১৮ অক্টোবর ২০২৪, ২ কার্তিক ১৪৩০, ১৪ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

ধর্ষণ জঘন্যতম অপরাধ

-

এক যুবক সরাসরি নবীজী সা:-এর কাছে এসে ব্যভিচারের মতো জঘন্য অপরাধের অনুমতি চেয়ে বসল। নবীজী সা: তাকে যেভাবে সংশোধন করলেন। তার অন্তর থেকে কীভাবে ব্যভিচারের মূলোৎপাটন করলেন।
যুবক এসে বলল, আমাকে জিনার অনুমতি দিন। অন্যরা ধমকাতে লাগল- এই তুমি কার সামনে কী বলছ? চুপ করো! নবীজী ধমক দিলেন না। কাছে ডেকে নিলেন। বললেন, ‘তোমার মায়ের সাথে কারো ব্যভিচার করা কি তুমি পছন্দ করো?’
আল্লাহর কসম, আপনার উপর আমার জান কোরবান হোক! কক্ষনো আমি এটি পছন্দ করব না, এটি হতে দেবো না।
‘কোনো মানুষই তার মায়ের সাথে কারো ব্যভিচার করাকে পছন্দ করবে না। তোমার মেয়ের সাথে কারো ব্যভিচার করা কি তুমি পছন্দ করো?’ আল্লাহর কসম, আপনার উপর আমার জান কোরবান হোক! কখনো আমি এটি পছন্দ করব না, এটি হতে দেবো না। কোনো মানুষই তার মেয়ের সাথে কারো ব্যভিচার করাকে পছন্দ করবে না।
‘তোমার বোনের সাথে কারো ব্যভিচার করা কি তুমি পছন্দ করো?’ আল্লাহর কসম, আপনার উপর আমার জান কোরবান হোক! কখনো আমি এটি পছন্দ করব না, এটি হতে দেবো না। কোনো মানুষই তার বোনের সাথে কারো ব্যভিচার করাকে পছন্দ করবে না।
‘তোমার ফুফুর সাথে কারো ব্যভিচার করা কি তুমি পছন্দ করো?’ আল্লাহর কসম, আপনার উপর আমার জান কোরবান হোক! কখনো আমি এটি পছন্দ করব না, এটি হতে দেবো না। কোনো মানুষই তার ফুফুর সাথে কারো ব্যভিচার করাকে পছন্দ করবে না।
‘তোমার খালার সাথে কারো ব্যভিচার করা কি তুমি পছন্দ করো?’ আল্লাহর কসম, আপনার উপর জান কোরবান হোক! কখনো আমি এটি পছন্দ করব না, এটি হতে দেবো না। কোনো মানুষই তার খালার সাথে কারো ব্যভিচার করাকে পছন্দ করবে না। নবীজী তাকে আরো কাছে টানলেন। তার গায়ে হাত রেখে দোয়া করে দিলেন- ‘আল্লাহ! আপনি তার গুনাহ ক্ষমা করে দিন। হৃদয়টা পবিত্র করে দিন (অন্যায় কাজ থেকে) হিফাজতে রাখুন।’

বর্ণনাকারী আবু উমামা রা: বলেন, এরপর সে আর কোনো দিন ব্যভিচারের দিকে ফিরেও তাকায়নি (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস-২২২১১)।
অর্থাৎ, নবীজী সা: তার মানসিকতার পরিশোধন করলেন, ‘নিজের মা-বোন, মেয়ে, খালা-ফুফুর জন্য যা তোমার পছন্দ নয়, অন্যের মা-বোন, মেয়ে, খালা-ফুফুর সাথে তা কীভাবে করবে?’
এই অনুভূতি যদি অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে যায়, তাহলে কি কোনো নারী যৌন হয়রানি বা যৌন নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের শিকার হতে পারে?
উপরিউক্ত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: যুবকের মানসিকতার পরিবর্তন করলেন নিজের রক্ত-সম্পর্কের নারীদের উদাহরণ টেনে, যাদের সামান্য ক্ষতিও কেউ চায় না। তার দৃষ্টি খুলে দিলেন, তোমার আপনজনদের যে ক্ষতি তুমি চাও না; সবাই নিজ নিজ আপনজনের এ ক্ষতি চায় না; নিজ মা-মেয়ে-বোন-খালা-ফুফুর সামান্য ক্ষতি চায় না। আর প্রতিটি নারীই কারো না কারো মা-মেয়ে-বোন-খালা-ফুফু।
জিনা-ধর্ষণের উল্লেখযোগ্য একটি ক্ষেত্র হলো- প্রতিবেশী নারী। এ অপরাধের পাপবোধ ও ভয়াবহতা যেন পুরুষের অন্তরে থাকে তাই একটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: প্রতিবেশীর সাথে ব্যভিচারকে জঘন্য অপরাধ সাব্যস্ত করেছেন।
এক সাহাবি রাসূলুল্লাহ সা:-কে জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড় গোনাহ কোনটি? তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কোনো সমকক্ষ সাব্যস্ত করা অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কোনটি? বললেন, ‘সন্তান তোমার খাবারে ভাগ বসাবে এই ভয়ে তাকে হত্যা করা।’ জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কোনটি? বললেন, ‘প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করা’ (মুসলিম-১৪২)।
ইসলাম নারীর ব্যাপারে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার সংশোধন করে, নারীকে সম্মান ও সহানুভূতির স্থানে অধিষ্ঠিত করে। পুরুষের মনে আল্লাহর ভয় ও আখিরাতের জবাবদিহির কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। নারীর প্রতি যেকোনো ধরনের অন্যায় আচরণের ক্ষতি ও ভয়াবহতা তুলে ধরে পুরুষকে অন্যায় থেকে বিরত রাখে। পুরুষের অন্তরে এ কথা বদ্ধমূল করে- নারীর সাথে আচরণ হতে হবে তার সম্মান ও মর্যাদা বিবেচনায় রেখেই। তার প্রতি মানসিকতা থাকবে সম্মান ও সহানুভূতির। আর এর অনুকূল সব ব্যবস্থাই ইসলাম গ্রহণ করেছে।
জিনা (ব্যভিচার) একটি চরম অপরাধ। অনেক অপরাধের সমষ্টি। মানবসভ্যতার জন্য মারাত্মক হুমকি। নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনার চূড়ান্ত রূপ। এতে আত্মিক, মানসিক, শারীরিক, চারিত্রিক, সামাজিক বহু রকমের বিপর্যয় ঘটে। এর কুফল কখনো কখনো গোটা সমাজকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
ইসলাম জিনার কাছে যেতেও নিষেধ করে

‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চয় তা অশ্লীলতা ও বিপথগামিতা’ (সূরা বনি ইসরাইল-১৭ : ৩২)। জিনা কত নিকৃষ্ট তা বোঝার জন্য এই একটি আয়াতই যথেষ্ট। এখানে ‘জিনা করো না’ এ কথা বলা হয়নি; বরং এর কাছে যেতেও নিষেধ করা হয়েছে। এ থেকে অনুমান করা যায়, এটি কত জঘন্য অপরাধ।
ধর্ষণ কেন নিন্দনীয়? এর কারণ কি শুধু এটি যে, এতে নারীর সন্তুষ্টি বিদ্যমান থাকে না, নাকি এর কারণ এই যে, এতে মানসিক, শারীরিক, সামাজিক ইত্যাদি বিপর্যয় ঘটে? সর্বোপরি তা সুস্পষ্ট কবিরা গুনাহ। আমরা মনে করি, এগুলোই ধর্ষণ অন্যায় হওয়ার মূল কারণ। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ বিষয়গুলো জিনা, স্বেচ্ছায় ধর্ষণ ও ট্র্যাপে পড়া ধর্ষণে আরো প্রকটভাবে বিদ্যমান। তো একে কেন অন্যায় মনে করা হয় না?
ইসলামে শুধু অবৈধ শারীরিক সম্পর্কের চূড়ান্ত রূপটিই জিনা নয়; বরং যেসব কাজ জিনার প্ররোচনা দেয় সেগুলোও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এবং তাও জিনা বলে গণ্য।
হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘চোখের ব্যভিচার হলো দেখা। কানের ব্যভিচার শোনা। জিহ্বার ব্যভিচার বলা। হাতের ব্যভিচার ধরা। পায়ের ব্যভিচার হাঁটা। মন কামনা করে আর লজ্জাস্থান তা সত্য বা মিথ্যায় পরিণত করে’ (মুসলিম-২৬৫৭)।
অর্থাৎ চোখ-কান-হাত-পা-জিহ্বা সবই জিনা করে, জিনার প্ররোচনা দেয়, যা পূর্ণতা পায় লজ্জাস্থানের মাধ্যমে। সুতরাং এসব অঙ্গের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
বিশেষত চোখের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকা চাই। যেসব জিনিস দেখা নাজায়েজ সেগুলো থেকে দৃষ্টিকে হিফাজত করতে হবে (যেমন- বেগানা নারী, পর-পুরুষ, অশ্লীল ছবি ইত্যাদি)। অবৈধ জিনিস দেখা অবৈধ কাজের প্ররোচণা দেয়, মনে কুচিন্তা আনে। পর্নোগ্রাফিতে আসক্তির কারণে বিকৃত যৌন ইচ্ছা জন্মাতে পারে, যা ধর্ষণের মানসিকতাকে উসকে দেয়। বস্তুত কুনজর হচ্ছে অনৈতিক কাজের ‘ভূমিকা’। এ জন্য হাদিসে একে ব্যভিচার হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

জিহ্বার জিনা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মুখে এমন কিছু বলা, যার ফলে অন্তরে জিনার চিন্তা আসে। এ জাতীয় জিনিস সেবন করা ও ভক্ষণ করাও এতে অন্তর্ভুক্ত হবে। এ প্রসঙ্গে মাদকদ্রব্যের কথা উল্লেখ করা যায়। মাদকাসক্তি মানবসভ্যতার জন্য বিরাট হুমকি। মাদকদ্রব্যের নেশার ছোবল অত্যন্ত ভয়াবহ। এতে ব্যক্তি শুধু পরিবার ও সমাজ থেকেই বিচ্ছিন্ন হয় না; তার গোটা জীবন ধ্বংস হয়। মাদক কেবল সমাজ ও জাতির জন্যই ক্ষতিকর নয়; সভ্যতা ও সংস্কৃতিকেও বিপন্ন করে। মদ্যপান সব অশ্লীলতার মূল এবং অনেক বড় বড় পাপের পথ উন্মুক্ত করে। এতে মানুষের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য বুদ্ধি-বিবেচনা বিলুপ্ত হয়ে যায়। যার ফলে সে অতি সহজেই চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণসহ নানা রকম অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়।
মদকে কুরআনে শয়তানের ‘গান্দা কর্ম’ আর হাদিসে সব অশ্লীলতার মূল আখ্যা দেয়া হয়েছে।
কানের জিনা প্রসঙ্গে গানবাদ্যের কথা আলোচনা করা যায়। গানবাদ্য বহু অন্যায়ের সমষ্টি। এতে অন্তরে কপটতা, ব্যভিচারের প্রেরণা, কুরআনের প্রতি অনীহা সৃষ্টি এবং অন্তর থেকে আখিরাতের চিন্তা নির্মূল হয়। আর বর্তমানের গান তো অশ্লীলতা ও যৌনতার আকর্ষণে ঠাসা, যা মানুষকে অবৈধ সম্পর্কের প্ররোচনা দেয় এবং অনৈতিক কাজের প্রতি প্রলুব্ধ করে। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও বুজুুর্গ ইমাম ফুজায়েল ইবনে ইয়াজ রহ: যথার্থই বলেছেন, ‘গান ব্যভিচারের মন্ত্র’।
সার কথা, ধর্ষণ একটি ভয়াবহ ব্যাধি। এ কেবল যৌন নির্যাতনই নয়; বৃহত্তর সামাজিক অন্যায়ের বহিঃপ্রকাশ। দেশ ও জাতির জন্য কলঙ্ক। অনৈতিকতা ও পাশবিকতার চূড়ান্ত পর্যায়। এ থেকে আমাদের রক্ষা পেতেই হবে। তবে তা যেন শুধু মুখ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ না থাকে; বরং কর্ম ও আচরণেও প্রকাশ পায়। যেসব জিনিস ধর্ষণের মনস্তত্ত্ব তৈরি করে, একে উসকে দেয় এবং যে পরিবেশ-পরিস্থিতি ও অবস্থানের সমন্বয়ে মানুষ এর প্রতি প্রলুব্ধ হয়, সেগুলো থেকে প্রত্যেককে নিজ নিজ শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী বেঁচে থাকতে হবে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তা বন্ধের জন্য দায়িত্বশীলদের কাছে দাবি জানাতে হবে। সুস্থ ও সুষ্ঠু সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে। সর্বোপরি ইসলামী চেতনায় উজ্জীবিত হতে হবে; আল্লাহর ভয় ও আখিরাতের জবাবদিহির কথা অন্তরে সদা সর্বদা দৃঢ়ভাবে রাখতে হবে।
লেখক: ইসলামী কলামিস্ট, মজলিশপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া


আরো সংবাদ



premium cement
গজারিয়ায় বজ্রপাতে স্ত্রীর মৃত্যু, স্বামী আহত ‘ক্ষমতায় থাকার জন্য হাসিনা এত মানুষ হত্যা করেছে, যা ইতিহাসে নেই’ আমি রেজাল্ট চাই না, আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই : শহিদ সবুজ মিয়ার মা ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে জয়খরা ঘুচাল পাকিস্তান যেভাবে শহিদ হন ইয়াহিয়া সিনওয়ার অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ হতে পারে নতুন মুখ! শুক্রবার ঢাকার বাতাসের মান ‘অস্বাস্থ্যকর’ ছাত্র অসন্তোষের জেরে পাঞ্জাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাশিয়াকে সমর্থন প্রশ্নে বেইজিংকে ‘চ্যালেঞ্জ’ করতে চীনে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেয়া মানে অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়া : ভারতকে রিজভী রিপাবলিকান-সমর্থিত নির্বাচনী বিধি বাতিলের রায় জর্জিয়ার বিচারকের

সকল