২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯ মাঘ ১৪৩১, ২২ রজব ১৪৪৬
`

নিজেকে গড়ার সর্বোৎকৃষ্ট সময় রমজান

-

ইসলামের পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম একটি হলো রমজান মাসে রোজা পালন করা। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে নিয়তসহ সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাদ্য, পানীয় এবং স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকাই সাওম বা রোজা (আল-কামুসুল ফিকহি, পৃষ্ঠা-৩৫০; তারিফাত লিল জুরজানি, পৃষ্ঠা-১৭৮)। মুসলিম ধর্মাবলম্বী প্রাপ্তবয়স্ক সবার ওপর এই মাসে সাওম পালন করা ফরজ কিংবা অত্যাবশ্যকীয় করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো’ (সূরা বাকারা-১৮৩)।
রমজান মুসলমানদের আদর্শ চরিত্র গঠন, নিয়মানুবর্তিতা ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের শিক্ষা দেয়। তা ছাড়া রমজান মাস সত্যিকার মুমিন হিসেবে গড়ে ওঠার অনুপম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণেরও উত্তম সময়। রমজান মাসে রোজার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন করা। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সব প্রকার নাফরমানি কাজ থেকে দূরে থাকার নামই ‘তাকওয়া’। সূরা বাকারার ১৮৩ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ আমরা এই মাসে দিনের বেলায় লোকচক্ষুর অন্তরালেও এক ফোঁটা পানি পান করি না। কারণ কী? আমরা সাওম পালন করছি! হ্যাঁ এটাই, মানুষ আমাদের না দেখলেও আল্লাহ কিন্তু আমাদের দেখছেন আর সেই ভয়েই আমরা পানি পান করি না কিংবা খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকি, এটাই তাকওয়া বা খোদাভীতি। আমাদের রব যখন আমাদের দেখছেন তখন কিভাবে গুনাহ করতে পারি? এই বিষয়টিই মানুষের মনে সৎ ও মানবিক গুণাবলি সৃষ্টি করে এবং পাপাচার থেকে বাঁচিয়ে রাখে।
প্রতি বছর রমজান আমাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়, তা হলো ধৈর্য। সেই ভোর রাতে উঠে সাহরি খেয়ে প্রায় ১৪-১৮ ঘণ্টা সারা দিন না খেয়ে থাকা, রাতে দীর্ঘসময় কিয়ামুল লাইল এবং কুরআন তিলাওয়াত করা অবশ্যই ধৈর্যের বিষয়। রমজান আমাদেরকে সেটাই শেখায়। ইমাম আহমদ বলেন, আল্লাহ কুরআনে সবর (ধৈর্য) শব্দটি ৯০ বারেরও বেশি ব্যবহার করেছেন (মাদারিজ আস সালিকিন-২/২৫২)। আর রমজান মাসকে ধৈর্যের মাস বলা হয়। কারণ এই মাস আত্মাকে খাওয়া, পান করা এবং যৌন কামনা থেকে বিরত রাখে (আত তামহিদ-১৯/৬১)।
রমজানের এই মহিমান্বিত মাস আমাদের ভালো কাজগুলো করার অভ্যাস গড়তে সহায়তা করে। রাসূল সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা এবং সে অনুসারে কাজ করা আর মূর্খতা পরিহার করে না, আল্লাহর কাছে তার পানাহার বর্জনের কোনো প্রয়োজন নেই’ (বুখারি-৬০৫৭)। এই বরকতময় মাসটিতে আমাদের কেবল খাদ্য ও পানীয় পরিহার করার জন্যই নয়, বরং এমন বক্তব্য ও কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য উৎসাহিত করে যা মানুষের ক্ষতি এবং তাদের অধিকার লঙ্ঘনের কারণ হতে পারে। যেমন রাসূলুল্লাহ সা: বর্ণনা করেন, প্রকৃত মুসলিম সেই ব্যক্তি যার হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে’ (মুসলিম-৪০)। তাই ব্যক্তি হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো, আমাদের চরিত্রের ত্রুটিগুলো পরীক্ষা করা এবং সেগুলোকে সংশোধন করার চেষ্টা করা।
এই মাস আমাদের আরো শিক্ষা দেয় উত্তম আচরণ করার, কারো সাথে ঝগড়া বিবাদ না করার। নবীজী বলেছেন, ‘যদি তোমাকে কেউ গালি দেয় কিংবা তোমার সাথে ঝগড়া করে তাহলে তুমি বলো যে আমি রোজাদার’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১৮৯৪)। ওই হাদিসে সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে ঝগড়া বিবাদে না জড়ানোর।
রোজা পালনের মৌলিক একটি প্রতিপাদ্য হলো অভুক্ত অনাহারে থেকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের কষ্ট অনুভব করা এবং শুকরিয়া জ্ঞাপন করা সেই মহান রবের দরবারে যিনি রিজিকের ব্যবস্থা করেন। ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে আহার করানোর বিষয়টিও রমজানের একটি দর্শন। হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে সে রোজাদারের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে; রোজাদারের সওয়াব থেকে একটুও কমানো হবে না। (সুনানে তিরমিজি-৮০৭)। রোজাদারকে ইফতার করানোর মধ্য দিয়ে মানুষকে আহার করানোর একটি মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সবার প্রতি সমান ভালোবাসা নিয়ে ইফতার বিতরণ করতে হবে। অপরের পাশে দাঁড়ানোর এই মূল্যবান মানসিকতার মধ্য দিয়ে আভিজাত্যের একটি চর্চা নিজেদের জীবনে সৃষ্টি করতে হবে।
রমজান আত্মশুদ্ধির মাস। এই মাসের শিক্ষাগুলো অর্থাৎ তাকওয়া, ধৈর্য, উত্তম আচরণ, অনাহারীকে আহার করানো। যদি পুরোপুরি আমরা আমাদের বাস্তব জীবন ও সমাজে বাস্তবায়ন করতে পারি তবে পাল্টে যাবে এই সমাজের চিত্র। ব্যক্তি, পারিবারিক ও সমাজ জীবনে বয়ে আনবে শান্তির বার্তা। তাই আসুন আমরা চেষ্টা করি মহিমান্বিত এই মাসের শিক্ষাগুলো চর্চা করার এবং রমজানের পরবর্তী সময়ে এগুলো চালিয়ে যাওয়ার। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তার নির্দেশিত এবং রাসূল সা: প্রদর্শিত পদ্ধতিতে রোজা পালন করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক: গবেষণা সহকারী, সেন্টার ফর অ্যাডভান্স সোশ্যাল রিসার্চ, ঢাকা


আরো সংবাদ



premium cement