাকলে
বাংলা পুড়িয়ে তোমাকে হিন্দিতে লিখব (হাবীবুল্লাহ সিরাজী, খেলা)
বাংলার মধ্যে ইংরেজি গুঁজতে গিয়ে কিংবা লেখার বেলায় বাংলা ইংরেজি হরফে কিংবা ভাষার রসায়নে বাংলা ইংরেজির সাথে মিলিয়ে ঝাঁকিয়ে একটি রসায়ন যখন হয়ে উঠল তখন শব্দ হলো ‘ফায়ার’ (ইংরেজিতে এফআইআরই, বাংলায় ফিরে যা ইংরেজি হরফে লেখা হয়) আর ভাবনায় এই ফায়ার বিগত দিনের যা চলমান উপনিবেশ ভেঙে নতুন ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তির সামনে দাঁড়িয়ে সমান একটি আপ্তবাক্য স্বাধীনতা নামের, আবার ফিরে নি¤œপ্রান্তকে ভাঙে, যার কোনো প্রতিফলন জীবন ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র স্বকীয়তায় উদীয়মান নয়, তাই সভ্যতার সব কিছু গ্রহণ সেই ঔপনিবেশিক ভাষায় এবং রূপান্তরও তারই রসায়ন। সে এক বিচিত্র ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’ যার মধ্যে সেই ‘ফায়ার’ সেই কাল একালজুড়ে সমানভাবে ক্রিয়াশীল। আর কিউবি কনডোম একটি প্রতীক হয়ে ফিরে আসে চেতনা বিপ্রতীপ’ ‘হানাদেয় বাংলায় বোমাফাটে’-এই বোমার ইতিহাস এর পেছনের ঘটনাবলি তো চোখ খুললেই দেখে নেয়া যায়। আবার ‘একটি থাকলে’ বিশষায়িত এক বিশেষ যার ইঙ্গিত বৃহতের দিকে। এ হচ্ছে ভাষার, সংস্কৃতির, জীবনবৈরী চেতনা যা ফোটে বাংলা হরফ ভেঙে ইংরেজি হয়ে দৈনন্দিন হয়ে। যে বিবেকগুলো বাতিঘর হতে পারত তারা এখন দরজায় ‘খিল এঁটে বাচ্চা শুয়োরের মতো হিসি দিচ্ছে’ সত্যি অভিনব এক দৃশ্যের সাথে আরেক দৃশ্য জুড়ে দিয়ে এক ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে বলা ‘তিস্তার পানি বণ্টনে একটি চিতা (চিতা প্রজ্ব¡লিত অগ্নিকুণ্ড আবার চিতার ক্ষিপ্রতা দু’রকম অর্থের প্রতীক হতে পারে এখন পাঠককে লাগসই অর্থটি নিতে হবে।) থাকলে/বাংলা পুড়িয়ে তোমাকে হিন্দিতে লিখব’। এই চিতা কেবল একটি প্রতীকী ভাষা একটি প্রতীকী ইঙ্গিত যা রয়েছে ভাবীকালে, আর তা হলে তখন ‘হে উপনিবেশ সালাম/এই বদলে, (ভূমিষ্ঠ হচ্ছে, যদি এমনি একদিন পদ্মা ব্যারেজ ভূমিষ্ঠ হয়’ তাহলে তো চিতা জ্বলবে আর তারপর নবযাত্রার আয়োজন বাড়তিকে কমিয়ে একই হবে উপাসনার। অথবা প্রতিদিনের এই গ্রহণ-বাতিল, বাতিল-গ্রহণের ভেতর যদি হয় পদ্মা সেতু এটিও একটি প্রতীকী উপস্থাপনা, সেতু যা দুই কে যুক্ত করে, দুই কে এক করে দুইয়ের বিপরীত ভাঙে মৌলিক অবিভাজ্য সংখ্যায় যা দ্যোতিত হয় তখন কি তুমি ‘ইংরেজি লেখা নিয়ে/বাংলায় আমার সাথে খেলবে প্রশ্নবোধক বাক্যটিতে প্রশ্নবোধক চিহ্ন নেই আছে দুই চপল বালক-বালিকার খুনসুটি। জিজ্ঞাসা ঊর্ধ্বমুখী হয়।
কবিতা কি, কেন এতকাল ধরে কবিতা মানুষের কাছে সমান আদৃত হয়ে আসতে পারল? ‘ভেঙে পড়তে পড়তে’ আবার দাঁড়িয়ে যাওয়া কতভাবে তার শরীর গড়ল, কত তত্ত্বে হয়ে উঠল ধরা অধরা এবং তারপরও তার গভীরে থাকল সেই শক্তি যে আগুন; ‘সৃষ্টি শক্তি’ উত্তাপ ভালোবাসায় ঘৃণা। কেন কবিতা আপন মহিমায় নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে সমকালেও সমান মর্যাদায় দাঁড়িয়ে থাকল কারণ তার আগুন আছে, শক্তপোক্ত পা আছে। কেন কবিতা হয়ে উঠল এক বাণী যা ধ্বনিত হলো দর্শন বিজ্ঞান সব কলায়? আর তাই নিয়ে গড়ে উঠল নানা চিন্তা চেতন/অবচেতন নিশ্চেতনার জিজ্ঞাসা? কখনো জুটল রাজরোষ কখনো অবহেলা আবার দিশা যা সব বৈরী দেয়াল ভেঙে মনোভূমিকে উর্বর করে প্রতিদিন। কবিতা একটি শিল্প, শিল্প তাই যা আনন্দ দেয় মনকে প্রহ্লাদিত করে, জীবন বীক্ষণের উন্মিলিত চক্ষে দেখে দৃশ্য আলো/ছায়া প্রতিচ্ছায়া যা বস্তুর নব্যরূপ যা ঠিক ঠিক বস্তু নয়। তবু মনের সন্ধিতে নতুন ভাবকল্প ছড়িয়ে দেয় ¯িœগ্ধ আকাশের মতো।
কডওয়েল বলেছেন ‘শিল্প সংগ্রামের মধ্য থেকে জন্ম নেয়; কারণ সমাজে অলীককল্পনা ও বাস্তবের মধ্যে একটি সঙ্ঘাত থাকে। এটি স্নায়ুরোগীর সঙ্ঘাত নয়, সামাজিক সমস্যা এবং সমাজের হয়ে শিল্পী তার সমাধান খোঁজেন। কবি সামাজিক ভূমিকা পালন করেন’ মনোসমীক্ষকরা কবিকে স্নায়ুরোগী ভাবেন। কোনো শিল্পকর্মের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মনোসমীক্ষক সেই কারণে সেই প্রতীকগুলোরই সন্ধান করেন যেগুলো বিশিষ্টভাবে ব্যক্তিগত অর্থাৎ নিউরোটিক। (ইল্যুয়েশন অ্যান্ড রিয়ালিটি) সত্য এই যে আলোচকরা সৃষ্টির ¯্রষ্টাকে বস্তু বিচ্যুত করে তার ভাবনার পাখাকে ভিত্তি করে বলেই তাঁরা ভুলে যান কবি সামাজিক মানুষ, সংবেদন সঞ্চারণশীল বলেই পারিপার্শি¦কতার বিষয়-আসয় থেকে সংবেদনের উপকরণগুলো পেয়ে যান এবং প্রকাশমুখী করেন ভাবনায়। বস্তুকে নয় বস্তুর প্রতিচ্ছায়াকে কল্পনার ঘোড়ায় চড়িয়ে তার প্রকাশগুলোর অন্তরভাবনা থেকে উৎসারণের পর ভাষারূপ পায়। যদিও কল্পনার সব ছায়া সফল ভাষা প্রয়োগে মূর্ত হতে পারে না, কিন্তু কাব্যে যে শব্দগুলো উঠে আসে তার গতানুগতিক এবং প্রাত্যহিক অর্থই সে কেবল বহন করে না। উপমা উৎপ্রেক্ষা প্রতীক ইত্যাদিতে এমন কিছু বলে যা আরেকজনের মনে নতুন উদ্দীপনের উদ্ভব ঘটে। প্লাটো সুন্দরকে স্বর্গীয় রূপ আর এরিস্টটল সুন্দরকে প্রকৃতিলগ্ন বলেছিলেন। স্বর্গীয় রূপ কেউ প্রত্যক্ষ করেছে বলে জানা নেই, কিন্তু প্রাকৃতিক রূপ নিয়ে একটি ভাবনা এবং অবলোকিত সুন্দরের ভিত্তিতে আরো বেশি সুন্দরের কল্পনা যা দৃশ্যমান নয়, কিন্তু মন চায়, এরকম বর্ণনায় সব কিছুকে ছাপিয়ে ইংরেজিতে ‘সাবলাইম’ শব্দটির ব্যবহার হয়, যেন সুন্দর, চমৎকার, খুব সুন্দর ভীষণ সুন্দর এবং ভয়ানক সুন্দর এসব অবলোকিত প্রকাশ আর তৃপ্তিদায়ক নয়। টলস্টয় শিল্পের ব্যাপকতার পক্ষে তার ‘শিল্প কী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, তিনি শিল্পের বহুর গ্রহণযোগ্যতাকে সমর্থন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ শিল্পের সুন্দরকেই সমর্থন করেছেন এবং শিল্প উদ্দেশ্যপূর্ণ হওয়া উচিত নয় এমন মতে বলেছেন- ‘উদ্দেশ্যের শিল্প নয়, শিল্পই শিল্পের উদ্দেশ্য’, জীবনানন্দও এই মতের সমর্থক হয়ে সৃষ্টিতে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং বহুর স্থান সঙ্কুলান করেছেন (আর তাতেই প্রমাণিত শিল্পের উদ্দেশ্য শুধু শিল্প নয়; বরং সামাজিক প্রেরণাই সামাজিক উদ্দেশ্যে শিল্পের সৃষ্টি) তাহলে এ মতগুলো ভিন্নমতে ক্ষয়ে যাচ্ছে এবং যেহেতু এর ভোক্তা মানুষ, সমাজ তাই শেষতক মানুষের, অনুভূতি আকাক্সক্ষার বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে নেই।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা