১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

হেমন্তের সম্ভার

-

ঋতু বৈচিত্র্যে ভরা আমাদের রূপসী বাংলাদেশ। রূপ বদলের পালায় হেমন্ত ঋতু কড়া নাড়ে দোরে। শান্ত মেজাজের হেমন্তের সকালে নরম রবির কিরণ এক মায়াবী স্নিগ্ধ হাসি ছড়িয়ে দেয় সবুজ ফলের ক্ষেতে। হৈমন্তী বাতাসের মৃদু কম্পনে সবুজের ঢেউ খেলে যায় অবারিত মাঠে। তাতে প্রকৃতির ঈর্ষণীয় রূপে আরো মোহাবিষ্ট করে বাংলার সবুজ শ্যামল প্রান্তর। বাংলা মায়ের আহ্লাদিত মুখচ্ছবির অপার সৌন্দর্য চোখ দু’টিতে এঁকে দেয় এক নান্দনিক দৃশ্য। দেশমাতার মমতায় ঘেরা সবুজ আঁচলে বারবার আশ্রয় খোঁজে মোহিত হৃদয়। হেমন্ত বাতাসে মাঠে মাঠে সবুজের বন্যা ঘোষণা করে বাংলা মায়ের রূপের বন্দনা। দৃষ্টিনন্দিত সে রূপের সৌন্দর্য মুগ্ধতায় বিমোহিত হৃদয় হয়ে ওঠে আবেগ আপ্লুত। কচি ধানক্ষেতের সবুজের ঢেউ হারিয়ে যায় দূর অজানায়। সে ঢেউই বুঝি শক্তি জোগায় দেশমাতাকে এত ভালোবেসে বক্ষে ধারণ করতে।
পৃথিবীর কক্ষপথ ও অক্ষীয় ঢালের ভিত্তিতে বছরের খণ্ড বিশেষ সময়কে আমরা ঋতু বলে আখ্যা দেই। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই রয়েছে চারটি ঋতু যথা- বসন্ত, গ্রীষ্ম, হেমন্ত, শীত, কিন্তু বাংলাদেশ ভারত, অস্ট্রেলিয়াসহ উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি দেশের অধিবাসীরা আরো দু’টি যথা- বর্ষা ও শরৎকে বরণ করে ঋতুচক্রকে ভাগ করে ছয়টি ভাগে। সে হিসাব মতে বঙ্গাব্দে বহমান ঋতুর চতুর্থ ঋতু হেমন্ত। যা বাংলা কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস নিয়ে গঠিত। শরতের বিদায়ী ঘণ্টার সাথে আগমনী ঋতু হেমন্ত জানিয়ে দেয় তার অস্তিত্ব। আর বিদায় কালে যেতে যেতে ঘোষণা করে শীতের পূর্বাভাস। প্রকৃতির পুরোনো খোলস বদলে নেয়ার ঋতু হেমন্ত। অনেকে এ ঋতুকে পাতা ঝরা ঋতু বলে আখ্যায়িত করেন। দু’-একটি বৃক্ষ বাদে প্রায় সব গাছের পাতা শীতের আগে অর্থাৎ হেমন্তেই ঝরে যায়। কথিত আছে ‘কৃত্তিকা’ ও ‘আদ্রা’ এ দু’টি তারার নাম অনুসারে নামকরণ হয় কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসের। অন্য দিকে কারো কারো মতে, অগ্রহায়ণের অগ্র অর্থ ‘আগে’ আর হায়ণ অর্থ ‘মাস’ থেকে বাংলা বছরের প্রথম মাসের নাম রাখা হয় অগ্রহায়ণ। অর্থাৎ মোগল সাম্রাজ্যের তৃতীয় অধিপতি সম্রাট আকবর ফসলি খাজনা আদায়ের অসুবিধা দূর করতে যখন সভাসদ জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজির সহায়তায় ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘তারিখ-এ-এলাহি’ নামে বছর গণনা পদ্ধতি প্রচলন শুরু করেছিলেন। সে সময়ের কৃষকদের কাছে এটি ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিল। যা পরবর্তীকালে বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায়। তখন কিন্তু অগ্রহায়ণকেই বাংলা মাসের শুরুর মাস বলে ঘোষণা করে ছিলেন। কেননা, ধান উৎপাদনের ঋতু হলো হেমন্ত। বর্ষার শেষে রোপিত ধানের জীবন চক্র সম্পন্ন হয়ে কার্তিকে তা হয়ে ওঠে পরিপক্ব। শরতে বেড়ে ওঠা ধান গাছ হেমন্তজুড়ে পক্বতা বেড়ে বেড়ে সংরক্ষণ করার উপযুক্ত হয়। বিদায়ী শরতের বাতাসে বাতাসে ঝরা কাশফুলের অংশগুলো যখন উড়তে থাকে বেখেয়ালে তখন বেড়ে ওঠা ধানের শীষে স্বপ্ন বাড়ায় কৃষকের চোখে। দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠে সবুজের সমারোহে ধানের ছড়ায় ছড়ায় নেচে ওঠে আশাবাদী কৃষকের পরিকল্পনা। সারা হেমন্তজুড়ে ধান পরিপক্ব হয়ে সবুজ থেকে সোনালি বর্ণ রূপান্তরের খেলায় চাষার মনে সুখ বৃদ্ধি করে রোজ। অবশেষে দেখা মেলে বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের সোনালি ফসল, সোনার ধান। চকচকে চোখে কৃষাণীর সামান্য বায়না মেটাতে আশায় বুক বাঁধে পরিশ্রমী কৃষক। আর ‘মরা’ কার্তিকের পরে আসে সেই শুভক্ষণ সর্বজনীন লৌকিক উৎসব ‘নবান্ন’। ‘নবান্ন’ অর্থ হলো ‘নব অন্ন’ বা ‘নতুন অন্ন’। এটি হলো বাংলার ঐতিহ্যবাহী ‘শস্যোৎসব’। অর্থাৎ নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে পাওয়া চালের প্রথম রান্না করা অন্ন। বাংলাদেশে কোনো কোনো অঞ্চলে নতুন চালে ফিরনি-পায়েস অথবা ক্ষীর তৈরি করে প্রতিবেশী আত্মীয়দের ঘরে ঘরে বিতরণ করে উৎসব আনন্দ উপভোগ করে।

নবান্ন পালনে ঘরে ঘরে আগমন ঘটে নিমন্ত্রিত ‘নাইওরি’ মেয়ে জামাইয়ের। এই নবান্ন আমাদের সংস্কৃতির অংশ বলে এ উৎসবে আয়োজন করা হতো আবহমান বাংলার পালাগান বিভিন্ন লোকসঙ্গীত, বাউল গান, লাঠিখেলা। আঞ্চলিক মেলায় থাকত নাগরদোলা, বাঁশি, কাচের চুড়ি আরো কত কী। সে কারণে নবান্ন উৎসব আমাদের ঐতিহ্যের অস্তিত্ব। সম্রাট আকবর তাই এ মাসকেই খাজনা তোলার মাস হিসেবে ঘোষণা করেন, যাতে এ মাসে কৃষকের সামান্য সমৃদ্ধিতে রাষ্ট্র পরিচালকের বাৎসরিক খাজনা থেকে দায়মুক্ত হতে পারে হতভাগা কৃষকের দল।
প্রতিটি ঋতুর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী হেমন্তের নির্মল মেঘমুক্ত আকাশে দেখা মেলে এক মন ভোলানো সৌন্দর্য। তাই বুঝি দিন-রাতের সন্ধিক্ষণে, গোধূলিলগ্নে অস্তমিত সূর্যের সৌন্দর্যময় আভা সন্ধ্যাকাশে ছড়িয়ে দেয় আলো আঁধারীর বিস্ময়কর রঙের খেলা। তখন পৃথিবী বক্ষে অবস্থিত ছোট্ট বাংলাদেশটি সগৌরবে টিকে রয় মাথা উঁচু করে। তাই দেখে মেঘমুক্ত আকাশের সামিয়ানা ভেদ করে রূপসী চাঁদ ঢেলে দেয় তার রূপালি জোৎস্নার জোয়ার। নরম প্রভাতে সবুজ ঘাসের ডগায় দেখা মেলে হালকা শিশিরবিন্দু। ঠিক যেন হীরক খচিত সবুজ গালিচা। আবছা কুয়াশার হালকা আবরণে আবৃত প্রকৃতি তখন হয়ে ওঠে মাধুর্যময়ী সৌন্দর্যের রানী। পড়ন্ত বিকেলে গাছিদের খেজুরের গাছ কাটার আয়োজনের টুকটাক শব্দ প্রকৃতিতে আনে মোহময় আচ্ছাদন। এত অপরূপ বলেই হেমন্তের শান্ত প্রকৃতি যুগ যুগ ধরে কবি-সাহিত্যকদের মোহিত করেছে বারবার। তাই রচিত হয়েছে হেমন্ত-বিষয়ক শত শত কাব্য ও রচনা। হেমন্তে ফোটা মল্লিকা, গন্ধরাজ, শিউলি, হিমঝুরি, কামিনী, বক ফুল, ছাতিম, অশোক, দেব কাঞ্চনের মতো ফুলের সমারোহ কবি-লেখকের মনকে করে আবেগাপ্লুত। তাই বুঝি হেমন্ত রচনার ভাণ্ডার এত মনোমুগ্ধকর। এ সময়ে পাওয়া চালতা, করমচা, নারিকেল, ডালিমের ছড়াছড়ি ঋতুটিকে করেছে আরো সমৃদ্ধ। হেমন্তের শেষ ভাগে শীত ঋতুর আগন্তুক অতিথি পাখিরা আগমন শুরু করে। তখন বাংলার বিলাঞ্চলে গড়ে উঠতে থাকে এসব পাখির অভয়ারণ্য।
অস্থির পৃথিবীর অধিবাসীদের অবাধ্যতায় সাম্প্রতিক জলবায়ুতে এসেছে বিরাট পরিবর্তন। তাই বিদ্রোহী আবহাওয়া ও জলবায়ুর প্রভাবে আজকাল টের পাওয়া যায় না আমাদের দেশের হেমন্ত ও বসন্ত নামের আবেগি ঋতুর দু’টির অস্তিত্ব। প্রকৃতির এ বিপর্যয় ঠেকাতে না পারলে হয়তো আমরা হারাতে পারি এ ঐতিহ্যবাহী হেমন্তকে। আর তার বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে আমাদের উৎপাদিত ফসলে। তাই রূপ লাবণ্য সম্পদে ভরা হেমন্তকে বাঁচাতে আমাদের সবাইকে হতে হবে সচেতন। অর্থবহুল, আলোচিত, আনন্দঘন ও জনপ্রিয় এ হেমন্ত ঋতুটি প্রকৃতি থেকে বিদায়কালে তার পদচিহ্নে এঁকে দিয়ে যায় শীতল কন্যা শীত ঋতুর প্রবেশের মেঠো পথ।


আরো সংবাদ



premium cement
গাজার যুদ্ধে ‘প্রকৃত বিরতির’ আহ্বান ব্লিংকেনের পার্লমেন্টে আস্থা ভোট দেবেন জার্মান চ্যান্সেলর বাতাসে কদবেলের ঘ্রাণ! জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু সম্মেলনে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা ইউক্রেনকে আরো সহায়তা দিতে ব্লিংকেনের প্রতিশ্রুতি ইমরানের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল পাকিস্তান হলের সিট বণ্টন নিয়ে উত্তপ্ত কুবি, প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবি করাচি থেকে প্রথম সরাসরি কার্গো পৌঁছেছে চট্টগ্রামে মুখরোচক খাবারে সরগরম লক্ষ্মীবাজারের স্ট্রিট ফুড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে ভারতের লাভ? মন্ত্রিসভায় চীন-পাকিস্তানবিরোধী ব্যক্তিরা! লড়াই করেও ভারতের কাছে হেরে গেল দ. আফ্রিকা

সকল