২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে ট্রিপল মার্ডার

সা’দ অনুসারীদের মুখপাত্র মোয়াজকে ৭ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন

মোয়াজ বিন নুরকে সাত দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেছে পুলিশ - ছবি : নয়া দিগন্ত

টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে রাতের অন্ধকারে জুবায়েরপন্থীদের ওপর হামলা ও ট্রিপল মার্ডারের অন্যতম আসামি মাওলানা সা’দ কান্ধলভী অনুসারীদের বাংলাদেশের মুখপাত্র মুফতি মোয়াজ বিন নুরকে (৪০) সাত দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেছে পুলিশ।

শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) বিকেলে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে তাকে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে।

আগামী রোববার এ রিমান্ড আবেদনের শুনানি হবে বলে জানিয়েছেন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) দক্ষিণ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার এন এম নাসিরুদ্দিন।

এর আগে, গত বৃহস্পতিবার রাতে ভারতের নিজামুদ্দিন বা সা’দ অনুসারীদের বাংলাদেশের পরামর্শসভার প্রধান সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলামকে এক নম্বর আসামি করে টঙ্গী পশ্চিম থানায় একটি মামলা দায়ের করেন জুবায়েরপন্থী এস এম আলম হোসেন। মামলায় ওয়াসিফুল ইসলামের ছেলে মুফতি ওসামা ইসলাম আনু এবং মেয়ের জামাতা আওয়ামী লীগ নেতা ড. কাজী এরতেজা হাসানকেও আসামি করা হয়েছে। এ মামলায় ২৯ জনকে এজাহারনামীয় ও অজ্ঞাত আরো কয়েক শ’ সা’দ কান্ধলভী অনুসারীকে আসামি করা হয়। গ্রেফতার মুফতি মোয়াজ বিন নুর ওই মামলার পাঁচ নম্বর আসামি।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের টঙ্গী পশ্চিম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ইস্কান্দার হাবিবুর রহমান জানান, গ্রেফতার হওয়া মোয়াজ বিন নুর উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের মরহুম নুর মোহাম্মদের ছেলে। মামলার পর মোয়াজ বিন নুরকে রাজধানীর উত্তরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয়।

মোয়াজ বিন নুর ছাড়াও এ মামলায় এজাহারনামীয় চিহ্নিত আসামিরা হলেন ঢাকার ধানমন্ডি থানার আবাসিক এলাকার মরহুম রফিকুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম, খুলনার বাটিয়াঘাটা উপজেলার বড় কড়িয়া গ্রামের মনসুর রহমানের ছেলে আব্দুল্লাহ মনসুর, ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলামের ছেলে ওসামা ইসলাম আনু, একই এলাকার ড. কাজী এরতেজা হাসান, সাভার থানা এলাকার জিয়া বিন কাশেম, তুরাগ থানা এলাকার আজিমুদ্দিন, সাভার থানার সৈয়দ আনোয়ার আব্দুল্লাহ, মুগদা থানা এলাকার শফিউল্লাহ, কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজরা এলাকার মরহুম মাওলানা মোজাম্মেলুল হকের ছেলে আনাস, মোহাম্মদপুর থানা এলাকার আব্দুল্লাহ শাকিল, রমনা থানার কাকরাইল এলাকার রেজা আরিফ, উত্তরা পশ্চিম থানার (সেক্টর ৯) আব্দুল হান্নান, একই থানার (সেক্টর ১১) রেজাউল করিম তরফদার, তুরাগ থানার এলাকার মুনির বিন ইউসুফ, ঢাকার সায়েম, হাজী বশির সিকদার, কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার চন্দনপুর গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে মনির হোসেন, মীরপুর থানা এলাকার প্রকৌশলী মুহিবুল্লাহ, ঢাকার পল্লবী থানা এলাকার আজিজুল হকের ছেলে আতাউর রহমান, এলিফ্যান্ট এলাকার তানভীর, তুরাগ থানার ভাটুলিয়া এলাকার মরহুম ওয়াজ উদ্দিনের ছেলে বাবুল হোসেন, একই থানা এলাকার প্রকৌশলী আবুল বশর, প্রকৌশলী রেজনুর রহমান, উত্তরা থানার (সেক্টর ১০) মরহুম ফজলুল হক সিকদারের ছেলে নাসির উদ্দিন সিকদার, ড. আব্দুস সালাম, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ওয়াসি উদ্দিন, রাজধানীর মীরপুর থানা এলাকার মিজান, তুরাগ থানার এলাকার শাহাদাতসহ কয়েক শ’ জনকে আসামি করা হয়।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, উল্লেখিত আসামিরা মাওলানা সা’দ কান্ধলাভীর অনুসারী। গত ৪ ও ৭ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রথম পর্বের বিশ্ব ইজতেমায় বাধা দিয়ে ইসলামের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য চেষ্টা করে। তারা সরকারকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে সরকারি সিদ্ধান্তবহির্ভূত আগামী ২০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর টঙ্গী ময়দানে সা’দপন্থীদের জোড় করার মর্মে ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিকমাধ্যমে প্রোপাগান্ডা ছড়াতে থাকে। মামলার প্রধান আসামি সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম তার সই করা চিঠির মাধ্যমে সারা দেশের সা’দপন্থীদের জানান যে, আগামী ২০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা ময়দানেই পুরনোদের জোড় হবে। ওই চিঠিতে পুরনো সাথীদের সাথে মোনাসেব সাথীদেরও নিয়ে আসে এবং তাদের সাথে যেন টর্চলাইট ও হ্যান্ডমাইক থাকে এমন নির্দেশনা দেয়া হয়।

মামলার দু’ নম্বর আসামি আব্দুল্লাহ মনসুর ফেসবুক লাইভে ঘোষণা দেন, পুরনোদের জোড়ে এবং বিশ্ব ইজতেমায় যদি মাওলানা সা’দকে আনতে দেয়া না হয় এবং তাদের যদি টঙ্গী ময়দানে ২০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর জোড় করতে দেয়া না হয়, তাহলে তারা সরকারের সিদ্ধান্তমতে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব হতে দেবে না।

তাদের এসব উসকানিমূলক বক্তব্যে ও নির্দেশে বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) রাত ৩টার দিকে ঘুমন্ত ও পাহারারত শূরায়ী নেজামের সাথীদের ওপর হামলা করে। তাদের হামলায় কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার এগারসিন্দু গ্রামের মরহুম ওসমান গণির ছেলে আমিনুল ইসলাম বাচ্চু (৬৫), ফরিদপুর সদর উপজেলার কমলাপুর গ্রামের মরহুম শেখ সামাদের ছেলে বেলাল হোসেন (৬০) এবং বগুড়া সদর উপজেলার ধাওয়াপাড়া গ্রামের ওমর উদ্দিনের ছেলে তাজুল ইসলামকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে।

তাবলিগ জামাত সূত্রে জানা গেছে, সাদপন্থীদের শীর্ষ মুরুব্বী ইঞ্জিনিয়ার সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনামের ভগ্নিপতি। ওয়াসিফুল ইসলামের মেয়ে জামাতা নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা বিতর্কিত শিল্পপতি ড. কাজী এরতেজা হাসানও সাদপন্থীদের অন্যতম শীর্ষ নেতা। কাজী এরতেজা শেখ হাসিনার ধর্মচিন্তা বইয়ের লেখক। এরতেজা হাসান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য, সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত), বর্তমান সহ-সভাপতি, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)-এর সাবেক পরিচালক, ভোরের পাতা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান, দৈনিক ভোরের পাতা ও দি পিপলস টাইমসের সম্পাদক ও প্রকাশক। জালিয়াতি ও প্রতারণার মামলায় কাজী এরতেজা ২০২২ সালের ১ নভেম্বর খিলক্ষেত থানার এক মামলায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিপিআই)-এর হাতে গ্রেফতার হন। সৈয়দ ওয়াসিফুল ইলামের ছেলে বা ড. এরতেজা হাসানের শ্যালক মুফতি ওসামা ইসলামও সাদপন্থীদের আরেক নেতা। বাবা-ছেলে-জামাতা তিনজনই সা’দপন্থীদের নেতৃত্ব দিয়ে বিশাল ইজতেমা ময়দান দখলে নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাবলিগ জামাতে বিভক্তি শুরুর বহু আগে থেকেই ওয়াসিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন ও তাবলিগকে রাজনীতিকরণের অভিযোগ ছিল। ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি ওয়াসিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে তাবলীগ জামাতের একটি অংশ (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এম মুশফিকুর রহমান চৌধুরীর সমর্থকরা) জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন। তাতে ওয়াসিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে কাকরাইল মসজিদ নির্মাণের নামে দেশে-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থা থেকে ২০০ কোটি টাকা তুলে আত্মসাতের অভিযোগ করেন। ওয়াসিফুল ইসলামের ছেলে ওসামা ইসলাম বিদেশ থেকে এসব টাকা সংগ্রহে সহায়তা করেন বলে ওই সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়। তাবলিগের নাম ভাঙ্গিয়ে ওয়াসিফুল ইসলামের চাঁদাবাজি ও রাজনীতি তথা তাবলিগের মূলনীতির পরিপন্থি কর্মকাণ্ডের কারণেই মূলত তাবলিগ জামাতে দ্বিধা-বিভক্তি শুরু হয় বলে অনেকে মনে করেন।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল