১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বৃষ্টির সময় সুন্নত আমল

-

মহান আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টি হচ্ছে বর্ষণ, যা দৃষ্টিকে শীতল করে। মনের তুষ্টি ও মাটির পুষ্টিতে বৃষ্টির বড় ধরনের অবদান রয়েছে। তাই রহমতের বারতা আর অসংখ্য নিয়ামতের ডালি নিয়ে ফি বছর বর্ষা আসে। গ্রীষ্মের তাপদাহে যখন মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত, তখনই আসমান থেকে দয়াময়ের দান রহমতের ধারা নামতে শুরু করে। আকাশে সাদা-কালো মেঘের ওড়াওড়ি, বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ, ঝরঝর অবিরল বারিধারা, পানির রূপালি ঢেউ, মরা জলাশয়ের যৌবন ফিরে পাওয়া, রোদে পোড়া তামাটে তরুলতা সজীব হয়ে ওঠা- সবই বর্ষার সৌন্দর্য। সবুজের বৈভব-ঐশ্বর্যেই বর্ষার নিয়ামত শেষ নয়। আর আল্লাহর নিয়ামত সম্পর্কে ভাবতে গেলে কৃতজ্ঞতার সিজদায় দেহ-মন নুয়ে আসে। আল্লাহ তায়ালার অন্যতম নিয়ামত হলো বর্ষা। আর আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণের সাথে আল্লাহ অনেক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকেন। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের রিজিক উৎপন্ন বা বণ্টিত হয়ে থাকে। মূলত আল্লাহর হুকুম ব্যতীত এই বৃষ্টি বর্ষিত হয় না। ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃজন করেছেন এবং আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে এরপর তা দ্বারা তোমাদের জন্য ফলের রিজিক উৎপন্ন করেছেন এবং নৌকাকে তোমাদের আজ্ঞাবহ করেছেন, যাতে তাঁর আদেশে সমুদ্রে চলাফেরা করে এবং নদ-নদীকে তোমাদের সেবায় নিয়োজিত করেছেন।’ (সূরা ইবরাহিম, আয়াত-৩২)

হাদিসে শরিফে আছে, নবী করিম সা: বৃষ্টিতে একবার বের হয়েছিলেন এবং শরীরে পানি লাগিয়ে ছিলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কেন তিনি এমনটি করেছেন? তখন তিনি বললেন, বৃষ্টিকে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বরকত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বান্দার প্রতি বেশি খুশি হলে তিনটি জিনিস দান করেন। সেগুলো হলো- কন্যাসন্তান; মেহমান এবং বৃষ্টি। বর্ষা মৌসুমে অধিক বৃষ্টি হয়। বৃষ্টি বেশি হলেই অনেকে নানান কথা বলে থাকেন। কিন্তু বৃষ্টির সময় রাসূলুল্লাহ সা: থেকে ছয়টি করণীয় প্রমাণিত। প্রিয়নবী সা: বৃষ্টিবর্ষণ ও বজ্রপাত সম্পর্কে বলেছেন, মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ বলেছেন- ‘আমার বান্দারা যদি আমার বিধান যথাযথভাবে মেনে চলত, তবে আমি তাদের রাতের বেলায় বৃষ্টি দিতাম আর সকাল বেলায় সূর্য (আলো) দিতাম আর কখনো তাদের বজ্রপাতের আওয়াজ শোনাতাম না।’ (মুসনাদে আহমদ)

বৃষ্টির সময়ের করণীয় : বৃষ্টির সময় মুমিন মুসলমানের ছয়টি করণীয় রয়েছে। বৃষ্টির উপকারী ও ক্ষতিকর বিষয়গুলোও তাতে উঠে এসেছে। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় এ করণীয়গুলো সুস্পষ্ট-১. বৃষ্টির সময় কল্যাণের দোয়া করা : যখন বৃষ্টি হয় তখন বৃষ্টি থেকে উপকার পেতে দোয়া করা জরুরি। বৃষ্টি শুরু হলে রাসূলুল্লাহ সা: কল্যাণ ও উপকার পেতে তিন শব্দের ছোট্ট একাটি দোয়া বেশি বেশি পড়তেন। তা হলো উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা সাইয়্যেবান নাফিআ।’ (বুখারি, নাসায়ি) অর্থ-‘হে আল্লাহ! আপনি মুষলধারায় যে বৃষ্টি দিচ্ছেন, তা যেন আমাদের জন্য উপকারী হয়।’ এ দোয়া পড়লে আল্লাহ তায়ালা বৃষ্টির ক্ষতিকর দিকগুলো দূর করে দেবেন এবং কল্যাণকর ও উপকারী বৃষ্টি দান করবেন।

২. বৃষ্টিতে অল্প সময় ভেজা : আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল করিমে বৃষ্টির অনেক উপকারিতার কথা তুলে ধরেছেন। বৃষ্টি মানুষের জন্য রহমতস্বরূপ। আল্লাহর রহমত ও বরকত পেতে কিছু সময় বৃষ্টিতে ভেজার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। হাদিসে এসেছে- হজরত আনাস রা: বর্ণনা করেন, ‘আমরা রাসূলুল্লাহর সা: সাথে থাকাকালীন একবার বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। রাসূলুল্লাহ সা: পরনের কাপড়ের কিছু অংশ তুলে ধরলেন যাতে করে তার শরীরে কিছুটা বৃষ্টির পানি পড়ে। এ রকম করার কারণ জানতে চাইলে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন-‘এটা (বৃষ্টি) এই মাত্র আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে।’ (মুসলিম)

৩. বৃষ্টি শুরু হলে দোয়া করা : দোয়া কবুল হওয়ার বিশেষ সময়গুলোর মধ্যে বৃষ্টির সময়ও একটি। সুতরাং বৃষ্টি শুরু হলে নিজেদের জানা দোয়াগুলো পেশ করতে আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে রোনাজারি করা বা দোয়া করা জরুরি।
প্রিয়নবী রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘দুই সময়ের দোয়া কখনো ফিরিয়ে দেয়া হয় না। এক, আজানের পরে করা দোয়া। আর দুই, বৃষ্টির সময় করা দোয়া।’ (আল-হাকিম)

৪. বৃষ্টির জন্য দোয়া ও ক্ষতি থেকে আশ্রয় চাওয়া : ঝড়-বৃষ্টির ভারী বর্ষণের ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়ে দোয়া করাও সুন্নত। দীর্ঘ এক হাদিসে এসেছে- হজরত আনাস ইবনে মালিক রহ: বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি জুমার দিন দারুল কাজার (বিচার করার স্থান)-এর দিকের দরজা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করল, এ সময় রাসূলুল্লাহ সা: দাঁড়িয়ে খুতবাহ দিচ্ছিলেন। লোকটি রাসূলুল্লাহ সা: দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে বলল-
‘হে আল্লাহর রাসূল! ধন-সম্পদ নষ্ট হয়ে গেল এবং রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে গেল। আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করুন যেন তিনি আমাদের বৃষ্টি দান করেন। তখন রাসূলুল্লাহ সা: দুই হাত তুলে (তিনবার) দোয়া করলেন-
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মাসক্বিনা, আল্লাহুম্মাসক্বিনা, আল্লাহুম্মাসক্বিনা।’

অর্থ- ‘হে আল্লাহ! আমাদের বৃষ্টি দান করুন। হে আল্লাহ! আমাদের বৃষ্টি দান করুন। হে আল্লাহ! আমাদের বৃষ্টি দান করুন। হজরত আনাস রা: বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মেঘ নেই, মেঘের সামান্য টুকরোও নেই। অথচ সালআ পর্বত ও আমাদের মধ্যে কোনো ঘরবাড়িও ছিল না। তিনি বলেন, হঠাৎ সালআর ওই পাশ থেকে ঢালের মতো মেঘ উঠে এলো এবং মধ্য আকাশে এসে ছড়িয়ে পড়ল। এরপর প্রচুর বর্ষণ হতে থাকল। আল্লাহর কসম! আমরা ছয় দিন সূর্য দেখতে পাইনি। এরপরের জুমায় সে দরজা দিয়ে এক ব্যক্তি প্রবেশ করল।

আল্লাহর রাসূল সা: তখন দাঁড়িয়ে খুতবাহ দিচ্ছিলেন। লোকটি তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল- ‘হে আল্লাহর রাসূল! ধন-সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেল এবং রাস্তাঘাট বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কাজেই আপনি বৃষ্টি বন্ধের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। হজরত আনাস রা: বলেন, আল্লাহর রাসূল সা: তখন দুই হাত তুলে (এভাবে) দোয়া করলেন- উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা হাওয়ালাইনা ওয়া লা আলাইনা; আল্লাহুম্মা আলাল আকামি ওয়াল ঝিবালি ওয়াল আঝামি ওয়াজ জিরাবি ওয়াল আওদিয়াতি ওয়া মানাবিতিশ শাঝারি।’ অর্থ- ‘হে আল্লাহ! আমাদের আশপাশে, আমাদের উপর নয়। হে আল্লাহ! টিলা, মালভূমি, উপত্যকায় এবং বনভূমিতে বর্ষণ করুন।’ হজরত আনাস রা: বলেন, তখন বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল এবং আমরা বেরিয়ে রোদে চলতে লাগলাম।’ (রাবি) শরিক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমি আনাস রা:-কে জিজ্ঞাসা করলাম, এ লোকটি কি আগের সেই লোক? তিনি বললেন, আমি জানি না।’ (বুখারি)

৫. বজ্র-বৃষ্টির সময় দোয়া করা : বজ্রপাত মহান আল্লাহ তায়ালার মহাশক্তির এক ছোট নিদর্শন। এতেই মানুষ বিচলিত হয়ে পড়ে। যার ওপর বজ্রপাত হয় তার মৃত্যু অনেকটাই নিশ্চিত। বজ্রবৃষ্টি থেকে বাঁচতে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও দোয়া করতে বলেছেন বিশ্বনবী সা:। হাদিসে এসেছে- হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা: তার বাবা থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা: যখন বজ্রের শব্দ শুনতেন বা বিদ্যুৎ চমক দেখতেন তখন সাথে সাথে বলতেন- উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা লা তাক্বতুলনা বিগাদাবিকা ওয়া লা তুহলিকনা বিআজাবিকা, ওয়া আ’ফিনা ক্বাবলা জালিকা।’ (তিরমিজি) অর্থ- ‘হে আমাদের প্রভু! তোমার ক্রোধের বশবর্তী হয়ে আমাদের মেরে ফেলো না আর তোমার আজাব দিয়ে আমাদের ধ্বংস করো না; বরং এর আগেই আমাদের ক্ষমা ও নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে নাও।’ বজ্রপাত থেকে হিফাজত থাকার তাসবিহ বজ্রের আক্রমণে মৃত্যু থেকে বাঁচতে ছোট্ট একটি তাসবিহ পড়ার কথা এসেছে হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ মুসান্নেফে আবি শায়বায়। তাতে বলা হয়েছে- যে ব্যক্তি এ তাসবিহ পড়বে, উচ্চারণ : ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি’।

৬. উপকারী বৃষ্টির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ : বৃষ্টিপাত বন্ধ হলে আল্লাহর কাছে এ বৃষ্টি সবার জন্য উপকারী হতে কিংবা বৃষ্টি বন্ধ হলে আল্লাহর কাছে দোয়া করা সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ সা: বলতেন, ‘যে ব্যক্তি (বৃষ্টির পর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের) এই দোয়া পাঠ করে, সে আমাকে বিশ্বাস করে আর তারকায় (তারার শক্তিতে) অবিশ্বাস করে। তা হলো- উচ্চারণ : ‘মুত্বিরনা বিফাদলিল্লাহি ওয়া রাহমাতিহি’ অর্থ- ‘আমরা আল্লাহর দয়া ও করুণার বৃষ্টি লাভ করেছি।’ (বুখারি ও মুসলিম) সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, বৃষ্টির সময় ও বৃষ্টি-পরবর্তী সময়ে হাদিসে নির্দেশিত ছয়টি সুন্নাত যথাযথভাবে পালন করা।

পরিশেষে বলতে চাই, বর্ষাকালে বেশি বৃষ্টি হবে সেটিই স্বাভাবিক। বৃষ্টি মহান আল্লাহর দান। ইচ্ছা করে বৃষ্টি চালু করা বা বন্ধ করা সম্ভব নয়। কাজেই মহান আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট হয়ে বৃষ্টি যেন উপকারী হয়, সে মর্মে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে। পানির অপচয় রোধ এবং পানিকে দূষণমুক্ত রাখতে সচেতন হতে হবে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগীকল্যাণ সোসাইটি।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement
গাজীপুরে নতুন ট্রেন ও অসমাপ্ত বিআরটি লেনে বিআরটি বাস সার্ভিসের উদ্বোধন বেনজীর ও মতিউরের বিরুদ্ধে দুদকের ৬ মামলা ছিনতাই রোধে রাজধানীতে শেষ রাতে পুলিশি টহল বাড়ানোর নির্দেশ পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্টের সাথে বিএনপি নেতাদের সৌজন্য সাক্ষাৎ জামায়াতের একজন নেতাও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেনি: ড. মাসুদ মালয়েশিয়ায় বেতন না পেয়ে কোম্পানির অফিস ঘেরাও-অবরোধ, যা বলল বাংলাদেশ দূতাবাস সংস্কার বা পরিবর্তন সবকিছু শুরু হয়েছিল বিএনপির হাত ধরেই : মির্জা ফখরুল ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে নতুন ভর্তি ৩৭৩ রাষ্ট্র মেরামতের সময় জানতে চাওয়ার অধিকার জনগণের রয়েছে : তারেক রহমান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে ছাত্রশিবিরের ৩ দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা আ’লীগের দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে পাবনায় বিক্ষোভ

সকল