১৮ অক্টোবর ২০২৪, ২ কার্তিক ১৪৩০, ১৪ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

হিজরি বর্ষের তাৎপর্য ও শিক্ষা

-

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। মুসলিম উম্মাহর সংস্কৃতি ও মুসলমানদের জীবনে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামের বিধিবিধান হিজরি সন ও চান্দ্র তারিখের সাথে সম্পর্কিত হওয়ায় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসবসহ সব ক্ষেত্রেই হিজরি সনের ওপর নির্ভরশীল আমরা।

সময়ের সমষ্টিই মানবজীবন বা আয়ু। তিলে তিলে মানুষের আয়ু ক্ষয় হয়। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়; মানুষ তার জীবনের পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টির সময় তার আয়ু নির্ধারিত করে দেন। তিনি আয়ু বাড়াতে ও কমাতে পারেন। নেক আমল, দান-খয়রাত, মা-বাবার খেদমত এবং আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর সেবা আয়ু বৃদ্ধির কারণ হয়।

আল্লাহ তায়ালা সময়কে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহারোপযোগী করে প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন- দিন-রাত, মাস-বছর ইত্যাদি। বছরকে আমরা সাল বা সন বলি। সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর আবর্তনের সময়কালকে সৌরবর্ষ এবং পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের আবর্তনের সময়কালকে চান্দ্রবর্ষ বলা হয়। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর হিজরতের বছরকে ইসলামী সন গণনার প্রথম বছর ধরা হয়েছে বলে এটি হিজরি সন নামে পরিচিত। হিজরি সন চান্দ্রবর্ষ ও সৌরবর্ষ উভয় হিসেবে গণনা করা হয়। সৌরবর্ষে ৩৬৫ ও ৩৬৬ দিনে বছর হয়, চান্দ্রবর্ষে ৩৫৪ ও ৩৫৫ দিনে বছর হয়। ইসলামী শরিয়তের ফিকহি বিধানগুলোতে বছর বলতে চান্দ্রবর্ষকেই বোঝানো হয়।

মহররম : মহান আল্লাহর নির্ধারিত সম্মানিত মাস এবং হিজরি বর্ষের প্রথম মাস। হিজরি বর্ষের সর্বপ্রথম মাস-মুহাররামুল হারাম তথা মুহাররম মাস। হাদিসের ভাষায়- শাহরুল্লাল মুহাররাম। আল্লাহ তায়ালা বছরের যে ক’টি মাসকে বিশেষ মর্যাদায় মহিমান্বিত করেছেন মহররম তার অন্যতম। পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আল্লাহ যেদিন আসমান জমিন সৃষ্টি করেছেন সেদিন থেকেই মাসগুলোর গণনা আল্লাহ তায়ালার বিধান মতে ১২টি। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। এটিই সহজ-সরল দ্বীন (এর দাবি) অতএব তোমরা এসব দিনে নিজের উপর জুলুম করো না। (সূরা তাওবা-৯ : ৩৬)

এ চার মাস কী কী? হাদিস শরিফে তা বলে দেয়া হয়েছে। নবী কারিম সা: বলেন, ‘সময়ের হিসাব যথাস্থানে ফিরে এসেছে, আসমান-জমিনের সৃষ্টির সময় যেমন ছিল। (কারণ, জাহেলি যুগে আরবরা নিজেদের স্বার্থ ও মর্জিমতো মাস-বছরের হিসাব কমবেশি ও আগপিছ করে রেখেছিল।) ১২ মাসে এক বছর। এর মধ্য থেকে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি মাস ধারাবাহিক- জিলকদ, জিলহজ ও মহররম। আরেকটি হলো রজব, যা জমাদিউল আখিরাহ ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস।’ (বুখারি-৪৬৬২, মুসলিম-১১৬৩)

আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘(রমজানের পর) শ্রেষ্ঠ মাস হচ্ছে আল্লাহর মাস, যাকে তোমরা মুহাররম বলে থাকো।’ (সুনানে কুবরা, নাসায়ি-৪২১৬)
প্রকৃতপক্ষে সব মাসই তো আল্লাহর মাস। তথাপি এ মাসকে বিশেষভাবে ‘আল্লাহর মাস’ বলে ব্যক্ত করার মধ্যে রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য। যেমন পৃথিবীর সব মসজিদই আল্লাহর ঘর। কিন্তু কাবা শরিফকে বিশেষভাবে বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর বলার হেকমত কী? কারণ এর রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। তেমনি বছরের অন্যান্য মাস অপেক্ষা মহররমের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব।

আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজিদে হিজরি সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন- ‘লোকেরা আপনার কাছে নতুন চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আপনি তাদের বলে দিন, এটি মানুষের (বিভিন্ন কাজকর্মের) হিসাব এবং হজের সময় নির্ধারণ করার জন্য।’ (সূরা বাকারা-২ : ১৮৯)
মুসলমানদের বহু দ্বীনী বিষয়, বিশেষ করে হজের মতো মহিমান্বিত আমল নির্ভরশীল চাঁদের হিসাবের উপর। আরবি মাস-বছরকে ঘিরে ইসলামের বহু বিধান আবর্তিত হয়। এই আরবি হিজরি চান্দ্রবর্ষের প্রথম মাসটিই হচ্ছে মুহাররম। মুহাররমকে ঘিরেও রয়েছে শরিয়তের সুন্দর সুন্দর বিধান ও আমল। ফলে দ্বীনী দায়িত্ববোধ থেকেই হিজরি মাস-বর্ষের গণনা এবং এর শুরু-শেষের হিসাবের প্রতি যত্নবান হওয়া মুমিনের জন্য সবিশেষ কাম্য।
ঈমান-ইসলাম, শান্তি-নিরাপত্তা ও রহমত-বরকতের সাথে কীভাবে নতুন বছরটি অতিবাহিত হতে পারে- এ ব্যাপারে সচেষ্ট থাকাই হচ্ছে নতুন চাঁদের বার্তা। বিশেষ করে শয়তানের পথ পরিহার করে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির পথ অবলম্বন করা এবং নিজের ঈমানি জিন্দেগি প্রাণবন্ত করে তোলাই হবে আমার আগামী দিনের প্রত্যয়।

মহররম মাসে রোজা রাখার প্রতি মনোযোগী হওয়া : হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- নবী কারিম সা: ইরশাদ করেন, ‘রমজানের পর সবচেয়ে উত্তম রোজা হলো আল্লাহর মাস মহররমের রোজা। আর ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো রাতের নামাজ (অর্থাৎ তাহাজ্জুদের নামাজ)। (মুসলিম-১১৬৩)

এ হাদিস থেকে মহররমের ব্যাপারে দু’টি কথা পাওয়া যায় : ১. মহররম মাস আল্লাহর মাস। সম্মানিত ও মহিমান্বিত মাস। ২. এর সম্মান রক্ষা এবং এ থেকে যথাযথ উপকৃত হওয়ার একটি মাধ্যম হচ্ছে, এ মাসে রোজা রাখায় যত্নবান হওয়ায় বিশেষ করে ১০ মহররম আশুরার রোযার কথা তো হাদিসে গুরুত্বের সাথেই উল্লেখ করা হয়েছে।

১০ মুহাররম ‘ইয়াওমে আশুরা’ ‘আশুরা দিবস’-এর গুরুত্ব ফজিলত এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : মুহাররম মাসের সবচেয়ে মহিমান্বিত দিন হচ্ছে ‘ইয়াওমে আশুরা’ তথা মুহাররমের ১০ তারিখ ‘আশুরা দিবস’। হাদিসে আশুরার দিনের অনেক ফজিলত বিবৃত হয়েছে। এমনকি ইসলামপূর্ব আরব জাহেলি সমাজে এবং আহলে কিতাব-ইহুদি-নাসারাদের মধ্যেও ছিল এ দিনের বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা।
উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রা: বলেন, (জাহেলি সমাজে) লোকেরা রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার দিন রোজা রাখত। এ দিন কাবায় গিলাফ জড়ানো হতো। এরপর যখন রমজানের রোজা ফরজ হলো তখন রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘যে এ দিন রোজা রাখতে চায় সে রাখুক। যে না চায় না রাখুক।’ (বুখারি-১৫৯২) এরপর যখন রাসূলুল্লাহ সা: হিজরত করে মদিনা মুনাওয়ারায় এসে দেখেন, মদিনার আহলে কিতাব ইহুদিরাও এ দিনে রোজা রাখছে। এ দিনকে তারা বিশেষভাবে উদযাপন করছে। নবীজি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ দিনে তোমরা কী জন্য রোজা রাখছ?’ তারা বলল, এটি একটি মর্যাদাপূর্ণ দিবস। আল্লাহ তায়ালা এ দিনে হজরত মুসা আ: ও তাঁর কওমকে (ফেরাউনের কবল থেকে) মুক্তি দিয়েছেন এবং ফেরাউনকে তার দলবলসহ (দরিয়ায়) নিমজ্জিত করেছেন। এরপর হজরত মুসা আ: এ দিনে শুকরিয়া আদায় স্বরূপ রোজা রাখতেন। তাই আমরাও রোজা রাখি।

নবী কারিম সা: শুনে বললেন, ‘হজরত মুসা আ:-এর অনুসরণের ক্ষেত্রে তো আমরা তোমাদের চেয়ে অধিক হকদার। এরপর নবীজী সা: নিজেও রোজা রাখলেন এবং অন্যদের রোজা রাখতে বললেন।’ (মুসলিম-১১৩০, বুখারি-১১২৫, ৩৯৪৩)
ইহুদিদের কাছে এ দিনটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এ দিনটিকে তারা ঈদের মতো উদযাপন করত। হজরত আবু মুসা রা: থেকে বর্ণিত- আশুরার দিন এমন একটি দিন, যে দিনকে ইহুদিরা সম্মান করত এবং এ দিনকে ঈদ হিসেবে গ্রহণ করত। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তোমরা এ দিনে রোজা রাখো।’ (মুসলিম-১১৩১)

লেখক : কলামিস্ট, মজলিশপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement