২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৩ শাবান ১৪৪৬
`

শুল্ক আদায়ে ইসলামের নির্দেশনা

-

সরকারি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে যে সব বিদেশী পণ্য আমদানি করা হয় সেগুলো বিক্রয় করা নাজায়েজ হবে না। তবে সরকারের দৃষ্টিতে এ কাজটি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই এ ধরনের পণ্য বিক্রি না করার মাঝেই সতর্কতা রয়েছে। কারণ, কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, অর্থ ‘নিজ হাতে নিজদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না’ (সূরা বাকারা : ১৯৫)। তাকমিলাতু ফাতহুল মুলহিম ৩/৩২৩-৩২৪; রদ্দুল মুহতার ৬/৩৯৯ আর ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থ বিভাগকে বায়তুল মাল বলা হয়। বায়তুল মালে আমদানির যেসব মাধ্যম নির্ধারিত আছে, সেগুলো হলো জাকাত, উশর, খিরাজ, জিজিয়া, মালে ফাই, মালে গণিমত ও হারিয়ে যাওয়া সম্পদ। এগুলো ছাড়া জনগণের ওপর শুল্ক নির্ধারণের ব্যাপারে ইসলাম অত্যন্ত সংবেদনশীল। সাধারণ অবস্থায় শুল্কারোপকে জুলুম সাব্যস্ত করা হয়েছে। তবে কখনো যদি দেশের ওপর এমন পরিস্থিতি হয় যে দেশ ও জনগণের সামগ্রিক প্রয়োজন পুরো করার জন্য বায়তুল মালে যথেষ্ট অর্থ মজুদ নেই, তা হলে সেই পরিস্থিতিকে একটি বিশেষ অবস্থা সাব্যস্ত করে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে প্রয়োজনের ওপর সীমাবদ্ধ থেকে ট্যাক্স ধার্য করার অনুমতি ইসলামিক স্কলাররা দিয়েছেন। পরিভাষায় একে ‘জরিবাতুন নায়েবাহ’ (সাময়িক কর) বলা হয়। কিন্তু এর অনুমতি থাকবে তখন, যখন শাসকবর্গ আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতা থেকে বিরত থাকবেন এবং সৎ নিয়তে প্রয়োজন মেটানোর জন্য ট্যাক্স আরোপ করবেন।
সাধারণত ‘মাক্স’-এর অনুবাদ করা হয় ‘ট্যাক্স’। এর ভিত্তিতে কখনো কখনো মনে করা হয় যে এই হাদিস সব ধরনের ট্যাক্স গ্রহণকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু প্রকৃত বিষয় হচ্ছে ‘মাক্স’-এর ব্যাখ্যা মুহাদ্দিস ও ফকিহগণ ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় করেছেন। ইমাম আবু উবায়েদ কাসেম ইবনে সালাম রহ: এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, এ ধরনের প্রথা জাহেলি যুগে ছিল। আরব-অনারবের সব রাজা-বাদশা এই কাজ করতেন। তাদের নিয়ম ছিল, যখন ব্যবসায়ীরা তাদের এলাকার ভেতর দিয়ে অতিবাহিত হতো, তখন তাদের কাছ থেকে তাদের সম্পদের দশমাংশ উসুল করে রাখতেন (আল-আমওয়াল, আবু উবায়েদ : বর্ণনা নম্বর : ১১৩১)। ইমাম তাহাভি রহ:-এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন, যে শুল্ক রাসূলুল্লাহ সা: মুসলমানদের থেকে নির্মূল করে দিয়েছেন, তা ছিল সেই উশর (দশমাংশ), যা জাহেলি যুগে উসুল করা হতো। (শারহু মাআনিল আসার : ৪/২৫৩) ইমাম গাজালি রহ: এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন। প্রথমত, তিনি সেই সব শাসকের নিন্দা করেছেন, যারা তাদের ফৌজের আরাম-আয়েশ এবং বিলাসিতার জন্য ট্যাক্স আরোপ করে। তার পর তিনি ট্যাক্স আরোপের জন্য নি¤œবর্ণিত শর্তাবলি উল্লেখ করেছেন।
ক. শাসক এমন হতে হবে, যার আনুগত্য করা ওয়াজিব। খ. দেশের নিরাপত্তার জন্য প্রকৃতপক্ষেই প্রয়োজন দেখা দিতে হবে। গ. বায়তুল মাল অর্থশূন্য হতে হবে। ঘ. এতটুকু ট্যাক্সই আরোপ করা যাবে, যতটুকু প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট হয়। ঙ. জনগণের ওপর ট্যাক্স বণ্টনের ক্ষেত্রে ইনসাফ অবলম্বন করতে হবে। এমন যেন না হয় যে একজনের ওপর অনেক ট্যাক্স ধার্য করা হলো, অথচ তার মতো আরেকজনের ওপর ধার্য করা হয় এর চেয়ে কম। যেহেতু সমকালীন শাসকবর্গ থেকে এই শর্তগুলো যথাযথভাবে পালিত হওয়া মুশকিল মনে হয়, এ জন্য উলামায়ে কেরাম সব সময় এ ধরনের ট্যাক্স বসানোর ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেছেন। প্রয়োজনের সময় কড়া শর্তে অনুমতি দিয়েছেন। যখন তাতারিরা মুসলিম বিশ্বে হামলা করে বসে, এবং যুদ্ধের খরচ মেটানোর জন্য সুলতানের সম্পদ প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তখন তিনি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিছু ঋণ নিতে চান এবং কিছু কর আরোপ করতে চান। এর জন্য তিনি উলামা ও কাজিদের সমাবেশ ডাকেন। সে সময় উলামায়ে কেরামের শিরোমণি ছিলেন হজরত শায়খ ইজজুদ্দীন ইবনে আবদুস সালাম রহ:। তিনি সুলতানকে সম্বোধন করে বলেন, যখন দুশমন মুসলিম দেশের ওপর হামলা করে বসবে, তখন তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সব মুসলমানের জন্য ফরজ। যতটুকু সম্পদ হলে আপনি যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারবেন, ততটুকু আপনি জনগণ থেকে উসুল করতে পারেন (আন-নুজুম আজ-জাহেরা : ৭/৭২-৭৩, তাবাকাতুশ শাফেয়িয়া : ৮/২১৫)। সার কথা হচ্ছে, প্রকৃত প্রয়োজনের সময় প্রয়োজন অনুপাতে ট্যাক্স আরোপের অনুমতি সবাই দিয়েছেন। বরং ইমামুল হারামাইন আল্লামা জুওয়াইনি রহ: নিজামুল মুলক তুসির নির্দেশে যে কিতাব লিখেছেন, সেটি ‘আল-গিয়াসি’ নামে প্রসিদ্ধ। তাতে তিনি এ বিষয়ে কয়েক পরিচ্ছেদে সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। তিনি এটাও বলেছেন যে যদি বায়তুল মালের স্বতন্ত্র প্রয়োজন থাকে, তাহলে ভিন্নভাবেও এ ধরনের ট্যাক্স আরোপ করা যেতে পারে (গিয়াসুল উমাম ফি ইলতিয়াসিজ জলাম, জুওয়াইনি : ২৫৬-২৮৬)। কিন্তু এ বিষয়টি জায়েজ হওয়ার পরও যাতে এই সুযোগের কোথাও ভুল ব্যবহার না হতে পারে, এ জন্য উলামায়ে কেরাম সব সময় সেই আশঙ্কা বিবেচনায় রেখেছেন। বর্তমানের সরকারগুলোকে এমন অনেক সেবা দিতে হয়, যেগুলো আগেকার দিনের সরকারের জিম্মাদারি ছিল না। যেমন দেশে বিদ্যুৎও গ্যাস সরবরাহ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন। অবশ্য অনেক বিভাগ আগেও ছিল; কিন্তু সেগুলোর খরচ এত বেশি ছিল না। বর্তমানে সেগুলোর খরচ বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন, যুদ্ধের জন্য নতুন অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবস্থা, পাকা সড়ক নির্মাণ, যোগাযোগের নতুন মাধ্যম, তথ্য ও প্রচার ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এগুলোর প্রতিটির খরচ নিঃসন্দেহে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার এগুলোর মধ্য থেকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে (হানাফি মাজহাব মতে) জাকাত ও উশরের অর্থ ব্যবহৃত হতে পারে না।
পরিশেষে বলতে চাই, ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে ইসলামের উক্ত নীতিমালা অনুসরণ করেই প্রত্যেক মুসলিমকে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে। কাজেই ব্যবসায়ে জুলুম, ধোঁকাবাজি, জালিয়াতি, প্রতারণা, ঠকবাজি, মুনাফাখোরি কিংবা কোনো নিষিদ্ধ জিনিসের ক্রয়-বিক্রয়, উৎপাদন, বহন ইত্যাদি যা সামাজিক ও নীতি-নৈতিকতাবিরোধী তা অবশ্যই বর্জনীয়। সুতরাং ইসলামী নীতিমালা অনুসরণ করেই ব্যবসা-বাণিজ্য করা শরিয়তের দাবি।
লেখক : ইসলাম বিষয় গবেষক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement