দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনের তুলনা
- জাফর আহমাদ
- ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
দুনিয়ার জীবন নেহায়েত হালকা ও গুরুত্বহীন বিষয়, এর মধ্যে কোনো গাম্ভীর্য নেই এবং নিছক খেল-তামাশা করার জন্য এ জীবনটি তৈরি করা হয়েছে এমনটি মনে করার সুযোগ নেই। তবে দুনিয়ার জীবন ও আখিরাতের জীবনের মধ্যে যখন তুলনা করার প্রশ্ন আসে তখন অবশ্যই আখিরাতের জীবন দুনিয়ার তুলনায় অধিক উত্তম ও ভালো। আল্লাহ বলেন- ‘দুনিয়ার জীবন তো একটি খেল-তামাশার ব্যাপার। আসলে যারা ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে চায় তাদের জন্য আখিরাতের আবাসই ভালো। তবে কি তোমরা বুদ্ধি-বিবেচনাকে কাজে লাগাবে না।’ (সূরা আনআম-৩২) এর মানে হচ্ছে- আখিরাতের যথার্থ ও চিরন্তন জীবনের তুলনায় দুনিয়ার এ জীবনটি ঠিক তেমনি যেমন কোনো ব্যক্তি কিছুক্ষণ খেলাধুলা করে চিত্তবিনোদন করে তারপর তার আসল ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ কারবারে মনোনিবেশ করে।
তা ছাড়া একে খেলাধুলার সাথে তুলনা করার কারণ হচ্ছে এই যে, এখানে প্রকৃত সত্য গোপন থাকার ফলে যারা ভেতরে দৃষ্টি না দিয়ে শুধু বাইরের টুকু দেখতে অভ্যস্ত তাদের জন্য বিভ্রান্তির শিকার হওয়ার বহুতর কারণ বিদ্যমান। এসব বিভ্রান্তির শিকার হয়ে মানুষ প্রকৃত সত্যের বিরুদ্ধে এমন সব অদ্ভুত ধরনের কর্মপদ্ধতি ও কর্মনীতি অবলম্বন করে যার ফলে তাদের জীবন নিছক একটি খেল-তামাশার বস্তুতে পরিণত হয়। যারা গভীরে গিয়ে প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে পারে তাদের জীবন খেল-তামাশার পরিবর্তে সার্থক ও সফল হয়। আর যারা অন্ধত্বকেই বরণ করে নিয়েছে তারা অন্ধের মতোই জীবন পার করে এবং এটিকেই জীবনের সফলতা মনে করে। সত্যিকার অর্থে তাদের জন্যই দুনিয়ার জীবন খেল-তামাশার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
দুনিয়া ও আখিরাত একে অন্যের পরিপূরক। একটি ছাড়া অন্যটির সফলতা আশা করা যায় না। আখিরাতের অনন্ত জীবনে সুখের আবাস গড়তে হলে দুনিয়ার জীবনকে আল্লাহর নির্দেশ ও রাসূলুল্লাহ সা:-এর প্রদর্শিত পথে পরিচালনা করতে হবে। দুনিয়ার জীবন পুঁজি সংগ্রহের জায়গা আর আখিরাত হচ্ছে হিসাব দেয়ার জায়গা। সেখানে শুধু হিসাব আর হিসাবই নেয়া হবে। সুতরাং অনন্ত জীবনের জন্য পুঁজি সংগ্রহের সব রাস্তা বন্ধ হওয়ার আগেই যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। খেল-তামাশার দোহাই দিয়ে দুনিয়াকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ আয়াতের বাহ্যিক দিকের ওপর লক্ষ্য রেখে কেউ ইচ্ছা করলেই এক লম্ফ দিয়ে আখিরাতে পৌঁছে যেতে পারবে না। তাকে এ দুনিয়ায় আল্লাহ যে কয়েক দিন চান থাকতে হবে এবং অনন্ত জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করতে হবে। এখন কেউ যদি আখিরাতের কথা ভুলে গিয়ে দুনিয়ার প্রতি মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ে এবং নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনের সুখের জন্য হালাল-হারামকে মাড়িয়ে পাগলের মতো চলতে থাকে এবং সামগ্রীকভাবে দুনিয়াকেই প্রাধান্য দেয় তার জন্য এ দুনিয়ার জীবন খেল-তামাশার ব্যাপারই বটে।
দুনিয়া ও আখিরাত উভয়টিকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। কোনো জীবনকেই অবহেলা করা যাবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘তাদের মধ্যে কেউ এমন আছে যে বলে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়ায় সব কিছু দিয়ে দাও। এ ধরনের লোকের জন্য আখিরাতে কোনো অংশ নেই। আবার কেউ বলে, হে আমাদের রব! আমাদের দুনিয়ায় কল্যাণ দাও এবং আখিরাতেও কল্যাণ দাও এবং আগুনের আযাব থেকে আমাদের বাঁচাও।’ (সূরা বাকারা : ২০০-২০১) যারা শুধু দুনিয়াই চায় তাদের আখিরাতের জীবন বরবাদ হয়ে যায়। অর্থাৎ সেখানে তাদের শাস্তি ছাড়া আর কিছুই ভাগ্যে জুটবে না। আর যারা ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের অনুসারী তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের উভয় জীবনে কল্যাণ রয়েছে। যেমন- আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘যারা কুফরির পথ অবলম্বন করেছে তাদের জন্য দুনিয়ার জীবন বড়ই প্রিয় ও মনোমুগ্ধকর করে সাজিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ধরনের লোকেরা ঈমানের পথ অবলম্বনকারীদের বিদ্রƒপ করে। কিন্তু কিয়ামতের দিন তাকওয়া অবলম্বনকারীরাই তাদের মোকাবেলায় উন্নত মর্যাদায় আসীন হবে। আর দুনিয়ার জীবিকার ক্ষেত্রে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত দান করে থাকেন।’ (সূরা বাকারা-২১২) এখানে দুনিয়ার জীবনকে অবহেলা করা হয়নি; বরং এখানে যারা কুফরির পথ অবলম্বন করবে তাদেরকে দুনিয়ার প্রতি এতটাই ঝুঁকিয়ে দেয়া হবে যে, আখিরাতের চিন্তা তাদের মাথায় কখনো আসবে না। ফলে আখিরাতে তাদের জন্য জ্বলন্ত অগ্নিই হবে উপযুক্ত পুরস্কার। পক্ষান্তরে দুনিয়ার জীবনে যারা তাকওয়ার পথ অবলম্বন করে জীবন যাপন করবে আখিরাতের জীবনে তারা উন্নত মর্যাদা লাভ করবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আসলে এ কুরআন এমন পথ দেখায় যা একেবারেই সোজা। যারা একে নিয়ে ভালো কাজ করতে থাকে তাদের সে সুখবর দেয় এ মর্মে যে, তাদের জন্য বিরাট প্রতিদান রয়েছে। আর যারা আখিরাত মানে না, তাদের এ সংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য আমি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছি।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৯-১০)
আখিরাতপ্রত্যাশীরা যে দুনিয়া পূজারীদের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী এ পার্থক্যটা এ দুনিয়াতেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। এ পার্থক্য এ দৃষ্টিতে নয় যে, এদের খাবার-দাবার, পোশাক-পরিচ্ছদ, গাড়ি-বাড়ি ও সভ্যতা-সংস্কৃতির ঠাটবাট ও জৌলুস ওদের চেয়ে বেশি; বরং পার্থক্যটা এখানে যে, এরা যা কিছু পায় সততা, বিশ্বস্ততা ও ঈমানদারির সাথে পায় আর ওরা যা কিছু লাভ করে জুলুম, নিপীড়ন, ধোঁকা, প্রতারণা, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, উৎকোচ, বেঈমানি এবং নানান হারাম পথ অবলম্বনের কারণে লাভ করে। তার ওপর আবার এরা যা কিছু পায় ভারসাম্যের সাথে খরচ করে। অর্থাৎ কৃপণতা ও অপচয় থেকে বিরত থাকে। এ থেকে হকদারদের হক আদায় করে এবং বঞ্চিত ও প্রার্থীদের অংশও দেয়া হয়। আবার এ থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টির অর্জনের লক্ষ্যে অন্যান্য সৎ কাজেও অর্থ ব্যয় করা হয়। পক্ষান্তরে দুনিয়া পূজারীরা যা কিছু পায় তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিলাসিতা, বিভিন্ন হারাম এবং নানান ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কাজে ব্যয় করে।
এভাবে সব দিক দিয়েই আখিরাতপ্রত্যাশীদের জীবন তাকওয়া বা আল্লাহভীতি ও নৈতিকতার এমন আদর্শ হয়ে থাকে যা তালি দেয়া কাপড় এবং ঘাস ও খড়ের তৈরি কুঁড়েঘরেও এমনই ঔজ্জ্বল্য বিকীরণ করে, যার ফলে এর মোকাবেলায় প্রত্যেক চক্ষুষ্মানের দৃষ্টিতে দুনিয়া পূজারীদের জীবন অন্ধকার মনে হয়। এ কারণেই বড় বড় পরাক্রমশালী বাদশাহ ও ধনাঢ্য আমিরদের জন্যও তাদের সগোত্রীয় জনগণের হৃদয়ে কখনো নিখাদ ও সাচ্চা মর্যাদাবোধ এবং ভালোবাসা ও ভক্তির ভাব জাগে না। অথচ এর বিপরীতে ভক্ত, অনাহারী ছিন্ন বস্ত্রধারী, খেজুর পাতার তৈরি কুঁড়েঘরের অধিকারী আল্লাহভীরু মর্দে মুজাহিদের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিতে মানুষ কোনোই কুণ্ঠাবোধ করে না। এমনকি দুনিয়া পূজারীরাও তাদের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘কিন্তু দেখো, দুনিয়াতেই আমি একটি দলকে অন্য একটির ওপর কেমন শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে রেখেছি এবং আখিরাতে তার মর্যাদা আরো অনেক বেশি হবে এবং তার শ্রেষ্ঠত্বও আরো অধিক হবে।’ (সূরা বনি ইসরাইল-২১)
কুরআনের মূল দাওয়াত হচ্ছে এই যে, দুনিয়ার জীবনের বাইরের দিকটি দেখে প্রতারিত হইও না। এখানে কোনো হিসাব ও জবাব গ্রহণকারীর অস্তিত্ব দৃষ্টিগোচর না হলেও এ কথা মনে করা যাবে না যে, নিজের কাজের ব্যাপারে কোনো জবাবদিহি করতে হবে না। এখানে কুফর, শিরক, নাস্তিক্যবাদ, তাওহিদ ইত্যাদি সব রকমের মতবাদ স্বাধীনভাবে পালন করতে পারেন এবং এর ফলে পার্থিব দৃষ্টিতে কোনো বিশেষ পার্থক্য দেখা যায় না বলে মনে করতে পারেন কিন্তু এ কথা মনে করবেন না যে, তাদের আলাদা ও স্থায়ী ফলাফলই নেই। আসলে মৃত্যুর-পরবর্তী জীবনে হিসাব নেয়া ও জবাবদিহি করা সব কিছুই থাকবে। আসল ও চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পাবে মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে এবং এ বাহ্যিক পর্দার পেছনে যে সত্য লুকিয়ে আছে তা সেখানে প্রকাশিত হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যখন কুরআন পড়ো তখন আমি তোমার ও যারা আখিরাতের প্রতি ঈমান আনে না তাদের মাঝখানে একটি পর্দা ঝুলিয়ে দেই।’ (সূরা বনি ইসরাইল-৪৫)
লেখক : প্রবন্ধকার ও গবেষক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা