২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

কুলিয়ারচরে মসজিদ ও মাজার ভাঙচুরসহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২টি মামলা

আসামি ৮ শতাধিক, গ্রেফতার ৯
কুলিয়ারচরে মসজিদ ও মাজার ভাঙচুরসহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২টি মামলা - ছবি : নয়া দিগন্ত

কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে ‘জশনে জুলুস’ মিছিলকে কেন্দ্র করে হত্যা, মসজিদ, মাজার, দোকানপাট ও বাড়িঘরে হামলা ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় ৮ শতাধিক লোককে আসামি করে কুলিয়ারচর থানায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে।

মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাতে মসজিদে হামলা, ভাঙচুর, মারধর ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এ মামলা হয়।

উপজেলার বড় ছয়সূতী গ্রামের মরহুম তাহের উদ্দিনের ছেলে মো: হানিফ মিয়া (৬৭) সৈয়দ ফয়জুল আল আমিনকে (৪৮) প্রধান আসামি করে ৬৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ২৫০ জনের নামে কুলিয়ারচর থানায় এ মামলা করেন।

মামলায় এজাহারভূক্ত আসামি ছয়সূতী গ্রামের মরহুম সৈয়দ মঞ্জুরুল হামিদের ছেলে সৈয়দ ফয়জুল আল আমিন (৪৮), সৈয়দ ফয়জুল মুরসালিন (৪৪), মো: ছেনু মিয়ার ছেলে মো: রাজু মিয়া (২৪), মো: হানিফ মিয়ার ছেলে মো: শাহিদ মিয়া ওরফে শহিদ (২৩), রঙ্গু ভূইয়ার ছেলে আমির মিয়া (৪০), খুর্শিদ খানের ছেলে চাঁন মিয়া (৪০), ছোট ছয়সূতী গ্রামের শুক্কর আলীর ছেলে শফিকুল মিয়া (৪০), তদন্তেপ্রাপ্ত সন্দিগ্ধ ছয়সূতী প্রতাপনাথ বাজারের মো: সিদ্দিক মিয়ার ছেলে মো: তুষার মিয়া (১৮) ও ছোট ছয়সূতী পূর্বপাড়া গ্রামের মো: রিয়াজ উদ্দিনের ছেলে মো: রকি মিয়াকে (২০) গ্রেফতার করে পরদিন ১৭ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার দুপুরে কিশোরগঞ্জ বিজ্ঞ আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করেছে পুলিশ।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ‘গত ১৬ সেপ্টেম্বর বেলা অনুমান পেনে ১২টার সময় আসামিগণ পূর্ব পরিকল্পিতভাবে বেআইনি জনতাবদ্ধে দাঙ্গার উদ্দেশ্যে দেশীয় মারাত্মক অস্ত্রাদি নিয়া ছয়সূতী বাসস্ট্যাড কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আসিয়া মসজিদের দরজা জানালা কোপাইয়া ও বাইডাইয়া ভাঙচুর করে। এ সময় মীর মো: আরিফ মিলন, মুফতি আবু লায়েছ, মো: রেদোয়ান ও শাহীন মিয়া মসজিদ ভাঙচুর করিতে বাধা নিষেধ দিলে তারা মীর মো: আরিফ মিলন, মো: রেদোয়ান, মুফতি আবু লায়েছ ও শাহীন মিয়াকে মারধর করে। পরে স্থানীয়রা আহত মীর মো: আরিফ মিলনকে উদ্ধার করে ভাগলপুর জহুরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক আরিফ মিলনকে মৃত ঘোষণা করেন।

অপরদিকে মাজার, দোকানপাট ও বাড়িঘর ভাংচুরের ঘটনায় জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম কুলিয়ারচর মাদরাসার প্রিন্সিপাল মুফতি আব্দুল কাইয়ুম খাঁনকে (৬০) প্রধান আসামি করে ২৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত নামা ৫০০ জনের নামে কুলিয়ারচর থানায় একটি মামলা রুজু হয়েছে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলার ছয়সূতী গ্রামের সৈয়দ আবু মোহাম্মদ মঞ্জুরুল হামিদের ছেলে সৈয়দ ফয়জুল আল আমিন (৪৮) এ মামলা করেন।

মামলায় উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন মাওলানা মো: হানিফ (৬৫), মাওলানা ইব্রাহিম (৫৫), মাওলানা আহাম্মদ আলী (৪৫), মাওলানা লায়েছ (৬৫), মাওলানা আসাদুল্লাহ (৫৬), মো: ফরিদ মিয়া (৩০), আতাউর রহমান (৪০), মনজিল মিয়া (৩৭) ও আঙ্গুর মিয়া (৪৫)।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ‘গত ১৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে ছয়সূতী গাউছিয়া দরবার শরিফের ভক্তবৃন্দগণ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের জশনে জুলুসের মিছিলে অংশগ্রহণ করায় আসামিরা ক্ষিপ্ত হয়। এই আক্রোশে আসামিগণ পরিকল্পিতভাবে বেআইনী জনতাবন্ধে দাঙ্গার উদ্দেশ্যে দেশীয় অস্ত্রাদি নিয়ে ছয়সূতী দরবার শরিফে প্রবেশ করিয়া মুফতি আবদুল কাইয়ু খাঁনের নির্দেশে দরবার শরিফে হামলা ও ভাঙচুর করে এবং দরবার শরিফে থাকা অন্য কয়েটি খানকা ঘর ভাঙচুর করে। এছাড়া ঘরে থাকা অন্য জিনিসপত্র লুটপাট করিয়া নিয়া যায়। পরে তারা দরবার শরীফ-সংলগ্ন ছয়সূতী প্রতাব নাথ বাজারে প্রবেশ করিয়া রূপ বানু ও রিয়াজ উদ্দিনের দোকানপাট ভাঙচুর ও লুটপাট করে তাদের মারধর করে। এ সময় মনির ভূইয়াকেও মারধর করে তারা। পরে আসামিরা ছিদ্দিক মিয়ার বাড়ীতে প্রবেশ করিয়া হামলা ও ভাঙচুর করে মারধোর ও লুটপাট করে এবং হুমকি ধামকি দেয়। গাউছিয়া দরবার শরিফে আঘাত করিয়া ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত করে। পরে স্থানীয়রা আহত রুপবানু ও মনির ভূইয়াকে কুলিয়ারচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে চিকিৎসা করান। বাদি চিকিৎসাধীন থাকায় মো: মহসিনের (৫০) মাধ্যমে থানায় অভিযোগ পাঠান তিনি।’

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কয়েক বছর ধরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত ও ইমাম উলামা পরিষদ পৃথক পৃথকভাবে ছয়সূতী ইউনিয়নে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্‌যাপন করে আসছে। মাজারপন্থী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত সংগঠনের সদস্যরা জশনে জুলুস কর্মসূচি পালন করে। মাজার বিরোধী অপর পক্ষ সিরাদুন্নবী সা: নামে পৃথক কর্মসূচি পালন করে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পক্ষ থেকে বুধবার ছয়সূতি গাউছিয়া দরবার শরিফে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজনের প্রস্তুতি নেয়। ওয়াজ মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা মুফতি গিয়াস উদ্দিন আত-তাহেরীর। তার আগমণের কথা শুনে ক্ষুব্ধ উপজেলা ইমাম ওলামা পরিষদের নেতারা। তাহেরীর আগমণন ঠেকাতে তারা উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাবিহা ফাতেমাতুজ-জোহরার কাছে একটি লিখিত আবেদন করেন। বিষয়টি সুরাহার জন্য কুলিয়ারচর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো: সারোয়ার জাহানকে দায়িত্ব দেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। ওসি গত রোববার আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নেতাদের সাথে সভা করে ওয়াজ মাহফিল স্থগিত করান। এ অবস্থায় ইমাম ওলামা পরিষদ সোমবার সকাল ১০টায় ছয়সূতি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সিরাদুন্নবী সা: কর্মসূচি ঘোষণা করেন। একই সময় জশনে জুলুশের মিছিল বের করার ঘোষণা দেয় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত। ওসির মধ্যস্থতায় ইমাম ওলামা পরিষদের সকাল ১০টার কর্মসূচি স্থগিত করে কর্মসূচির পরবর্তী সময় নির্ধারণ করে দেন ওই দিন বিকেলে।

পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী সকাল ১০ টার দিকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পক্ষ থেকে সৈয়দ আবু মোহাম্মদ মঞ্জুরুল হামিদের ছয়সূতী গাউছিয়া দরবার শরীফ থেকে ঈদে মিল্লাদুন্নবীর জশনে জুলুসের মিছিল বের করে মাধবদী হয়ে ছয়সূতী বাসস্ট্যাণ্ডের দিকে আসার পথে পুলিশ ও সেনাবাহিনী তাদের বাধা দেয়। এ সময় জশনে জুলুস মিছিল থেকে কিছু লোক পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বাধা অতিক্রম করে ছয়সূতী বাসস্ট্যান্ড কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে এসে মসজিদে অবস্থানরত মাদরাসার শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ও মসজিদ ভাঙচুর করে। বাসস্ট্যাণ্ডের ব্যবসায়ীরাসহ স্থানীয় মুসল্লি, মসজিদ মাদরাসার আলেম-ওলামা ও ছয়সূতী ইউনিয়ন বিএনপির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সিনিয়ার সহ-সভাপতি মো: মীর আরিফ মিলন হামলাকারীদের বাধা নিষেধ দেয়। বাধা দিতে গেলে হামলাকারীরা মো: মীর আরিফ মিলনের ওপর হামলা করে তাকে মারধর করে। এ সময় ইটপাটকেলের আঘাতে ছয়সূতী খাদেমুল ইসলাম হোসাইনিয়া হাফিজিয়া মাদরাসার ছাত্র ছয়সূতী বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মো: হানিফ মিয়ার ছেলে রেদোয়ান ও নিজগাঁও মসজিদের মুয়াজ্জিন চক্ষু প্রতিবন্ধী (অন্ধ) মো: শাহিন আহত হয়। আহতদের মধ্যে মো: মীর আরিফ মিলনকে উদ্ধার করে ভাগলপুর জহুরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তবর‍্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত দুই ছাত্রকে উদ্ধার করে কুলিয়ারচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে ভর্তি করা হয়।

পরে উত্তেজিত জনতা ও মাদরাসার শিক্ষক শিক্ষার্থীরা
গাউছিয়া দরবার শরিফে হামলা ও ভাঙচুর করে। এছাড়া তারা প্রতাপনাথ বাজারে বেশ কয়েটি দোকানপাট ও বাড়ি ঘর ভাঙচুর ও লুটপাট করে কয়েকজনকে মেরে আহত করে।

ঘটনারপর থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এ রিপোর্ট লিখা পর্যন্ত এলাকায় অসংখ্য সেনাবাহিনীর সদস্য ও পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।।

কুলিয়ারচর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো: সারোয়ার জাহান বলেন, মসজিদে হামলা, মারধোর ও হত্যার অভিযোগে থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। মামলায় অভিযুক্ত সাতজন ও ঘটনার সাথে সন্দিগ্ধ দু’জনকে গ্রেফতার করে কিশোরগঞ্জ বিজ্ঞ আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। অপর দিকে মাজার, দোকানপাট ও বাড়িঘর ভাঙচুর ও মারধোরের ঘটনায় আরো একটি মামলা রুজু হয়েছে। দুটি মামলার আসামিদের সনাক্ত করে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।


আরো সংবাদ



premium cement