বদর যুদ্ধ যা শিক্ষণীয়
- মাওলানা কাওসার আহমদ যাকারিয়া
- ০১ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০৫
৬২৪ সালে তথা দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজানে বদর প্রান্তরে সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক যুদ্ধ। প্রতিপক্ষ ছিল মক্কার মুশরিক ও মদিনার মুসলিম। এতে মুসলমানদের সেনা সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩। ওই যুদ্ধে মুসলমানরা সংখ্যায় কম হয়েও কাফিরদের বিশাল বাহিনীর ওপর বিজয় লাভ করেছে। কুরআন কারিমে এই যুদ্ধকে সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী যুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পবিত্র মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে ইসলাম তথা মুসলমানদের বিজয়ের ধারা সূচিত হয়েছিল এবং পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্রক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধে আবু জেহেলের এক হাজার সুসজ্জিত বাহিনীর বিপরীতে রাসূলুল্লাহ সা:-এর ৩১৩ জন সাহাবি আল্লাহ তায়ালার গায়েবি সাহায্যে আবু জেহেলের বিশাল বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেছিলেন অত্যন্ত কঠিনভাবে।
ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর ১৪ জন শহীদ হয়েছিলেন আর মুশরিক বাহিনীর ৭০ জন নিহত এবং ৭০ জন বন্দী হয়েছিল। আর এরা ছিল গোত্রসমূহের সর্দার এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। এ জেহাদে ইসলাম ও রাসূল সা:-এর চরম ১৪ জন শত্রুর মধ্যে আবু জেহেল, উৎবা ও শায়বাসহ ১১ জনই জাহান্নামে পৌঁছে যায়। যুদ্ধ শেষে বদর প্রান্তরে নিয়ম অনুযায়ী তিন দিন অবস্থান শেষে চতুর্থ দিনে রাসূল সা: মদিনার পথে যাত্রা করেন। এ সময় তাঁর সাথে ছিল বন্দী কুরাইশরা এবং গণিমতের মালামাল। আর এসবের তত্ত্বাবধানে ছিলেন হজরত আবদুল্লাহ ইবনে কাব রা:। রাসূল সা: ছাফরা প্রান্তরে কাফের বাহিনীর পতাকা বহনকারী নজর ইবনে হারেসকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
যেসব পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কারণে বদর যুদ্ধের সূচনা হয় তা হচ্ছে মদিনা শরিফে সাফল্যজনকভাবে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় কুরাইশদের হিংসা, আবদুল্লাহ বিন ওবাই ও ইহুদিদের যড়যন্ত্র, সন্ধি শর্ত ভঙ্গ, কুরাইশদের যুদ্ধের হুমকি, বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা, কাফেরদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা, ইসলামের ক্রমবর্ধমান শক্তির ধ্বংস সাধন এবং নবীজী সা:-কে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার অশুভ চক্রান্ত। প্রত্যক্ষ কারণ ছিল নাখালার ঘটনা, কাফেরদের রণপ্রস্তুতি, আবু সুফিয়ানদের অপপ্রচার, যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য ওহি লাভ, মক্কাবাসীর ক্ষোভ। এসব কারণে এবং আবু জেহেলের নেতৃত্বে এক হাজার সৈন্য নিয়ে মদিনা আক্রমণের সংবাদ শুনে তাদের গতিরোধ করার জন্য ৬২৪ সালের ১৬ মাচর্, ১৭ রমজান ৩১৩ জন মুজাহিদ (৬০ জন মুহাজির অবশিষ্টরা ছিল আনছার) নিয়ে মদিনা শরিফের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ৮০ মাইল দূরে বদর নামক স্থানে যুদ্ধে উপনীত হন এবং ১৭ রমজান রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়।
বদর যুদ্ধের সফলতা হচ্ছে, আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি, বিশ্ব বিজয়ের সূচনা, সর্বোত্তম ইতিহাস সৃষ্টি, প্রথম সামরিক বিজয়, কুরাইশদের শক্তি খর্ব, ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন, নবযুগের সূচনা, চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারক যুদ্ধ, রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তি স্থাপন, জেহাদের অনুপ্রেরণা, বীরত্বের খেতাব লাভ, পার্থিব শক্তির ভিত্তি স্থাপন ইসলাম ও মহানবী সা:-এর প্রতিষ্ঠা, মিথ্যার ওপর সত্যের জয়, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য সৃষ্টি, সূরা আনফালে ঘোষিত আল্লাহ তায়ালার ওয়াদা পূরণ, রাসূল সা:-এর দোয়া কবুল হওয়া, বদর জেহাদ মুসলমানদের পক্ষে আল্লাহ তায়ালার গায়েবি সাহায্যের জ্বলন্ত প্রমাণ।
বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবিদের মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ের নেতৃত্বদানকারী ছিলেন হজরত ওমর রা:, হজরত আলী রা: ও হজরত আমির হামজা রা:। কাফেরদের নেতৃত্বে ছিলেন আবু জাহেল, উৎবা, শায়বা ও পতাকাবাহী নজর ইবনে হারেশ, ওয়ালিদ বিন মুগিরা আবু সুফিয়ান।
সাহাবিদের পক্ষ থেকে প্রথম তীর নিক্ষেপকারী সাহাবি ছিলেন হজরত সা’দ ইবনে ওয়াক্কাস রা:। বদর জেহাদে অংশ নেয়া সাহাবির মধ্যে দুজন ছিলেন উষ্টারোহী, ৮০ জন তলোয়ারধারী এবং অবশিষ্টরা ছিলেন তীর বা বর্শাধারী। এ জেহাদে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের দিয়ে মুসলমানদের সাহায্য করেন। জেহাদের আগের রাতে বদর প্রান্তরে প্রবল বৃষ্টির কারণে কাফেরদের এলাকা কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল হয়ে পড়া, সাহাবিদের বালুময় অবস্থানস্থল বৃষ্টির কারণে জমে গিয়ে শক্ত হয়ে যাওয়া এবং পানি সংগ্রহের সুযোগ পাওয়া। খেজুরের ডাল তলোয়ারের মতো ধারালো হওয়ায় কাফেরদের কতল হওয়া।
ইসলামের ইতিহাসে এই যুদ্ধের অসামান্য গুরুত্ব রয়েছে। নিম্নে শিক্ষণীয় দিক তুলে ধরা হলো-
পরামর্শ : রাসূল সা:-এর সব কাজকর্ম ওহি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ সব কাজে সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করতেন। বদর যুদ্ধের সময় রাসূল সা: গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করেছেন। রাসূল সা: মূলত মদিনা থেকে বের হয়েছিলেন আবু সুফিয়ানের ব্যবসায়িক কাফেলাকে পাকড়াও করার জন্য। পথিমধ্যে তিনি জানতে পারলেন কুরাইশরা তাদের কাফেলাকে রক্ষা করার জন্য সদলবলে যাত্রা করছে। তখন তিনি সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করলেন, এ মুহূর্তে কী করা উচিত। মুসলমানরা কি যুদ্ধ করবে, নাকি মদিনায় ফিরে যাবে। তখন রাসূল সা: মুহাজির ও আনসারদের পরামর্শে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। এই যুদ্ধে রাসূল সা: হাব্বাব ইবনে মুনজিরের পরামর্শে যুদ্ধের অবস্থানস্থল পরিবর্তন করেন। অনুরূপভাবে রাসূল সা: বদরের বন্দীদের ব্যাপারেও সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করেন।
উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা : যেকোনো কাজে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা রাসূল সা:-এর সুন্নত। উপযুক্ত ব্যবস্থা কিংবা উপকরণ গ্রহণ করা তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী নয়। বদর যুদ্ধের সময় রাসূল সা: সাধ্যমতো যুদ্ধের প্রস্তুতি ও অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। রাসূল সা: তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ ও সাঈদ ইবনে জায়েদকে পাঠিয়েছিলেন আবু সুফিয়ানের ব্যবসায়িক কাফেলার খবর নিতে। অনুরূপভাবে রাসূল সা: আদি ইবনে জাবা ও বাসবাস ইবনে আমরকে বদরপ্রান্তে পানি খোঁজ করার জন্য পাঠান।
দোয়া : দোয়া মুমিনের হাতিয়ার। দোয়া বিজয় ও সাফল্যের চাবিকাঠি। রাসূল সা: যেকোনো বিপদের সময় দোয়ার প্রতি খুব গুরুত্ব দিতেন। বদর যুদ্ধের সময় রাসূল সা: আল্লাহর কাছে বিনয়াবনত হয়ে রোনাজারি করেছেন এবং আল্লাহর সাহায্য চেয়েছেন।
সাহায্য একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে : মুমিনদের বৈশিষ্ট্য হলো বিপদ কিংবা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মনোবল না হারানো বিচলিত না হওয়া। তারা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ করে আল্লাহর ওপর ভরসা করবে। বদর যুদ্ধে দেখা যায়, মুসলমানদের সেনা সংখ্যা অবিশ্বাসীদের তুলনায় অনেক কম ছিল। মুসলমানদের যুদ্ধ সরঞ্জাম ও বাহন বলতে ছিল ৭০টি উট, দুটি ঘোড়া এবং ৬০টি বর্ম। এ যুদ্ধ প্রমাণ করে, বিজয় কিংবা সাফল্যে সেনা সংখ্যাধিক্যের কোনো প্রভাব নেই।
অহঙ্কার পতনের মূল : মক্কার কাফিররা নিজেকে খুব ক্ষমতাবান মনে করত। অহমিকা ও অহঙ্কারের কারণে কেউ তাদের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারত না। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তারা মক্কায় মুসলমানদের ওপর বর্ণনাতীত নির্যাতন করেছিল। যুদ্ধের দিনেও মুসলমানদের তুলনায় তাদের সেনা সংখ্যা ও যুদ্ধ সরঞ্জাম অনেক বেশি ছিল। এ নিয়ে তারা অহঙ্কারও করেছিল। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাদের অহঙ্কার ও ক্ষমতার দাপট মাটিতে মিশিয়ে দিলেন।
লেখক : কলামিস্ট, মজলিশপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা