০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৬ মাঘ ১৪৩১, ৯ শাবান ১৪৪৬
`

গাজীপুরে ‘ভাঙচুর’ ঠেকাতে ছাত্রদের ডেকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হামলা : গ্রেফতার ১৬, থানার ওসি প্রত্যাহার

- ছবি : সংগৃহীত

গাজীপুরে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়ি ‘ভাঙচুর’ ঠেকাতে ছাত্রদের ডেকে নিয়ে ‘ডাকাত’ আখ্যা দিয়ে পরিকল্পিতভাবে হামলা করা হয়েছে। এ ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠছে গাজীপুর। ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ ও গ্রেফতারের ভয়ে সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়ির আশপাশের এলাকা পুরুষশূণ্য হয়ে পড়েছে।

শুক্রবার রাতে যে তিনটি মসজিদ থেকে ‘মন্ত্রীর বাড়িতে ডাকাত ঢুকেছে’ বলে মিথ্যা ঘোষণা দেয়া হয়েছিল ওই তিন মসজিদেও শনিবার কাউকে পাওয়া যায়নি। মসজিদে গতকাল কেউ নামাজ পড়তেও যাননি। গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের পরিকল্পনায় ছাত্রদের ওপর এ হামলার ঘটনা ঘটনানো হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে খবর পেয়েও ছাত্রদের উদ্ধারে ঘটনাস্থলে যথা সময়ে না যাওয়ায় গাজীপুর মেট্রো সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আরিফুর রহমানকে প্রত্যাহার করা হয়েরেছ। পরিকল্পিত এ হামলার প্রতিবাদে শনিবার গাজীপুর রাজবাড়ি মাঠে বিক্ষোভ সমাবেশ ও রাজবাড়ি সড়ক অবরোধ করে দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার নাজমুল করিম খান জানিয়েছেন, ছাত্রদের ওপর হামলার ঘটনায় ১৬ জনকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে, রাতে আরো চিরুনী অভিযান চলবে।

জানা যায়, গত দু’দিন আগে আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের সাথে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে পলাতক জাহাঙ্গীর আলমের একটি অডিও কনফারেন্স ফাঁস হয়। ওই কনফারেন্সে ঢাকাবাসীর রাতের ঘুম হারাম করতে দলের নেতাকর্মীদের প্রস্তুত থাকতে বলেন জাহাঙ্গীর আলম। কোথায় কী ঘটানো হবে আগেই নির্দেশনা দেয়া হবে বলেও তাতে উল্লেখ করেন তিনি। আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে হামলার নাটক তারই অংশ বলে অভিযোগ বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের।

শনিবার রাজবাড়ি সড়কে বিক্ষোভ সমাবেশে ছাত্ররা বলেন, সাবেক মন্ত্রীর বাড়িতে হামলা সামাল দেয়ার জন্য তাদেরকে ডেকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে তারা দেখেন বাড়ির ভেতর কিছু লোক অবস্থান করছে। মুহূর্তের মধ্যে রাম দা, চাপাতিসহ বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র শস্ত্রে যুবলীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা তাদের ঘিরে ফেলে। এ সময় তাদেরকে সাবেক মন্ত্রীর বাড়ির ভেতর নিয়ে কুপিয়ে ও পিটিয়ে গুরুতর আহত করে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গাজীপুরের যুগ্ম আহ্বায়ক নাবওল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের রাত সাড়ে ৮টার দিকে বলা হয়, সাবেক মন্ত্রীর বাড়িতে হামলা হয়েছে। সেখানে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটকে রাখা হয়েছে। আমরা যেন দ্রুত গিয়ে তাদের বাঁচাই। খবর পেয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা সেখানে তাদের উদ্ধার করতে যায়। সেখানে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা পরিকল্পিতভাবে সাবেক মন্ত্রীর বাড়িতে নিয়ে তাদের আটকে মারধর করে।’

নাবওল আহমেদ আরো বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা ফাঁদে পড়েছে বুঝতে পেরে আমরা বহুবার পুলিশকে জানিয়েছি। তারা ঘটনার দুই ঘণ্টা পর এসেছে। যারা হামলা করেছে তারা সবাই আওয়ামী লীগের লোকজন। তাদের হামলায় অর্ধশত শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। ১০ থেকে ১২ জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। অন্যরা গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর। আমরা এই হামলার বিচার চাই, অনতিবিলম্বে হামলাকারীদের গ্রেফতার করতে হবে।’

গাজীপুরের ধীরাশ্রমের দক্ষিণখান এলাকা মূলত আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত। এখানকার বেশির ভাগ লোকই আওয়ামী লীগ সমর্থক, যা সকলে অবগত। এ অবস্থায় মাত্র ১৫-২০ জন লোক মন্ত্রীর বাড়িতে হামলা চালাতে যাবে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয় মন্তব্য করে মহানগর ছাত্রদলের সভাপতি রোহানুজ্জামান শুক্কুর বলেন, শুক্রবার রাতের ঘটনার পেছনে বড় ধরণের ষড়যন্ত্র আছে। পুলিশের উচিত, বিষয়টি তদন্ত করে বের করা।

এদিকে আলোচিত ঘটনার একাধিক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন যুবককে স্থানীয়রা আটক করেছে। তারা বলছে, ‘আমরা না বুঝে এসেছি। আমাদের মাফ করে দেন।’ তবে এসব যুবকের পরিচয় পাওয়া যায়নি। আরো কয়েকটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, বাসভবনের ভেতরে যুবকদের বেধড়ক পেটানো হচ্ছে। তবে ভেতরে ভাঙচুরের কোনো দৃশ্য দেখা যায়নি।

এ হামলার প্রতিবাদে শুক্রবার দিবাগত রাত পৌনে ২টার দিকে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা–কর্মীরা। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গাজীপুরের নেতা মো: আবদুল্লাহ বলেন, ‘শুক্রবার রাতে আমাদের কাছে খবর আসে ধীরাশ্রম এলাকায় সাবেক মন্ত্রীর বাড়িতে হামলা ও লুটপাট হচ্ছে। এটি শোনার পর প্রতিহত করতে আমাদের শিক্ষার্থীরা রওয়ানা হন। দ্রুত ১৫-১৬ জন সেখানে চলে যান। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, লুটপাট হচ্ছে। তাতে বাধা দিলে পেছন থেকে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে যায়। তাদের হাতে রামদাসহ বিভিন্ন অস্ত্র ছিল। অন্য শিক্ষার্থীরা আসার আগেই ওই ১৫ জনকে ছাদে নিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয়। পরে অন্য শিক্ষার্থীরা গেলে তাদেরও মারধর করা হয়।’

শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক শেখ ফরহাদ বলেন, রাত ১১টা পর্যন্ত গুরুতর আহত অবস্থায় ১৫ জনকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। তারা হলেন, বিকাশ (১৫), সামিউল ইসলাম (১৮) রাসেল (২১), শুভ শাহরিয়ার (১৭), হামজা (২১), কাশেম (১৭), আকরাম (২৪), হিমেল (২২), রোহান (২২), নাঈম (২১), ইয়াকুব (২০), সৌরব (২১), হাসান (২২), সাগর (২৩) ও সাজ্জাদ (২১)। তাদের মধ্যে গুরুতর আহত পাঁচজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তারা হলেন, শুভ শাহরিয়া (১৬), ইয়াকুব (২৪), সৌরভ (২২), কাশেম (১৭) ও হাসান (২২)।

গাজীপুর মহানগর পুলিশের সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আরিফুর রহমান শনিবার সকালে বলেন, ‘প্রকৃত ঘটনা কী ঘটেছে, তা নিশ্চিত হতে পারিনি। এখানে হামলার খবর পেয়ে আমরা আসি এবং আহত অবস্থায় ১৫ জনের মতো উদ্ধার করে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করি। ঘটনার বিষয়ে কোনো পক্ষের কাউকেই আমরা পাইনি। এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বা তথ্য নেয়ার জন্যও কারও সাথে কথা বলতে পারিনি। ফলে এখানে আসলে কী ঘটেছে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।’


আরো সংবাদ



premium cement