১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

ইসলামে অসহায়, দুর্গত মানুষের সহযোগিতা ও রিয়া

-


মহান আল্লাহ তায়ালা মাঝে মধ্যে তার বান্দাদের পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন ধরনের বালা-মুসিবত দেন। তার মধ্যে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো মুসিবতের কাছে মানুষ অসহায়। এসব দুর্যোগের শিকার হয়ে কেউ আঘাতপ্রাপ্ত বা চরম অসুস্থ হয়ে পড়েন, আবার কেউ মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। হাদিসের আলোকে কেউ শাহাদাতবরণ করেন।
আল্লাহ তায়ালা এ সব বিষয় মুমিনের জন্য পরীক্ষা হিসেবে বিবেচনা করেছেন সেই সাথে এই পরীক্ষায় ধৈর্যধারণকারীদের সুসংবাদ দিয়েছেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে কিছু ভয় ও ক্ষুধা দ্বারা এবং কিছু ধনপ্রাণ এবং ফলের (ফসলের) লোকসান দ্বারা পরীক্ষা করব; আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।’ (সূরা আল-বাকারাহ-১৫৫)

আর মুমিনরাও এটিকে পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করে। যেমন- আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের সম্পর্কে বলেন- ‘যারা তাদের ওপর বিপদ এলে বলে, আমরা তো আল্লাহরই। আর নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী।’ (সূরা আল-বাকারাহ-২৫৪)
এমন অসহায়দের সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসা একদিকে শ্রেষ্ঠতম ইবাদত, অন্যদিকে ঈমানি দায়িত্ব।
ইসলাম সব সময় ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেয়। দুর্গত, অসহায় অসচ্ছল মানুষের সেবায় এগিয়ে আসা ইসলামে অন্যতম ইবাদত। আল্লাহ যাকে অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন তিনি সে সম্পদ থেকে অভাবী মানুষকে সাহায্য করলে তাতে আল্লাহ তায়ালা খুশি হন। এ ধরনের মানবিক কর্তব্য পালন রাত জেগে অবিরাম নফল নামাজ আদায় ও অবিরত নফল রোজার সমতুল্য।
আর এই বিপদের সময় দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ইসলাম নির্দেশনা দিয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা আল-মাউনের মধ্যে অসহায়কে সাহায্য না করা আখিরাতের প্রতি অবিশ্বাসকারীদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘১. আপনি কি দেখেছেন তাকে, যে দ্বীনকে অস্বীকার করে?; ২. সে তো ওই ব্যক্তি, যে পিতৃহীনকে (এতিম) রূঢ়ভাবে তাড়িয়ে দেয়; ৩. এবং সে অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদানে উৎসাহ প্রদান করে না।’ (সূরা আল-মাউন : ১-৩)

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- ‘তাদের ধন-সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতের হক।’ (সূরা আজ জারিয়াত-১৯)
যারা নিকটাত্মীয় প্রতিবেশীদের সাথে সদ্ব্যবহার করে না আল্লাহ তায়ালা তাদের সম্পর্কে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন- ‘এবং তোমরা আল্লাহরই ইবাদাত করো এবং তাঁর সাথে কোনো বিষয়ে অংশী স্থাপন করো না এবং মা-বাবার সাথে সদ্ব্যবহার করো এবং আত্মীয়স্বজন, পিতৃহীন, দরিদ্র, সম্পর্কবিহীন প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সহচর ও পথিক এবং তোমাদের দাস-দাসীদের সাথেও সদ্ব্যবহার করো; নিশ্চয়ই আল্লাহ অহঙ্কারী আত্মাভিমানীকে ভালো বাসেন না।’ (সূরা আন নিসা-৩৬)
এই আয়াতের ব্যাখ্যা করলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে যাবে। এখানে সব আত্মীয়স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করার তাকিদ দেয়া হয়েছে। কুরআনুল কারিমের প্রসিদ্ধ এক আয়াতে বিষয়টি এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যা রাসূল সা: প্রায়ই বিভিন্ন ভাষণের পর তিলাওয়াত করতেন। তা হলো- ‘আল্লাহ সবার সাথে ন্যায় ও সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিচ্ছেন এবং নির্দেশ দিচ্ছেন আত্মীয়স্বজনের হক আদায় করার জন্য।’ (সূরা আন-নাহ-৯০) এতে সামর্থ্যানুযায়ী আত্মীয়-আপনজনদের কায়িক ও আর্থিক সেবা-যত্ন করা, তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা এবং তাদের খবরা-খবর নেয়াও অন্তর্ভুক্ত। রাসূল সা: বলেছেন, ‘সদকার মাল সাধারণ গরিব-মিসকিনকে দান করলে তাতে তো শুধু সদকার সওয়াবই পাওয়া যায়, অথচ তা যদি নিজের রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়-আপনজনকে দান করা হয়, তাহলে তাতে দু’টি সওয়াব পাওয়া যায়। একটি হলো- সদকার সওয়াব এবং আরেকটি হলো- সেলায়ে-রেহমির সওয়াব।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৪/২১৪, নাসায়ি-২৫৮২) অর্থাৎ আত্মীয়তার হক আদায় করার সওয়াব।
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এই কাজকে তার রহমত পাওয়ার মাধ্যম বলেছেন- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রহমত ইহসানকারীদের (অনুগ্রহশীল) নিকটবর্তী।’ (সূরা আরাফ-৫৬)

হাদিসের মধ্যে রাসূল সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা দয়ালুদের প্রতি দয়া করেন। তোমরা জমিনে যারা বসবাস করছে তাদের প্রতি দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’ (আবু দাউদ-৪৯৪১)
অন্য হাদিসে এসেছে, নুমান ইবনু বশির রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘সব মুসলিম একজন ব্যক্তির সমতুল্য। যদি তার চক্ষু পীড়িত হয় তবে তার পুরো দেহ পীড়িত হয়ে পড়ে। যদি তার মাথা আক্রান্ত হয় তাহলে পুরো শরীরই আক্রান্ত হয়ে পড়ে।’ (মুসলিম-২৫৮৬)
আবু সাইদ খুদরি রা: বলেন, হুজুর সা: বলেছেন, ‘কোনো মুসলমান অপর মুসলমানকে বস্ত্রহীনতায় বস্ত্র দিলে আল্লাহপাক তাকে জান্নাতের সবুজ বস্ত্র পরাবেন।’ (তিরমিজি-২৮৩৫)
মহানবী সা: বলেন, ‘যে মুসলমান অপর কোনো মুসলমানকে বস্ত্রহীন অবস্থায় বস্ত্র দান করবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে সবুজ বর্ণের পোশাক পরাবেন, খাদ্য দান করলে তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন, পানি পান করালে জান্নাতের শরবত পান করাবেন।’ (আবু দাউদ-১৭৫২)
এ ছাড়াও আরো অসংখ্য আয়াত ও হাদিসের মাধ্যমে আমরা অসহায় ও দুর্গত মানুষের সাহায্যের নির্দেশনা পেয়ে থাকি।
যেমন- প্রসিদ্ধ হাদিস, এক মুসলিমের ওপর অপর মুসলিমের ছয়টি হক এবং এক ব্যক্তির ওপর অপর ব্যক্তির আটটি হক। এ হাদিসগুলোতেও অসহায়দের প্রতি সাহায্যের নির্দেশনা পাওয়া যায়।

তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা বন্যায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের সহযোগিতা করা মুমিনের ঈমানি দায়িত্ব। সেক্ষেত্রে কোনোভাবে লৌকিকতা তথা প্রদর্শনেচ্ছা থাকা যাবে না। কেননা, এটি মুমিনের ইবাদত ধ্বংস করে জাহান্নামি বানানোর জন্য শয়তানের অন্যতম ফাঁদ।
কুরআন-হাদিসে রিয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। এটি মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য। রিয়াকারী শুধু লোক দেখানোর জন্যই ইবাদত করে। এ জন্য তারা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে কোনো পুরস্কার পাবে না।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘আর সেসব লোককেও আল্লাহ পছন্দ করেন না, যারা মানুষকে দেখানোর জন্য নিজেদের ধন-সম্পদ খরচ করে এবং আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের উপর বিশ্বাস রাখে না। শয়তান কারো সঙ্গী হলে সে সঙ্গী কতই না জঘন্য!’ (সূরা আন নিসা-৩৮)
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘নিশ্চয় মুনাফিকরা আল্লাহর সাথে ধোঁকাবাজি করে, তিনি তাদের ধোঁকায় ফেলে শাস্তি দেন এবং তারা যখন সালাতের জন্য দাঁড়ায়, তখন শৈথিল্যভরে দাঁড়ায়, লোক দেখানোর জন্য, তারা আল্লাহকে সামান্যই স্মরণ করে।’ (সূরা আন নিসা-১৪২)
রাসূল সা:-এর ‘সবার আগে তিন ব্যক্তিকে জাহান্নামে পাঠানো হবে’ সম্পর্কিত হাদিসখানা এ বিষয়ে আরো সুন্দর ব্যাখ্যা দেয়। (হাদিসের অংশ)
আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- কিয়ামতের দিন একজন দানবীরকে উপস্থিত করা হবে। তাকে দেয়া সম্পদ দেখিয়ে আল্লাহ বলবেন- ‘এসব নিয়ামতের পরিপ্রেক্ষিতে তুমি কী করেছ?’ সে উত্তর দেবে, ‘আমি আপনার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এ সম্পদগুলো আপনার পথে ব্যয় করেছি।’ তখন আল্লাহ বলবেন- ‘তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি দান করেছ যাতে লোকে তোমাকে দানবীর বলে। তুমি সেটি দুনিয়ায় পেয়ে গেছ। সে কারণে এখানে তোমার কোনো প্রাপ্য নেই।’ তাকেও জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সুনানে তিরমিজি-২৩৮২)
সুতরাং লৌকিকতামুক্ত ইবাদতের (আর্থিক ও কায়িক পরিশ্রম) মাধ্যমে বন্যার্ত ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আল্লাহর রহমত তালাশ করা ঈমানের দাবি।
লেখক : প্রভাষক, মাইলস্টোন কলেজ, উত্তরা, ঢাকা

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement
ইউনূসের সাথে সাক্ষাত হচ্ছে না মোদির লেবাননে পেজারের পর ওয়াকি-টকি বিস্ফোরণে নিহত ২০, আহত ৪৫০ আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ গ্রেফতার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজায় আসলে কী হয়েছিল? মেয়াদবিহীন ইন্টারনেট প্যাকেজ চালু করুন : তথ্য উপদেষ্টা বহিরাগতমুক্ত ক্যাম্পাস গড়তে ঢাবিতে নামবে ‘মোবাইল কোর্ট’ পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কোন্নয়ন প্রচেষ্টায় নজর ভারতের এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে রিট নাটোরে গৃহবধূকে গণধর্ষণের অভিযোগে যুবদল নেতাসহ গ্রেফতার ৬ বহিরাগতমুক্ত ক্যাম্পাস গড়তে ঢাবিতে নামবে ‘মোবাইল কোর্ট’ ভিসা সমস্যার সমাধানে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা মার্চেন্ট শিপিং ফেডারেশনের

সকল