১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১ পৌষ ১৪৩০, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

কাবার পথের মেহমান

-


হজ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ রোকন বা স্তম্ভ। আরবি ভাষায় হজ শব্দের অর্থ জিয়ারতের সংকল্প করা। যেহেতু খানায়ে কাবা জিয়ারত করার উদ্দেশ্যে মুসলমানরা পৃথিবীর চারিদিক থেকে নির্দিষ্ট কেন্দ্রের দিকে চলে আসে, তাই এর নাম হজ রাখা হয়েছে। কিন্তু এ হজের পেছনে এক সংগ্রামী, চিত্তাকর্ষক ও শিক্ষাপ্রদ ইতিহাস রয়েছে। যারা এ বিশ্ব সম্মেলন কেন্দ্রে আল্লাহর মেহমান হিসেবে হাজিরা দিতে যাবেন, তারা যদি গভীর মনযোগসহকারে সেই ইতিহাস অধ্যয়ন করে যান, তবে হজের প্রকৃত শিক্ষা ও কল্যাণ লাভ করা সহজ হবে। সেই ইতিহাসের শিরোনামগুলোর সারসংক্ষেপ হলোÑ শিরকের মূলোৎপাঠনকারী মুসলিম মিল্লাতের অবিসংবাদিত সংগ্রামী নেতা ও পিতা হজরত ইবরাহিম আ:, আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থায় পরীক্ষিত এক মহীয়সী নারী হজরত মা হাজেরা ও তার দুগ্ধপোষ্য সন্তান হযরত ইসমাইল আ:। আর তাঁদেরই দোয়ার ফসল মানবতার পরম সুহৃদ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা:-এর সংগ্রামী জীবন চরিত। হজের প্রতিটি হুকুম আহকামের পেছনে এই চারজন ব্যক্তিত্ব তথা হজরত ইবরাহিম আ:, মা হাজেরা, ইসমাইল আ: ও মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা:-এর চমকপ্রদ ও শিক্ষনীয় ইতিহাস জড়িত।
পিতা হজরত ইবরাহিম আ: ও পুত্র ইসমাইল আ: মিলে ইসলামী আন্দোলনের বিশ্ববিখ্যাত কেন্দ্র খানায়ে কাবা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আল্লাহ তায়ালা নিজেই এ কেন্দ্র নির্দিষ্ট করে দেন। খানায়ে কাবা সাধারণ মসজিদের মতো নিছক ইবাদতের স্থান নয়, প্রথম দিন থেকেই এটি দ্বীন ইসলামের বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের প্রচারকেন্দ্ররূপে নির্ধারিত হয়েছিল। এ কাবা নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল যে, পৃথিবীর দূরবর্তী অঞ্চলসমূহ থেকে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী সব মানুষ এখানে এসে মিলিত হবে এবং সংঘবদ্ধভাবে এক আল্লাহর ইবাদত করবে, আবার এখান থেকে ইসলামের বিপ্লবী পয়গাম নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় ফিরে গিয়ে তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবে। বিশ্ব মুসলিমের এ সম্মেলনেরই নাম হজ।
এ ঘরের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে হজরত ইবরাহিম আ: দোয়া শুনুন : আল কুরআনে আল্লাহ বলছেনÑ ‘এবং স্মরণ করো, যখন ইবরাহিম দোয়া করেছিলেনÑ হে আল্লাহ! এ শহরকে শান্তিপূর্ণ বানাও, আমাকে এবং আমার সন্তানকে মূর্তি পূজার শিরক থেকে বাঁচাও। হে আল্লাহ! এ মূর্তিগুলো অসংখ্য লোককে গোমরাহ করেছে। অতএব, যে আমার পন্থা অনুসরণ করবে সে আমার, আর যে আমার পন্থার বিপরীতে চলবে তখন তুমি নিশ্চয়ই বড় ক্ষমাশীল ও দয়াময়। পরোয়ারদিগার! আমি আমার বংশধরদের একটি অংশ তোমার এ মহান ঘরের নিকট, এ ধূসর মরুভূমিতে এনে পুনর্বাসিত করেছিÑ এ উদ্দেশ্যে যে, তারা নামাজ কায়েম করবে। অতএব, হে আল্লাহ! তুমি লোকদের মনে এতদূর উৎসাহ দাও যেন তারা এর দিকে দলে দলে চলে আসে এবং ফলমূল দিয়ে তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করো। হয়তো এরা তোমার কৃতজ্ঞ বান্দা হবে।’ (সূরা ইবরাহিম : ৩৫-৩৭)

এ সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরো বলেনÑ ‘এবং স্মরণ করো, যখন ইবরাহিমের জন্য এ ঘরের স্থান ঠিক করেছিলামÑ এ কথা বলে যে, এখানে কোনো প্রকার শিরক করো না এবং আমার ঘরকে তাওয়াফকারী ও নামাজিদের জন্য পাক-সাফ করে রাখো। আর লোকদেরকে হজ করার জন্য প্রকাশ্যভাবে আহ্বান জানাও, তারা যেন তোমার নিকট আসে, পায়ে হেঁটে আসুক কিংবা দূরবর্তী স্থান থেকে কৃশকায় উটের পিঠে চড়ে আসুক। এখানে এসে তারা যেন দেখতে পায় তাদের জন্য দ্বীন-দুনিয়ার কল্যাণের ব্যবস্থা রয়েছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর দেয়া জন্তুগুলোকে আল্লাহর নামে কোরবানি করবে, তা থেকে নিজেরাও খাবে এবং দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত লোকদেরকে খেতে দেবে।’ (সূরা হজ : ২৬-২৮)
এ ঘরের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে পিতা-পুত্র মিলে মহান আল্লাহর দরবারে আরো দোয়া করেছিলেন যা আল্লাহ নিজের ভাষায় কুরআনে বলেছেনÑ ‘এবং স্মরণ করো, ইবরাহিম ও ইসমাইল যখন এ ঘরের ভিত্তি স্থাপনকালে দোয়া করছিলেন : পরোয়ারদিগার! আমাদের এ চেষ্টা কবুল করো, তুমি সব কিছু জানো এবং সব কিছু শুনতে পাও। পরোয়ারদিগার! তুমি আমাদের দু’জনকেই মুসলিমÑ অর্থাৎ তোমার অনুগত করো এবং আমাদের বংশাবলি থেকে এমন একটি জাতি তৈরি কর যারা একান্তভাবে তোমারই অনুগত হবে। আমাদেরকে তোমার ইবাদত করার পন্থা বলে দাও, আমাদের প্রতি ক্ষমার দৃষ্টি নিক্ষেপ করো, তুমি বড়ই ক্ষমাশীল ও দয়াময়। পরোয়ারদিগার! তুমি সে জাতির প্রতি তাদের মধ্য থেকে এমন একজন নবী পাঠাও যিনি তাদেরকে তোমার বাণী পড়ে শোনাবে, তাদেরকে কিতাব ও জ্ঞান শিক্ষা দেবে এবং তাদের চরিত্র সংশোধন করবে। নিশ্চয় তুমি সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন ও বিজ্ঞ।’ (সূরা বাকারা : ১২৭-১২৯)
যে শিরক উচ্ছেদ ও মূর্তিপূজা বন্ধ করার সাধনা ও আন্দোলনে হজরত ইবরাহিম আ: ও ইসমাইল আ: সারাটি জীবন অতিবাহিত করেছিলেন, কালের বিবর্তনে এ কাবাঘরে আবার ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন করা হয়। চারদিকে শিরক আর শিরক চলতে থাকে। লাত, মানাত, হুবাল, নসর, ইয়াগুস, উজ্জা, আসাফ, নায়েলা আরো অসংখ্য নামের মূর্তি তৈরি করে পূজা করত। হজকে তারা তীর্থযাত্রার অনুরূপ বানিয়ে তাওহিদ প্রচারের কেন্দ্রস্থল কাবাঘর থেকে মূর্তিপূজার প্রচার শুরু করেছিল এবং পূজারীদের সর্বপ্রকার কলাকৌশল অবলম্বন করে বিভিন্ন স্থান থেকে আগত লোকদের নিকট থেকে নজর-নিয়াজ আদায় করত। হজের অন্যান্য অনুষ্ঠানকে বিকৃতরূপ দিয়ে পালন করত। এ ভাবে ইবরাহিম আ: ও হজরত ইসমাইল আ: যে মহান কাজ শুরু করেছিলেন এবং যে উদ্দেশ্যে তারা হজ-প্রথার প্রচলন করেছিলেন, তা সবই বিনষ্ট হয়ে যায়।

অবশেষে উপরে উল্লিখিত হজরত ইবরাহিম আ:-এর দোয়ারই ফসল মানবতার বন্ধু হজরত মুহাম্মদ সা: মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে শিরকের মূলোৎপাঠন করেন এবং মুসলিম মিল্লাতের পিতার হারানো হজের নিদর্শনগুলো পুনরুদ্ধার করেন।
হজের প্রতিটি পদে পদে আল্লাহর স্মরণ-আল্লাহ নামের জিকির, নামাজ, ইবাদত ও কোরবানি এবং কাবাঘরের তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ। আর এখানে একটিমাত্র আওয়াজই মুখরিত হয়ে উঠে, হারাম শরিফের প্রাচীর আর পাহাড়ের চড়াই-উৎরাইয়ের প্রতিটি পথে উচ্চারিত হয় : ‘লাব্বায়িক আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক, লা শারিকা লাকা লাব্বায়িক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নিয়মাতা লাকা ওয়াল মুলকা লা শারিকা লাকা’ অর্থÑ হে প্রভু তোমার ডাকে আমি উপস্থিত। আমি এসেছি, তোমার কোনো শরিক নেই, আমি তোমারই নিকটে এসেছি। সব প্রশংসা একমাত্র তোমার জন্য। সব নিয়ামত তোমারই দান, রাজত্ব আর প্রভুত্ব সবই তোমার। তুমি এককÑ কেউই তোমার শরিক নেই।’
কাবার পথের যাত্রীরা কোথায় হাজিরা দিতে যাচ্ছেন আর হাজিরা দিতে গিয়ে কি বলছেন, তা অবশ্যই গভীর মনযোগের সাথে চিন্তা করবেন। এমনিভাবে হজের প্রতিটি অনুষ্ঠান পালন করার সময় কি করা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে তা অনুধাবন করবেন। আমরা কি তপক্ষেই আমাদের বাস্তব জীবনকে শিরকমুক্ত করতে পেরেছি এবং আল্লাহর কাছে নিজেকে পূর্ণাঙ্গ মুসলিম হিসেবে পেশ করতে পেরেছি? আত্মজিজ্ঞাসার জবাব যদি না-বোধক হয় তবে আমরা লাব্বায়িক বলে এ বিশ্বসম্মেলন কেন্দ্রে হাজিরা দেবো ঠিকই কিন্তু আল্লাহর হাজিরা খাতায় অনুপস্থিত লেখা হবে। যেমনিভাবে আমাদের প্রাণহীন নামাজ মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখতে পরছে না, প্রাণহীন রোজা তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করতে পারছে না ও জাকাত আমাদেরকে পবিত্র করতে পারছে না। তেমনিভাবে প্রাণহীন হজ আল্লাহর হাজিরা খাতায় অনুপস্থিতিই লেখা হবে। তাই কাবার পথের যাত্রীরা তাদের উপস্থিতিকে নিশ্চিত করার জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো প্রতি নজর দেয়া প্রয়োজন :

শিরককে পরিত্যাগ করতে হবে : শিরক একটি জুলুম। শিরকের গুনাহ আল্লাহ মাফ করবেন না। শিরক সমস্ত নেকআমলকে ধ্বংস করে দেয়। এ শিরক বর্তমানে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় এ শিরককে পরিত্যাগ করতে হবে। কারণ শিরক মুক্ত জীবন ও সমাজ গঠন করার জন্যই হজরত ইবরাহিম আ: ও হজরত মুহাম্মদ সা: আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। হজের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলোÑ শিরক উচ্ছেদ। মহান আল্লাহর সম্মানিত মেহমান হিসেবে তালবিয়া পাঠে আমরা তারই স্বীকৃতিই দিয়ে থাকি। ‘আমি উপস্থিত। আমি এসেছি, তোমার কোনো শরিক নেই, আমি তোমারই নিকটে এসেছি। তুমি একক-কেহই তোমার শরিক নেই।’ এ কথাটিকে বাস্তব জীবনে রূপায়ণ করতে হবে। দ্বিমুখী নীতি পরিহার করে,পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করতে হবে : জন্মসূত্রে মুসলমান নয়; বরং একজন পরিপূর্ণ মুসলিম হতে হবে, সারা জাহানের প্রভুর উদ্দেশ্যে নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে, নিজেকে তার কাছে সোপর্দ করতে হবে। জীবনের প্রতিটি কথা ও কাজ কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী হতে হবে। শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে আল্লাহকে প্রভু হিসেবে স্বীকার করা হলো কিন্তু জীবনের বিশাল অংশকে মানুষের তৈরি আদর্শের হাতে সোপর্দ করলে হবে না। প্রতি নামাজেই অসংখ্যবার বলা হচ্ছেÑ ‘আমরা তোমারই গোলামি করি আর তোমারই সাহায্য চাই’। অথচ নামাজের বাইরে তার বিপরীত কাজ করা হচ্ছে। এ এক মিথ্যাচার ছাড়া কি হতে পারে?
লেখক : প্রবন্ধকার

 

 


আরো সংবাদ



premium cement