২১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭ মাঘ ১৪৩১, ২০ রজব ১৪৪৬
`
গ ল্প

চাঁদ ও একটি কফিন

চাঁদ ও একটি কফিন -

আহসান সাহেবের জিপটি দ্রুত গতিতে আরিচা অভিমুখে এগিয়ে চলছে। উদ্দেশ্য গ্রামের মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করা। গাবতলী পেরিয়ে জিপটি যখন আমিনবাজার ব্রিজের ওপর তখন আহসান সাহেবের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। নম্বরটি পরিচিত। সালাম দিয়ে কথা শুরু করলেন। কথা শেষ হলে ড্রাইভারকে বললেন, গাড়ি ঘোরাও, ধানমন্ডি চলো।
আহসান সাহেব একটি ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতা। সদা হাস্যোজ্জ্বল, মাঝারি গড়ন, বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁঁই। দেশে তখন তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন চলছে। সেই আন্দোলনে অংশ নেয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে লিয়াজোঁকারীদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
লাল সিরামিক ইটের তৈরি ধানমন্ডির যে বাড়ির সামনে আহসান সাহেবের জিপটি থামল তার গেটের একপাশে লেখা, সুধা সদন। আহসান সাহেবকে দেখে বাড়ির দারোয়ান গেট খুলে দিলো। গাড়ি বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলে দারোয়ান দ্রুত গেট বন্ধ করে আহসান সাহেবের সামনে এসে হাসিমুখে সালাম দিলো। সালামের জবাব দিয়ে দারোয়ানের কুশলাদি জিজ্ঞেস করায় বোঝা গেল আহসান সাহেব এ বাড়ির পুরোনো মেহমান। মজবুত শরীরের আহসান সাহেব বেশ দ্রুততার সাথে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেলেন। দরজার সামনে সিঁড়ির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকা শ্যামবর্ণের পঞ্চাশোর্ধ একজন মহিলা তাকে রিসিভ করলেন। আহসান সাহেব মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন, এত জরুরি তলব। সরকারের তরফে কোনো খবর আছে নাকি?
-সরকারের খবরের জন্যে কী আর আপনাকে বাসায় ডেকেছি। আসলেন, বসেন চা খান, বলছি।
আহসান সাহেবকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে বসানো হলো। তিনি যে সোফায় বসলেন তার উল্টো দিকের দেয়ালে তাকে রিসিভকারী মহিলা ও তার পিতার যৌথ একটি ছবি টাঙ্গানো। মহিলার পিতা পাকিস্তান কায়েমের আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। সাতচল্লিশের পর একে একে জাতীয় নেতাদের অবর্তমানে তিনি নেতা হওয়ার সুযোগ পান। তার সাংগঠনিক যোগ্যতা ছিল অসাধারণ। তবে বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তর-দেশের বাঁক পরিবর্তনের ঝঞ্ছাময় সময়ে তিনি কৌশলে সরকারের সাথে আপস করে কারাগারে ছিলেন। তার এই কারাবরণের কাহিনী তিনি রাজনীতিতে কাজে লাগিয়েছেন। পেশিশক্তির ব্যবহারে ও ভারতের সহযোগিতায় দেশের বৈষম্যপীড়িত মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। একাত্তরের যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করে নিজ ও পরিবারকে নিরাপদে রাখেন। এরপর দেশ স্বাধীন হলে শাসকের চেয়ারে বসার মাধ্যমে তার এতদিনের সাধ পূরণ হয়। ক্ষমতার চেয়ারে বসার পর প্রকাশ পায় তার আসল চেহারা। ধরা পড়ে তার কথা ও কাজের বৈপরীত্য। এত দিন যে বলেছেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, জনগণের মুক্তি চাই’। ক্ষমতা পাওয়ার পর সেটি উল্টে যায়। তিনি ও তার কর্মীরা মিলে গড়ে তোলেন, এক নেতার এক দেশ। একসময় মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। তার অপশাসন থেকে মুক্তি পেতে মানুষ আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানায়। একসময় মহান আল্লাহ কবুল করেন সেই ফরিয়াদ। দেশ ও জাতিকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেন সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপ্লবী সদস্য। মারা পড়ে পরিবারের প্রায় সবাই। বিদেশে থাকায় বেঁচে যায় শুধু দুই কন্যা। তাদের বড়জন যিনি পরবর্তীতে তার পিতা কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা দলের হাল ধরেন। পিতার ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে ২৩ বছর পর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। আহসান সাহেবদের দল তার সেই স্বপ্ন পূরণের সহযোগী। তাদের বাড়ি একই জেলায়। তাই আন্দোলনের বাইরেও আহসান সাহেবের সাথে তার খাতির একটু বেশি। এ কারণেই বিশেষ ও ব্যক্তিগত প্রয়োজনে যখন তখন আহসান সাহেবের ডাক পড়ে।
আজো হয়তো তেমনি কোনো কারণে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বাসার ভেতর থেকে এক মহিলা চায়ের ট্রে নিয়ে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করল। সালাম দিয়ে ট্রে থেকে চা নাশতা নামাতে নামাতে বলল, ভাইজান আমার বাড়িও ফইরেতপুর, বাঙ্গা থানা। ইবারের নতুন গুড়ির পায়েস। আপনি আসপেন শুনে তাড়াতাড়ি রান্দিসি।
বুবু মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, হইছে থাম। এলাকার মানুষ পেলে আর হুঁশ থাকে না।
-সিডা তো আপনিও করেন গোপালগঞ্জের এট্টা শিয়েল আসলিও আপনি মুরগি রান্দা করে খাওয়ান।
-রাহেলা, তুই যাবি?
রাহেলা ভেতরে চলে গেলে বুবু আসল কথা পাড়লেন। বললেন, পুতুলের একটি বিয়ের সম্বন্ধ আসছে। ছেলের ফ্যামিলি আপনি চেনেন। এই জন্যে আপনাকে ডাকা।
-কোথায়?
-ফরিদপুরের খন্দকার বাড়ির ছেলে, নুরু মিয়ার নাতি।
আহসান সাহেব মুচকি হেসে বললেন, তারা তো রাজাকার।
-থোন তো রাজাকার।
-রাজাকারে যদি দোষ না থাকে, তাইলে অন্য দোষ থাকলেও বা কী।
-আপনি মশকরা করছেন। রাজনীতির জায়গায় রাজনীতি। আর মেয়ে বলে কথা। ছেলের স্বভাব চরিত্রটাই আসল।
-আচ্ছা আমি বাড়ি যাচ্ছি যেহেতু খোঁজ নিবানে।
চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়ে আহসান সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আমার একটু তাড়া আছে। বাড়ি গিয়ে জুমার নামাজ পড়ব।
আহসান সাহেব বেরিয়ে পড়লেন। বুবু তার পেছনে সিঁড়ি পর্যন্ত এলেন। বললেন, বিষয়টি অবশ্যই জানাবেন।
আহসান সাহেব পেছনে ঘাড় ফিরিয়ে একটু হেসে বললেন, মামা হিসেবে আমারও তো দায়িত্ব আছে।
মাস কয়েকের মধ্যে বুবুর একমাত্র কন্যা পুতুলের বিয়ে হয়ে গেল সেই রাজাকারের নাতির সাথে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আদায় করে পিতার ভুলের জন্য মাফ চেয়ে বুবু ভোটে জিতলেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন। ২৩ বছরের পুরনো চাটার দল নতুন করে চাটতে শুরু করল। দেশে দেখা দিলো অরাজকতা। পাঁচ বছর বাদের ভোটে বুবু হেরে গেলেন। শুরু হলো দেশকে নিয়ে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র। নিজের ক্ষমতায় আসা নিশ্চিত করতে আন্দোলন করে মিলিটারিদের ক্ষমতায় বসালেন। ষড়যন্ত্র সার্থক হলো। বুবু ভোটে আবার জিতে গেলেন। এবার তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী না, রানী হলেন। চোর-ডাকাত মন্ত্রী হলো, পথ-গায়িকা সংসদ সদস্য হলো, কমিউনিস্টরা ‘হাজী’ হলো, দেশে প্রভাব নিলো ভিন্ন দেশ, স্বৈরাচার সঙ্গী হলো। চৌদ্দ সালে আবার ভোট এলো, ভোটের খেলায় তার জিত হলো। নির্বাচনে বুবু আহসান সাহেবের দলকে পাশে চেয়েছিলেন কিন্তু পাননি। সেই রাগে ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পরামর্শে একাত্তরে আহসান সাহেবদের দলীয় অবস্থানের কারণে বুবু তাদের বিচারের উদ্যোগ নিলেন। বিচার তো নয়, জুডিশিয়াল কিলিং।
পনের সালের শীতের শুরুর কোনো এক রাত। পুরো নাজিম উদ্দীন রোড পুলিশে পুলিশারণ্য। জেল গেটে দু’টি অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়ানো। সাধারণ লোকজনের উপস্থিতি কম। তবে নানা পদের সাংবাদিকের বাহার। টিভি সাংবাদিকরা নিউজের আপডেট ব্রডকাস্ট করছে। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় হোক সাংবাদিকরা বেশ উৎফুল্ল। কয়েকজন পোশাকি মুক্তিযোদ্ধা লাল-সবুজ রঙের পোশাক পরে ‘রাজাকারের ফাঁসি’ চেয়ে স্লেøাগান দিচ্ছেন। তাদের মধ্যে একজন চুপচাপ। পাশের জন কনুইয়ের গুঁতা দিয়ে বলল, স্লেøাগান দিচ্ছিস না কেন?
গুঁতা খাওয়া লোকটা বলল, যার ফাঁসি চাচ্ছ, মুন্ত্রী থাকতি তো তার হাতেই ভাতা খাইছ।
পূর্বের লোকটা মুখ ভেংচিয়ে বলল, এখন যারডা খাচ্ছিস, তার পক্ষে ক।
মুক্তিযোদ্ধাদের বাকযুদ্ধ চলছে এমন সময় জেল গেট খুলে গেল, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের স্বজনরা বেরিয়ে এলো। তাদের মধ্যে কোনো চিৎকার নেই, হাপিত্যেস নেই, মাতম নেই। মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে, পূবের চাঁদ পশ্চিমে হেলেছে। অ্যাম্বুলেন্সগুলো ভেতরে ঢুকল। বুঝতে বাকি রইল না যে, কার্য সমাধা হয়েছে। কিছু সময় বাদে জেল গেট আবার খুলল, অ্যাম্বুলেন্সগুলো বেরিয়ে এলো। প্রতিটি অ্যাম্বুলেন্সের আগে-পিছে পুলিশ ভ্যান। এভাবে একটি একটি করে অ্যাম্বুলেন্স নাজিম উদ্দীন রোড ধরে ধীর গতিতে এগোতে লাগল।
বুবুর ড্রয়িং রুমে তখনো লাইট জ্বলছে। পুতুল ও তার স্বামী নানাপদের খাবার সামনে নিয়ে সোফায় বসা। আরেক সোফায় বসে বুবু মোবাইলে কথা বলছেন, তার চোখে মুখে অপরাধবোধের প্রকাশ। ঘরের চৌকাঠে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে রাহেলা টিভি দেখছে। টিভিতে জেল থেকে বেরুনো অ্যাম্বুলেন্সগুলো চলাচলের খবর দেখাচ্ছে, তবে তা সরাসরি নয়। রাহেলা নাকের পানি আর চোখের পানিতে আঁচল ভিজিয়ে ফেলছে। সে আগেই খবর পেয়েছে। কারণ তার মোবাইল সেটেও অনেক হোমরা চোমরার নম্বর আছে। আর দারোয়ান তো তার বিশেষ সংবাদদাতা।
অ্যাম্বুলেন্সগুলো চাঁনখারপুলে এসে নিজ নিজ গন্তব্যে বিভক্ত হয়ে গেল। একটি অ্যাম্বুলেন্স গেল নিউমার্কেট হয়ে গাবতলীর দিকে, যে পথ ধরে আহসান সাহেব বাড়ি যাতায়াত করতেন। শিশিরশিক্ত পিচঢালা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলছে গাড়ির সারি। আজ জীবনের শেষবারের মতো আহসান সাহেব আমিনবাজার ব্রিজ পার হচ্ছেন। তুরাগের কালো পানিতে চাঁদের আলোর ঝিলিক। গাড়ি চলছে, সাথে সাথে চাঁদও চলছে, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে, উঁচু দালানের মাঝ দিয়ে। অ্যাম্বুলেন্সের কালো গ্লাস ভেদ করে আবছা চাঁদের আলো পড়েছে আহসান সাহেবের কফিনের উপর, যেন চাঁদ কথা বলছে তার সাথে। চাঁদ বলল, আহসান সাহেব আপনাকে যখন ফাঁসিতে ঝুলানো হয়, তখন আমি জেলখানার উপর দক্ষিণ আকাশে। ফেরেশতারা মখমলের কাপড়ে ঢাকা রুপালি পাত্র নিয়ে অপেক্ষা করছে। মৃত্যুর ফেরেশতা আপনার রুহটা ফেরেশতাদের কাছে দিলো, তারা সেটি যতেœর সাথে নিয়ে ঊর্ধ্বাকাশে গমন করল। মনে হলো, আপনার জানটা এহসানের সাথেই কবজ করা হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement