৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬ পৌষ ১৪৩১, ২৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

কত সুন্দর স্রষ্টা ও সৃষ্টি

-


হাজারো সৃষ্টির মধ্যে মূর্ত হয়ে আছে মহীয়ান গরিয়ান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পরম পরিচয়। দিবালোকের তেজোদীপ্ত প্রখর আলোয় আলোকিত বিশ্ব আর চাঁদ-তারা ঝলমলে রাত্রির বিশাল আকাশের দিকে তাকালে অনুভূত হয় কত সুন্দর স্রষ্টা ও তার সৃষ্টি। এ কথা ধ্রুব সত্য যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সমগ্র সৃষ্টিকুলকে সর্বাধিক সৌন্দর্যমণ্ডিত করে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তাই তো কুরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা জোর দিয়ে বলেছেন- ‘অবশ্যই আমি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে পয়দা করেছি।’ (সূরা ত্বিন-৪)

প্রকৃতির বুকে অন্যান্য সৃষ্টির সৌন্দর্যও আল্লাহ তায়ালা নিজে বর্ণনা করেছেন। কুরআনুল কারিমের সূরা গাশিয়ার ১৭ থেকে ২০ ছোট্ট চারটি আয়াতে আল্লাহ জাল্লা শানুহু বর্ণনা করেন-‘তারা কি উটনীকে দেখে না কিভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে, আকাশমণ্ডলকে দেখে না কিভাবে তাকে উচ্চে স্থাপন করা হয়েছে, পর্বতমালাকে দেখে না কিভাবে তাকে জমিনের বুকে পুঁতে রাখা হয়েছে এবং পৃথিবীকে দেখে না কিভাবে তাকে বিছানো হয়েছে?’ উল্লিখিত আয়াতে কারিমার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালার কত অসীম শক্তিমত্তা, অনুপম বিচক্ষণতা, চমকপ্রদ সৃষ্টিনৈপুণ্য এবং অতুলনীয় প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য বিরাজমান, আর দৃশ্যমান জীবনের পরে যে আরো একটি জীবন রয়েছে, এই পৃথিবীর অবস্থা থেকে ভিন্ন যে আরো অবস্থা রয়েছে মৃত্যুর মাধ্যমে যে বিলুপ্তি ঘটে তা চরম বিলুপ্তি নয়।

উপরে বর্ণিত আয়াতে বলা হয়েছে- আকাশ, পৃথিবী, পাহাড় ও উটের কথা (সব প্রাণীর প্রতিনিধি হিসেবে)। উটের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তার দেহ-সৌষ্ঠবে আরবদের কাছে তার মূল্য ও মর্যাদার একটি অসাধারণ গুরুত্ব রয়েছে। এই প্রাকৃতিক উপাদানগুলো মানুষের কাছে সর্বত্র উন্মুক্ত তা সে যেখানেই থাক না কেন। আকাশ, পৃথিবী, পাহাড় ও প্রাণী সর্বত্র বিদ্যমান জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা-সংস্কৃতিতে যতটুকুই দখল মানুষের থাক না কেন, এ কয়টি উপাদান তার জগৎ ও চেতনায় অন্তর্ভুক্ত থাকবেই এবং এ জিনিসগুলোর তাৎপর্য নিয়ে যখন সে চিন্তা-ভাবনা করবে, তখন অন্তরালে কী আছে, তা সে বুঝতে পারবে। এর প্রত্যেকটিতে অতি প্রাকৃতিক ও অলৌকিক উপাদান নিহিত রয়েছে। এ জিনিসগুলোতে আছে স্রষ্টার কারিগরি নৈপুণ্যের এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত। এ একটি বিষয়ই প্রাথমিক আকিদার দিকে ইঙ্গিত করার জন্য যথেষ্ট।

এ জন্য কুরআন সমগ্র মানবজাতির দৃষ্টি এ দিকে আকৃষ্ট করে। ‘তারা কি উটনীর দিকে তাকায় না কিভাবে তা সৃজিত হয়েছে?’ উট আরব জাতির প্রথম ও প্রধান জন্তু; এর মাধ্যমে তারা চলাচল ও মালপত্র বহন করে। এর গোশত খায় ও দুধ পান করে। এর পশম দিয়ে পোশাক ও চামড়া দিয়ে তাঁবু বানায়। কাজেই এটি জীবনের প্রধান ও প্রাথমিক উপাদান। এর এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অন্য কোনো জন্তুর নেই। এত শক্তিমান ও এত বিশালাকৃতির জন্তু হওয়া সত্ত্বেও তা এত বিনয়ী ও অনুগত যে, একটি শিশুও তার লাগাম ধরে টানলে তার পিছু পিছু চলতে থাকে? এত বিরাট উপকারী ও সেবাদানকারী জন্তু হওয়া সত্ত্বেও তার জন্য মানুষের অতি সামান্যই ব্যয় হয়, তার খাদ্য ও বিচরণক্ষেত্র সহজলভ্য? ক্ষুধায়, পিপাসায়, পরিশ্রমে ও দুর্যোগে এর মতো ধৈর্যশীল ও কষ্টসহিষ্ণু গৃহপালিত জন্তু আর নেই। বিরাজমান প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলাও তার এক অসাধারণ শারীরিক ক্ষমতা। এসব কারণে কুরআন মানুষের দৃষ্টি উটনীর সৃষ্টিবৈচিত্র্যের দিকে আকৃষ্ট করে। এটি তাদের চোখের সামনেই রয়েছে? এ নিয়ে তাদের কোনো জ্ঞান আহরণের প্রয়োজন নেই। ‘তারা উটনীকে দেখে না কিভাবে তা সৃজিত হয়েছে?’ অর্থাৎ- এর সৃষ্টি ও গঠন প্রক্রিয়া কি দেখে না এবং ভাবে না যে, কিভাবে তাকে তার কর্মের এত উপযোগী করে সৃষ্টি করা হয়েছে, যার কারণে সে তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য অর্জনে পুরোপুরি সফল এবং তার পরিবেশ ও করণীয় কাজের সাথে পুরোপুরি সমন্বিত! তারা তো একে সৃষ্টি করেনি। উটনী নিজেও নিজেকে সৃষ্টি করেনি। সুতরাং এটিই অকাট্যভাবে প্রমাণ করছে যে, তা এক অতুলনীয় নিপুণ কুশলী স্রষ্টার সৃষ্টি।

উটনী সেই স্রষ্টার অস্তিত্বেরই সাক্ষী; মহান আল্লাহর পরিকল্পনা ও পরিচালনা দ্বারা যেমন এটি প্রমাণিত হয়, তেমনি এই জন্তুটির সৃষ্টি দ্বারাও তা প্রমাণিত হয়। (ফি জিলালিল কুরআন)
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষের অজ্ঞতা দূর করে তাদের আরো সচেতন করতে কুরআন মাজিদে উল্লেখ করেছেন-‘আল্লাহ তায়ালাই তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে ও আকাশকে ছাদস্বরূপ এবং তিনি তোমাদের আকৃতি গঠন করেছেন, ফলে কতই না সুন্দর তোমাদের আকৃতি এবং তোমাদের দান করেছেন উৎকৃষ্ট রিজিক; এই আল্লাহই তোমাদের রব! আর বিশ্ব-জগতের রব, আল্লাহ কতই না বরকতময়।’ (সূরা আল মুমিন-৬৪)
মানুষের সুন্দর আকার-আকৃতি, তার জীবনের শত সহস্র সাফল্য অর্জন, ধনসম্পদ, অজস্র নিয়ামত সব মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দয়ার দান। কোনো কিছু নিয়ে কারো অহঙ্কার করার অধিকার ও অবকাশ নেই।

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, নবী সা: বলেছেন, ‘যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহঙ্কার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, মানুষ চায় যে, তার পোশাক সুন্দর হোক, তার জুতা সুন্দর হোক, এ-ও কি অহঙ্কার? রাসূল সা: বললেন, ‘আল্লাহ সুন্দর, তিনি সুন্দরকে ভালোবাসেন। প্রকৃতপক্ষে অহঙ্কার হচ্ছে দম্ভভরে সত্য ও ন্যায় অস্বীকার করা এবং মানুষকে ঘৃণা করা।’ (মুসলিম ১৬৬)
কত সুন্দর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন, কত সুন্দর তার সৃষ্টি; কত চমৎকার-নিপুণ তার অপূর্ব পরিকল্পনা আর অনিন্দ্য পরিচালনা! দয়াময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষের মন-মননে অভূতপূর্ব ও অপার্থিব আলোড়ন জাগানিয়া বাণীসম্ভারে চৈতন্য জাগরূক করেন কত ভালোবাসার ছোঁয়ায়! মানুষের মনের মণিকোঠায় সর্বোত্তম উপমা-উৎপ্রেক্ষা ও সতত সুবর্ণ রেখা অঙ্কন করে তিনি মানুষকে কাছে ডাকেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে আল্লাহ তায়ালার পরিচয় লাভ করা যায়। কুরআন মাজিদে আল্লাহ জাল্লা শানুহু বলেন- ‘এসব লোকেরা কি তাদের মাথার উপর (দিয়ে উড়ে যাওয়া) পাখিগুলোকে দেখে না? (কিভাবে এরা) নিজেদের পাখা মেলে রাখে, (আবার) একসময় (তা) গুটিয়েও নেয়। (তখন) পরম দয়ালু আল্লাহ তায়ালা-ই এদের (মহাশূন্যে) স্থির করে রাখেন (হ্যাঁ, একমাত্র আল্লাহ তায়ালা-ই); তিনি (তাঁর সৃষ্টির ছোট-বড়) সব কিছুই দেখেন।’ (সূরা আল-মুলক-১৯)
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement