হতভাগিনী
- সাঈদুর রহমান লিটন
- ০১ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
আমার স্কুলের মাসুদ স্যার, একজন ধর্মভীরু মানুষ। এখন তার ধবধবে সাদা দাড়ি ও চুল। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরেন। দেখলে অনেকটা দরবেশ দরবেশ লাগে। খুব ভালো মনের মানুষ। উনার সাথে কথা বললে ভালো লাগে খুব। উনি আমার পাশের চেয়ার টেবিলে বসেন। ডায়াবেটিস রোগী। উনি প্রায়ই মুখে কিছু একটা চিবুতে থাকেন। আমিও কোন কোন সময় স্যারের সাথে শরীক হই।
সেদিন উনার নিজের ক্ষেতের শসা খাচ্ছিলেন। আমাকেও একটা দিলেন।
বললেন- সাঈদুর স্যার একটা গল্প বলি শোনেন। আমি বললাম- বলেন স্যার।
মাসুদ স্যার জিজ্ঞেস করলেন- স্যার আপনার কি মনে আছে, আমাদের নবম শ্রেণিতে একটা মেয়ে পড়তো। যার নাম সুমি। নবম শ্রেণিতে সবচেয়ে মেধাবী বালিকা ছিলো।
বললাম হ্যাঁ মনে আছে স্যার। দেখতে খুব সুন্দর ছিলো । নায়িকাদের মতো মনে হতো। কপালে কালো টীপ পরতো। আপনি টীপ পরার জন্য বকা দিতেন।
মাসুদ স্যার বললেন- এখন আর সুন্দর নেই। নায়িকা তো দূরের কথা একেবারে সাধারণ মেয়ের মতোও মনে হয় না।
বললাম কি হয়েছে ওর?
মাসুদ স্যার বললেন- ওর নবম শ্রেণির মাঝামাঝি বিয়ে হয়। আমরা সবাই বিয়ের জন্য বাধা দিয়েছিলাম। ওর মা-বাবার পিড়াপিড়িতে আমরা আর কিছু বলি নাই। আপনি সবই জানেন। ওর বিয়ে হয়েছে আমাদের গ্রামে। আমার গ্রামে বিয়ে হয়েছে আমি জানি না। জানলে ওর সাথে বিয়েটা হতে দিতাম না। যার সাথে বিয়ে হয়েছে, বেকার বাদাইমে। কাজ কর্ম কিছু করে না। দিন রাত তাস খেলে। নেশা করে।
টাকা পয়সা উড়ায়। একজন পুরোপুরি নেশাগ্রস্থ ছেলে। বছর দুই আগে দেখি আমাদের মসজিদ থেকে দূরে একটি মহিলা একটা গাছ ধরে কান্নাকাটি করছে। আমি কাছে যেতেই কান্না কণ্ঠে আমাকে সালাম দিলো। দেখে আমি অবাক! আমাদের সুমি। আমি বললাম সুমি এখানে কেন?
স্যার আমার এখানে মমিনের সাথে বিয়ে হয়েছে। মমিন আমাকে প্রায়ই মারে। আজও মেরেছে। আমার দুই মাসের বাচ্চা কান্নাকাটি করছে আমাকে বাড়ি যেতে দিচ্ছে না। আমি শুনে অবাক হলাম এত সুন্দর একটা মেয়ে এই ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছে। হায়রে কপাল!
আমি সুমিকে ওর বাড়িতে পৌছে দিয়ে এলাম। আর মমিন কে শাসিয়ে এলাম। ও আমার ছাত্রী।এরপর যদি কোন কষ্ট দাও তাহলে আমি কিন্তু তোমাকে ছাড় দিবো না।
মমিন আমাকে বললো- আর কোন দিন কষ্ট দিবো না স্যার।
মাসুদ স্যার গল্পটা বলার সময় অনেকটা ইমোশনাল হয়ে পড়ছেন। আমি আরো মনোযোগী হলাম গল্পটা শোনার জন্য। মাসুদ স্যার বললেন- আপনি তো সবই জানেন। নতুন করে বলার কিছু নাই। সুমি ভালো করে লেখাপড়া করলে বড় একটা অফিসার হওয়া সম্ভব ছিলো। আর যতটা সুন্দরী বা লাবণ্যময়ী তাতে যেকোন ভালো পাত্র পাওয়া যেতো।
সুমিকে দেখে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে।
মাসুদ স্যার এবার আরাম করে বসলেন। চোখে মুখে একটা ক্ষোভের ছাপ। ভরাট গলায় বললেন- এই মেয়ের বরের সাথে আমার বেশ কয়েকবার শালিসি করতে হয়েছে তারপর। মমিন প্রত্যেক বারই আমার পায়ে ধরে মাপ চেয়েছে । আর হবে না ওয়াদা করেছে। কিন্তু কোন বারই কথা রাখে নাই। সুমির শ্বশুর বাড়িতে অভাব অনটন লেগেই থাকে। আমি মাঝে মাঝে ওর বাড়ির খোঁজ খবর নেই। ওর বেবিটা খুব সুন্দর। মাঝে মাঝে ওকে খাওয়ানোর জন্য কিছু টাকা দিয়ে আসি। যার স্বামী কাজ করে না। তার দিন চলবে কীভাবে। অল্প বয়সি সুমির চোখে সর্বক্ষণ পানি থাকে। কিছুক্ষণ পরপর আঁচলে চোখ মোছে। সংসারের এ হেন অবস্থা দেখে আমার চাচাত ভায়ের বাসায় একটা ঝিয়ের কাজ ধরিয়ে দেই। যাতে অন্তত তিন বেলা ক্ষেতে পারে। আর কিছু টাকাও হয়। সুমি আমার প্রতি ভীষণ খুশি হয়েছিলো। আমাকে বলেছিলো- স্যার আপনি আমার জন্য বাবার চেয়েও বড় কিছু করেছেন। আপনি জানেন না স্যার আমি কতদিন পেট ভরে ভাত খাই না, বলে ফ্যাল ফ্যাল করে কেঁদে দিলো। খুব সুন্দর কাজ করছিলো সুমি। সবাই খুব প্রশংসা করছিলো। সুমি ও ভীষণ খুশি। বাচ্চা নিয়ে অন্তত তিন বেলা পেটপুরে খেতে পারে। খাওয়া, পরার সমস্যা নাই। কাপড় চোপড় আমার চাচাত ভায়ের ফ্যামিলি থেকেই দিচ্ছে। আবারও তালগোল পাকিয়ে ফেল সুমি। নতুন করে অন্তঃসত্ত্বা হলো। অন্তঃসত্ত্বার তিনচার মাস কাজ খুব ভালোই করছিল। পাঁচ মাসের মাথায় আর কাজ করতে পারছিল না। চাচাতো ভায়ের বাড়ি থেকে কাজে আসা বারণ করে দিলো। সুমির কপাল আবার অন্ধকারাচ্ছন্ন হলো। অভাব অনটনের মধ্যেই আরেকটি শিশু জন্ম নিল। সুমি নিজেই খেতে পায় না। শিশু খেতে পাবে কীভাবে। মা সন্তান অপুষ্টিতে কঙ্কাল সার হয়ে গেছে। দেখে চেনার উপায় নাই।
মাসুদ স্যারের চোখে পানি টলটল করছে। রুমাল দিয়ে চোখ মুছে নিলেন। টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে গিলে ফেললেন। আর আমাকে বললেন সাঈদুর স্যার, কয়েকদিন আগে সুমি আবার আমার কাছে এসেছিলো। এসে বললো- স্যার আমার ঘরে কোন খাবার নাই। আমার দুই সন্তান না খেয়ে আছে। আপনাদের জামাইকে মাদকের আসর থেকে কয়েকদিন হলো ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। স্যার আমি কি করব? আমি অনেকক্ষণ নীরবে বসে রইলাম। তারপর আমার গিন্নিকে ডাকলাম। বললাম- ওকে আজ থেকে আমার এখানেই রেখে দাও। ওরা তিন মায়ে ঝি আমার এখানেই খাবে। আর সুমি তোমার কাজ কর্ম করে দিবে। তুমি কি বলো।
আমার গিন্নি একটু দম নিয়ে বললো- ঠিক আছে তুমি যা ভালো মনে করো। আর সুমিকে বললাম- তোমাকে আরো নগদ পাঁচ হাজার টাকা দিবো সেই টাকা তুমি সঞ্চয় করবে বাচ্চাদের ভবিষ্যতে মানুষ করার জন্য। সুমি তখনো কাঁদছিল। আমার পায়ের পর উপুড় হয়ে পড়ে গেলো।
আর বললো- স্যার আপনি আপনার বাড়িতে আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন। তা না হলে আজ আমার আত্মহত্যা করে মরা ছাড়া কোন উপায় ছিলো না। আমি যেন মরার আগ পর্যন্ত আপনাদের সেবা করতে পারি সেই দোয়াই করবেন।
সুমি আর সুমির সন্তানেরা তখনো ক্ষুধার্ত ছিলো।আমার গিন্নি ওদের খাবার এনে দিল। বাচ্চারা আনন্দ সহকারে খাচ্ছিল। আর সুমি ভাতে হাত দিয়ে অঝর ধারায় চোখের পানি ফেলছিলো।
সুমির ছোট বাচ্চা এখনো ভাত মাছ খাওয়া শেখে নাই। মায়ের দুধ খায়। সুমি না খেয়ে থাকতে থাকতে বুকের দুধ শুকিয়ে গেছে। ফলে বাচ্চাটি দুধ পায় না। দেখতে শীর্ণকায় হয়ে গেছে। সুমি পাতের ভাত নরম করে কোলের বাচ্চাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। বাচ্চাটি খাওয়ার মত শক্তিও নাই মনে হলো। তবুও শিশুটি খাওয়ার চেষ্টা করছে। পেটে ক্ষুধা। বেঁচে থাকার জন্য সবাই খেতে চায়। শিশু, বৃদ্ধ, যুবক সবাই। শিশুটির খাওয়ার এই কষ্ট আমাকে বেদনাক্লিষ্ট করে তুলল। আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। আমি বাইকটি স্টার্ট দিয়ে মধুখালী থেকে একটা ল্যাকটোজেন ওয়ান এনে সুমি কে দিয়ে বললাম, এটা বাচ্চাদের দুধ। তুমি ওকে দুধ বানিয়ে খাওয়াও। সুমি আমার দিকে বিস্ময় চোখে তাকালো। সুমিকে অভয় দিলাম তুমি আর কোন কিছুর জন্য দুশ্চিন্তা করো না। তোমার যে কোন সমস্যা আমার কাছে বলো।
ওর দুধ ফুরিয়ে গেলে আমার কাছে জানিও আমি আবার এনে দিবো। সুমি কীভাবে দুধ বানাতে হয় ভালো মতো জানে না। আমার স্ত্রী বিষয়টি বুঝতে পেরে নিজেই তৈরি করে দুধ খাইয়ে দিলো।
আপনি তো জানেনই আপনার ভাবীও শিক্ষক।প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করে। তাই শিশুদের প্রতি তার অকৃত্রিম মায়া। সুমির সন্তান কে যখন বুকে নিয়েছে তখন সুমির আর ওকে নিয়ে ভাবতে হবে না।
সুমি শুধু বাসার কাজ গুলো গুছিয়ে করলেই হলো।
আমার খুব ভালো লাগলো স্ত্রীর এমন উদারতা দেখে। কয়জনই বা করে বাড়ির কাজের মেয়ের জন্য। আমি স্ত্রীকে ধন্যবাদ দিলাম। আমার স্ত্রী শিশুটিকে নিয়ে খেলাধুলা করতে লাগলো। ইতিমধ্যে একটা নামও দিয়ে দিলো। বেশ কয়েকমাস শিশুর বয়স। কেউ শিশুটির নাম রাখার কথা মনে করেনি। অবাক পৃথিবী, অবাক কর্মকা-। শিশুর নাম রাখলো আব্দুল্লাহ। সুমি নাম শুনে বেশ খুশি হয়ে গেলো। মনে খুশি নিয়ে থালা বাসন ধোয়ার কাজে চলে গেলো। আমার স্ত্রী বললো- আব্দুল্লাহর জন্য কিছু জামা কাপড় আনতে।
দেখলাম মাসুদ স্যারের চোখে কিছুটা শান্তির ঝিলিক ফুটে উঠেছে। আমি মনোযোগ সহকারে সুমির গল্পটি শুনছি। মাসুদ স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম- এখন তো তাহলে সুমি খুব ভালো আছে?
ভালোই ছিলো। ভালো ভাবে কাজ করছিলো। আপনার ভাবিও খুব প্রশংসা করছিলো, মেয়েটা খুব ভালো। যেমন ভালো কাজ করে, তেমন সুন্দর আচরণ। আর রান্না বাড়ার হাতও খুব পাকা। মেয়েটিকে বেশি ভালো লাগে পরিচ্ছন্নতায়। ও দারুণ পরিচ্ছন্ন একজন মানুষ। আর সৎ। সুমিকে একজন সচ্চরিত্রবতী মেয়ে বলা যায়।
আর এমন একজন মেয়ের কপালে জুটেছে এমন একজন বাঁদর।
সেদিন আমি আর আপনার ভাবি স্কুলে চলে গেলাম।
হাজত থেকে ছাড়া পেয়ে বাঁদরটি আমার বাসায় গিয়ে সুমির কাছে টাকা চাইলো। সুমি টাকা দিবে কোত্থেকে? সুমিকে আমি এখনো টাকা দেইনি। সুমি বলে আমার কাছে তো টাকা নাই আমি কোথায় থেকে দেব?
মমিন বলে আমাকে দিতেই হবে। সুমি যখন একেবারেই দিতে পারবে না জানায়! অমনি রোদে শুকাতে দেয়া কাঁচা ডাল দিয়ে অমানুষের মতো মারতেছিলো। ভাগ্য ভালো আমি ঐ সময় ফিরলাম। মেয়েটা, আর বাচ্চারা ভয়ে চিৎকার করছিলো। সুমির পুরো শরীর কেটে গেছে। রক্ত জমে গেছে শরীরের বিভিন্ন অংশে। অমানুষ কাকে বলে মমিনকে দেখলে বোঝা যায়। তখন আপনার ভাবি ফেরে নাই। আমি মমিনকে ধরে বেঁধে রাখলাম। ডাক্তারকে ফোন করলাম সুমিকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য। ডাক্তার এসে ট্রিটম্যান্ট দিলো। বললো- কোন জানোয়ারও তো মানুষকে এমন মারে না।
আপনার ভাবি আসলো। ও এসে অবস্থা দেখে পুলিশকে ফোন করলো। যদিও আমি পুলিশে খবর দেওয়ার পক্ষে ছিলাম না। খবর পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এলো।
আমার স্ত্রীকে দেখলাম রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে। আমার স্ত্রী যে এতটা প্রতিবাদী হতে পারে আজ দেখলাম।
পুলিশ হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো নেশাখোরটিকে। এসময় আমাকে এবং আমার স্ত্রীকে অবাক করে দিলো সুমি। ও পুলিশের পা জড়িয়ে বললো- স্যার, ওকে নিয়ে যাবেন না স্যার। ওরে এবারের মতো মাফ করে দেন। স্যার আমি আপনার পায়ে পড়ছি। পুলিশ আমার দিকে তাকালো। আমি আমার স্ত্রীর দিকে তাকালাম। দেখলাম ওর চেহারায় আগের সেই রাগ নেই। ধীর কণ্ঠে বললো- ঠিক আছে পুলিশ ভাই রেখে যান। নারীরা স্বামীর কষ্ট সহ্য করতে পারে না। সুমি ও একজন নারী। সুমি কীভাবে তার স্বামীকে নিয়ে যেতে দেবে? আর মমিন কে বললো- দেখ তুই কাকে মেরেছিস? যে তোর জন্য পুলিশের পায়ে পড়ছে। যাতে তোর হাজতে যেতে না হয়।
পুলিশ চলে গেলো। যাওয়ার সময় বলে গেলো
দ্বিতীয়বার এরকম করলে ডাইরেক লাল দালানের ভাত খাইয়ে ছাড়বো। তখনও সুমি মমিনের হাত ধরে কাঁদছিলো।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা