২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

পরিপূর্ণ মুমিন মুসলিম কেন হবো

-

(ষষ্ঠাংশ)
ইতোপূর্বে আমরা সূরা মুমিনুনের ১ থেকে ৯ নম্বর আয়াত আলোচনা করেছি। ১০ ও ১১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন-‘তারাই হবে উত্তরাধিকারী, যারা উত্তরাধিকারী হবেন জান্নাতুল ফিরদাউসের, যাতে তারা চিরদিন বাস করবে, যার শুরু আছে শেষ নেই।’ (সূরা মুমিনুন : ১০-১১) অকল্পনীয় ও অতুলনীয় বিষয় বটে চরম পরম সফলতার দিক থেকে। লক্ষণীয়, এ দুটি আয়াতে আল্লাহ পরিপূর্ণ মুমিন মুসলিমদের জান্নাতুল ফিরদাউস পাওয়ার সুসংবাদ দান করেছেন। অতিশয় উঁচু মানের সুসংবাদ কাকে বলে! সফল মুমিনদের বৈশিষ্ট্য আল্লাহ বলেছেন সূরা মুমিনুনের একটানা ১ থেকে ১১টি আয়াতে যা পরিপূর্ণ ঈমানের মর্যাদা, তাৎপর্য এবং গুরুত্বের সাক্ষর বহন করে। উপরোল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা মুমিন মুসলিমদের অবশ্যই স্মরণীয়, করণীয় এবং বর্জনীয় ক্ষেত্রবিশেষে যথাযথভাবে। উপরোক্ত আয়াতগুলোতে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলো যথাযথভাবে অর্জন করার সৌভাগ্য যাদের হবে তারা হবেন ইনশাআল্লাহ জান্নাতুল ফিরদাউসে সীমাহীন শক্তিধর ও দয়ালু আল্লাহর মেহমান। পরিপূর্ণ ঈমান যেকোনো মুমিনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ, ফলে তিনি হবেন আল্লাহর প্রিয়তম গোলাম পার্থিব জীবনে এবং অতি সম্মানিত মেহমান পরলৌকিক জীবনে। হে আল্লাহ! দয়া করে আপনার গোলামদের পরিপূর্ণ মুমিন হওয়ার তৌফিক দান করুন, আমিন।
ঈমান নিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ৩০ পারা কুরআনে অসংখ্য বাণী দিয়েছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রসঙ্গক্রমে। আমি সম্মানিত পাঠক ভাই ও বোনদের খিদমতে পেশ করতে যথাসাধ্য ইনশা আল্লাহ চেষ্টা করব ঈমান-সংক্রান্ত আয়াতগুলো প্রয়োজনে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ, যা আল্লাহর নাম নিয়ে নি¤েœ শুরু করছি :
১. আল্লাহর বাণী- ‘সুতরাং যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে, সে যেন এমন এক মজবুত রশি আঁকড়ে ধরল, যা কখনো ছিঁড়বে না।’ (সূরা বাকারা- ২৫৬)
ঈমান আনা সম্ভব হবে সে ব্যক্তির দ্বারা যে চিরশত্রু এবং প্ররোচনাদাতা শয়তান বা তাগুতকে পরাস্ত করতে পারে। যার ইঙ্গিত আল্লাহ এ আয়াতে দিয়েছেন এবং ঈমান আনার উপমাটি দিলেন এমন একটি মজবুত রশির, যা কস্মিনকালেও ছিঁড়বে না অর্থাৎ সত্যিকার মুমিন ঈমানহারা হবেন না, শয়তান তাকে পরাভূত করতে পারবে না।
২. আল্লাহর বাণী- ‘যারা শাশ্বত বাণীর প্রতি ঈমান এনেছে, আল্লাহ তাদের দুনিয়ার জীবনে ও আখিরাতে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন এবং জালিমদেরকে বিভ্রান্তিতে রাখবেন। আর আল্লাহ যা ইচ্ছা তা-ই করেন।’ (সূরা ইবরাহিম-২৭) লক্ষণীয়, আল্লাহর কত চমৎকার ঘোষণা যে, মুমিনরা উভয় জীবনে বা উভয়কালে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে অর্থাৎ সুখ শান্তি ভরা জীবন এবং প্রশান্তিভরা মন ইহকালে। অতুলনীয় এবং সার্বক্ষণিক ভোগ-বিলাস, সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ, যা মন চাবে তা-ই পাবে এবং যা উচ্চারণ করা হবে তা-ই হাজির হবে তৎক্ষণাৎ বা যথাসময়ে, যথা থাকবে না কোনো অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-ব্যথা-বেদনা, বালা-মুসিবত, দুশ্চিন্তা- দুর্ভাবনা, রোগ-শোক ইত্যাদি চিরকালের জন্য পারলৌকিক জীবনে জান্নাতে বসবাসরত অবস্থায়। আল্লাহর আলোচ্য ঘোষণায় কারো যেন সন্দেহের অবকাশ না আসে সে জন্য আল্লাহ আমাদেরকে জানিয়ে দিলেন আল্লাহর সীমাহীন ক্ষমতার সংবাদ অর্থাৎ তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন তৎক্ষণাৎ বা যথাসময়ে, শুধু আল্লাহকে আদেশ করতে হবে ‘কুন’ ‘হয়ে যাও’ ‘ফাইয়াকুন’, (তৎক্ষণাৎ বা যথাসময়ে) তা হয়ে যায়। প্রমাণ আল্লাহর বাণী- ‘তাঁর (আল্লাহর) ব্যাপার শুধু এই যে, তিনি (আল্লাহ) যখন কোনো কিছুর ইচ্ছা করেন, তিনি (আল্লাহ) বলেন, ‘হও’, ফলে তা হয়ে যায়।’ (সূরা ইয়াসিন-৮২) প্রসঙ্গত একটি বাস্তব উদাহরণ আল্লাহর ‘কুন’ ব্যবহারের। প্রমাণ আল্লাহর বাণী- ‘ইয়া নারু কুনঈ বারদাঁও ওয়া সালামান আলা ইবরাহিম।’ অর্থ- ‘হে আগুন (নমরুদ বাহিনী কর্তৃক দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টাপ্রসূত অকল্পনীয় উত্তপ্ত অগ্নিকুণ্ড)! তুমি ইবরাহিমের জন্য আরামদায়ক শীতল হয়ে যাও।’ (সূরা আল আম্বিয়া-৬৯) আল্লাহর এ আদেশ পাওয়া মাত্র ভয়াবহ অকল্পনীয় অগ্নিকুণ্ড তৎক্ষণাৎ দাহনশক্তি হারিয়ে আরামদায়ক শীতল হয়ে গেল ইবরাহিম আ:-এর জন্য এবং প্রমাণিত হলো- আল্লাহর আদেশ ‘কুন’-এর তৎক্ষণাৎ বাস্তবায়ন।
৩. আল্লাহর বাণী-‘হে মুমিনগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন বাণিজ্যের সন্ধান দেবো, যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে রক্ষা করবে? (তা এই যে) তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি (ঈমান) বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং তোমাদের ধনসম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। এটিই তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা জানতে!’ (সূরা সাফ : ১০-১১) লক্ষণীয়, পরিপূর্ণ ঈমানের উপকারিতা আল্লাহ তায়ালার বর্ণনা বৈচিত্র্য যথা- পরিপূর্ণ ঈমান এবং জানমাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করা, মহা সফল বাণিজ্য যার মুনাফা জান্নাত লাভ এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি। ৪. আল্লাহর বাণী- ‘যদি জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত ও তাকওয়া অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের জন্য আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর কল্যাণ উন্মুক্ত করে দিতাম, কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। ফলে তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের জন্য পাকড়াও করেছি।’ (সূরা আরাফ-৯৬) আলোচ্য আয়াতে আল্লাহর ভাষাগুলো বিশেষভাবে লক্ষণীয়, আল্লাহ হতে যারা উদাসীন তাদের জন্য। ঈমান আনা ও আল্লাহর দাসত্ব করার সুফল কী হতো তা আল্লাহ স্পষ্ট বলে দিয়েছেন অর্থাৎ তারা ভোগ করত আসমান-জমিনের নিয়ামত ও বরকত পার্থিব জীবনে। আসমানের নিয়ামত ও বরকত অপরিসীম যথা- রৌদ্র, চন্দ্রালো, বৃষ্টিপাত ইত্যাদি। পক্ষান্তরে জমিনের নিয়ামত বরকত অপরিসীম যথা- মাটি, ফসল, গবাদিপশু, বন্যপশু, সামুদ্রিক মাছ, পানি যার অপর নাম জীবন, বৃক্ষরাজি, ফল-ফলাদি, রাস্তাঘাট, হাঁটবাজার, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদরাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কবরস্থান, সাগর-মহাসাগর, নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত, জলাশয় ইত্যাদি। শুয়াইব আ:-এর উম্মতরা ছিলেন মাদইয়ানবাসী যাদের অসৎকর্মের তিরস্কার আল্লাহ নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হওয়া, আল্লাহ অবাধ্যতার কারণে যা আলোচ্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। অবশেষে তারা ভূমিকম্পে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করল। প্রমাণ আল্লাহর বাণী- ‘কিন্তু তারা (মাদইয়ানবাসী) তাঁর (শুয়াইব আ:) প্রতি মিথ্যারোপ করল, এরপর তারা ভূমিকম্পে আক্রান্ত হলো। ফলে তারা নিজ নিজ গৃহে নতজানু অবস্থায় শেষ হয়ে গেল (মৃত্যুবরণ করল, ফলে বঞ্চিত হলো আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর কল্যাণ থেকে)।’ (সূরা আনকাবুত-৩৭) আলোচ্য আল্লাহর বাণীতে চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত মুমিন না হওয়ার করুণ পরিণতি। বর্তমান বিশ্ববাসীর অধিকাংশই পরিপূর্ণ বা আদৌ মুমিন মুসলিম নয়। ফলে আলোচ্য আয়াতের আলোকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে আল্লাহর নিয়ামত ও বরকত থেকে। ফলে তাদেরই কার্যকলাপে সৃষ্টি হচ্ছে বিশ্ব বা আঞ্চলিক অশান্তি, অরাজকতা, অভাব-অনটন, দুর্ভোগ ইত্যাদি।
৫. আল্লাহর বাণী- ‘তোমরা যদি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর এবং ঈমান আনো, তবে তোমাদেরকে শাস্তি দেয়াতে আল্লাহর কী লাভ? আর আল্লাহ তো পুরস্কারদাতা ও সর্বজ্ঞ।’ (সূরা নিসা-১৪৭) আলোচ্য আল্লাহর বাণীতে বিশেষ করে ‘তবে তোমাদেরকে শাস্তি দেয়াতে আল্লাহর কী লাভ?’ আমাদের জন্য বিশেষভাবে শিক্ষণীয় নয় কি? আল্লাহর এ প্রশ্নের উত্তরে আমাদের জবাব হবে ‘হে মহান দয়ালু আল্লাহ! আমাদেরকে শাস্তি দিয়ে তোমার কোনো লাভ নেই; বরং হতে পারো তুমি ব্যথিত কারণ আমরা তোমারই সৃষ্ট মানুষ এবং তুমি আমাদের স্রষ্টা ও কল্যাণকামী নিঃসন্দেহে- তাই তুমি প্রেরণ করেছিলে মানবজাতির জন্য অসংখ্য নবী-রাসূল তোমার বাণীসহ সঠিক পথপ্রদর্শক হিসেবে। কিন্তু আমরা উদাসীন মানুষরা শয়তানের প্ররোচনায় প্ররোচিত হয়ে তোমার প্রদর্শিত সঠিক পথের পথিক হতে পারলাম না; বরং শিকার হলাম মোহময়-ধোঁকাবাজ পৃথিবীর ধোঁকা ও প্রবঞ্চনার। ফলে চালিত হলাম, জীবন কাটালাম ভ্রান্তপথে এমনকি কর্ণপাত করলাম না আলেমদের বক্তব্যে।’ সম্মানিত পাঠক ভাই ও বোন আসুন আমরা আল্লাহর উপরোক্ত কয়েকটি বাণী মনেপ্রাণে ধারণ করি, আঁকড়ে ধরি উভয়জগতের কল্যাণের স্বার্থে, কুরআন আমাদের পথপ্রদর্শক বা হেদায়েত, যথাসাধ্য আমরা কুরআনের কাছে আসি সরাসরি বা আলেমদের ওয়াজ নসিহতের মাধ্যমে। তা ছাড়া অন্যান্য দোয়ার সাথে একটি বিশেষ দোয়া বিনীতভাবে সজল নয়নে, সম্ভব হলে সেজদারত হয়ে আল্লাহর মহান দরবারে সর্বোচ্চ সংখ্যক করতে থাকি। দয়ালু আল্লাহ যদি দয়া করে আমাদের দোয়াটি কবুল করেন তাহলে ইনশাআল্লাহ আমরা মহা সফল হবো ইহকালে ও পরকালে। দোয়াটি কুরআনের শুরুতে ‘সূরা ফাতেহার শেষাংশে আল্লাহ আমাদেরকে শিখিয়েছেন যথা- ‘ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকিম’ থেকে ‘ওয়ালাদ দুয়াল্লিন’ পর্যন্ত যার অর্থ- ‘হে আল্লাহ! আমাদেরকে সরল সঠিক পথ প্রদর্শন করুন। তাঁদের পথ, যাদেরকে আপনি পুরস্কৃত করেছেন (যারা হলেন নবী, সিদ্দিক, শহীদ, সালেহ বা সৎকর্মশীল)। তাদের পথ নয়, যাদেরকে আপনি তিরস্কৃত বা গজবপ্রাপ্ত করেছেন বা যারা পথভ্রষ্ট, আমিন।’ সালাতে বা অন্যত্র সূরা ফাতেহা শেষ হলে আমরা উচ্চারণ করি ‘আমিন’ অর্থাৎ- হে আল্লাহ দয়া করে আপনি আমাদের দোয়াটি কবুল করুন। দোয়াটি এতখানি গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ যে কারণে আমি একটু সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা না দিয়ে পারলাম না। ‘সিরাতাল মুস্তাকিম’ মানে সঠিক পথ যা গন্তব্যে পৌঁছায়। রাসূল সা:-কে আল্লাহ্ সার্টিফিকেট দিয়েছেন ‘ইন্নাকা লা মিনাল মুরসালিন। আলা সিরাতিম মুস্তাকিম। (সূরা ইয়াসিন : ৩-৪) ‘আন আমতা আলাইহিম’ অর্থ- ‘যাদের উপর তোমার নিয়ামত বর্ষিত হয়েছে। নিয়ামতপ্রাপ্ত হয়েছেন নবী-রাসূল সিদ্দিক শহীদ ও সৎকর্মশীলরা।’ আমরা যদি আমাদের দোয়া কবুল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহর নিয়ামতপ্রাপ্ত হই তাহলে আমরা অন্তর্ভুক্ত হবো সৎকর্মশীলদের দলে। এ দোয়াটি যদি আল্লাহ মেহেরবানি করে কবুল করেন তাহলে আমরা ইনশাআল্লাহ হবো জান্নাতবাসী। হে আল্লাহ! দয়া করে আপনার গোলামদের তাওফিক দিন পরিপূর্ণ মুমিন মুসলিম হয়ে জান্নাতবাসী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করার। আমিন।
লেখক : সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ


আরো সংবাদ



premium cement