লাশে পচন ধরে, কবর দেয়ারও জায়গা হয় না
সাভারের বেদেপল্লীর একাল-সেকাল (৩)- শাহেদ মতিউর রহমান
- ০৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ১১:৩৪
পরিবারের কেউ মারা গেলে কবর দেয়ার জায়গাও খুঁজে পায় না সাভারের বেদে পল্লীর বাসিন্দারা। হঠাৎ করে কেউ মারা গেলে তার লাশ দাফন করতে দু’দিন পর্যন্তও অপেক্ষা করতে হয় স্বজনদের। বেদে পল্লীতে নিজেদের আলাদা কোনো কবরস্থান না থাকায় পাশের কিংবা অন্য কোনো গ্রামে নিয়ে লাশ দাফন করতে হয় তাদের। কবরের জায়গা খুঁজতে গিয়ে অনেক সময়ে লাশে পচনও ধরে। অবশ্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নিলে বেদে পল্লীর পাশেই বংশী নদীর তীরে সরকারি জমিতে বালু ভরাট করেই বেদে সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক একটি গোরস্থান করা সম্ভব হবে মনে করে স্থানীয়রা।
বাপ-দাদার আদিম পেশা হিসেবে সাপ ধরা, সাপের খেলা দেখানো ও ঝাড়- ফুঁকের সাথে জড়িত এখানকার কয়েক হাজার পরিবার। সারা বছরই এসব পরিবারের পুরুষ ও মহিলা সদস্যরা দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে পরিবারের ভরণপোষণ করে। অনেক পরিবারের সন্তানরা এখানে থেকেই স্থানীয় স্কুলে পড়াশোনা করে। তবে বয়োবৃদ্ধ সদস্যরা বাড়ির বাইরে যায় না। তারা গ্রামের বাজার ও দোকানে বসেই সময় কাটায়।
সম্প্রতি সাভারের বেদে পল্লীর জীবন বৈচিত্র্য নিয়ে প্রতিবেদন করতে সরেজমিন সেখানকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল, নিজস্ব কবরস্থান না থাকায় মৃত ব্যক্তির লাশ দাফন নিয়ে কতটা ভোগান্তির শিকার হতে হয় এখানকার লোকজনদের। অনেক সময় কবরস্থানের জায়গার অভাবে লাশ ঘরে রেখে অন্য গ্রামে গিয়ে কবরের জায়গা খুঁজতে হয়। গ্রামের বাইরের কোনো কবরস্থানে লাশ দাফন করতে গেলে অনেক সময় বাইরের ওই কবরস্থানের জন্য আর্থিক অনুদান দিয়ে তারপর লাশ দাফনের অনুমতি নিতে হয়। দরিদ্র পরিবারের কেউ মারা গেলে চাঁদা তুলে তারপর লাশ দাফনের বন্দোবস্ত করতে হয়।
আরো পড়ুন:
সাপুড়েদের সময় কাটে আড্ডা আর তাসে
সাভার নামা বাজারের উত্তর দিকে বংশী নদীর পূর্বপাড়ে বেদেদের বসবাস। চারটি জেটিতে (মহল্লায়) মূলত বেদেরা বাস করে। ছোট অমরপুর, বড় অমরপুর, কানপুর ও পোড়াবাড়ি। স্থানীয়দের দাবি চারটি জেটিতে বা মহল্লায় ১৫ হাজারের বেশি বেদে বাস করে। হিসাব করলে এই সংখ্যা দাঁড়াবে ছয় থেকে সাত হাজার পরিবার। তবে সারা বছরই বেদেরা থাকে এলাকার বাইরে। শুধু দুই ঈদে তারা গ্রামে আসে।
বেদে পল্লীর ছোট অমরপুর (মধ্যপাড়া) জেটির কালু সরদার নয়া দিগন্তকে জানান, অনেক লোকের বাস এখানে। কিন্তু এখানে কোনো কবরস্থান নেই। ফলে কেউ মারা গেলে লাশ ঘরে রেখে আমাদের কবর দেয়ার জায়গা খুঁজতে বের হতে হয়। এক দিকে মৃতের জন্য শোক অন্য দিকে কবরের জায়গা খোঁজার ঝামেলা। এটা আমাদের দুঃখকে আরো ভারী করে তোলে।
বেদে পল্লীর মধ্যভাগে অবস্থিত পোড়াবাড়ি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা মেরাজুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে জানান, নিজস্ব কবরস্থান না থাকায় এখানে কেউ মারা গেলে লাশ কাঁধে নিয়ে ঘুরতে হয় অথবা লাশ ঘরে রেখে কবর দেয়ার জায়গা খুঁজতে বের হতে হয়। গ্রামের বাইরে নিয়ে গিয়ে লাশ দাফন করতে হলে কিছু অর্থকড়িরও দরকার হয়। তাই গরিব পরিবারের কেউ মারা গেলে চাঁদা তুলে ওই লাশ দাফন করতে হয় স্বজনদের। প্রতিবেশী কিংবা অন্যদের আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া অনেক সময়ে গরিব কারো লাশ দাফনও যেন কঠিন হয়ে পড়ে।
বেদে পল্লীর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের কয়েকজন মুসল্লি জানান, এই মসজিদের পেছনে বংশী নদীর পূর্বপাড় পর্যন্ত কিছু খালি জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন আছে। এই জমি নিচু হওয়ার কারণে গোরস্থান করার মতো উপযোগী নয়। তবে সরকারি অনুদান কিংবা দানশীল ব্যক্তিদের সহায়তা নিয়ে বাকি কিছু জমি কিনে সেখানে বালু ভরাট করা যেতে পারে। কিছু জমি বিনা মূল্যে দান করবে এমন দানশীল ব্যক্তিও আমাদের মধ্যেই পাওয়া যাবে। সাভারের এই বেদে পল্লী সাভার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে অবস্থিত। বেদে পল্লীতে স্থানীয়দের চাহিদা অনুযায়ী এখানে একটি পৃথক কবরস্থান করার বিষয়ে স্থানীয় ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছেও দাবি জানিয়েছেন বেদে সরদাররা।
এদিকে নয়া দিগন্তের পক্ষ থেকে সাভার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিনহাজ উদ্দিন মোল্লার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। শুক্রবার বিকেলে কাউন্সিলরের ভাই পরিচয়ের এক স্বজন জানান, কাউন্সিলর মিনহাজ উদ্দিন মোল্লা এখন চিকিৎসার জন্য ভারতে আছেন। তিনি দেশে আসার পর এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে পারবেন।