২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১০ কার্তিক ১৪৩১, ২২ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

সম্পত্তির ভাগ পেতে কসাই আনিয়ে বাবাকে গলা কেটে হত্যা, ছেলেসহ গ্রেফতার ৪

সম্পত্তির ভাগ পেতে কসাই আনিয়ে বাবাকে গলা কেটে হত্যা, ছেলেসহ গ্রেফতার ৪ - ছবি : নয়া দিগন্ত

কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে একটি ধান ক্ষেতের ড্রেন থেকে গত ২০ অক্টোবর এক কৃষকের লাশ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। লাশটি ছিল গলা কাটা। হাত-পা ও মুখ গামছা দিয়ে বাঁধা।

নিহত ওই কৃষকের নাম নিবু মিয়া (৬৫)। দরিদ্র নিবু মিয়াকে এত নৃশংসভাবে কে বা কারা হত্যা করেছিল।

শনিবার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে চাঞ্চল্যকর কৃষক নিবু মিয়া হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে মামলার শুরু থেকে রহস্য উদঘাটন এবং আসামিদের গ্রেফতার নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী বিপিএম-সেবা।

জানা যায়, ঘটনার পরের দিন নিহতের মেজো ছেলে আব্দুর রহমান হৃদয় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে বাজিতপুর থানায় মামলা করেন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ভাগলপুর তদন্ত কেন্দ্রের এসআই বি এম তমিকুল ইসলামের কুশলী তদন্তে সূত্রবিহীন চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন হয়েছে।

কিশোরগঞ্জ পুলিশ সুপার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ‘নিবু মিয়ার সহায়-সম্পত্তির ভাগ পেতে তাকে কসাই দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে প্রবাস ফেরৎ ছোট ছেলে মো: সোহেল মিয়া (২৪)। সোহেল মিয়ার আশঙ্কা ছিল দরিদ্র কৃষক বাবা নিবু মিয়া পারিবারিক প্রয়োজনে তার সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে দেবেন। এতে সোহেল মিয়া ভবিষ্যতে অর্থ সঙ্কটে পড়বে এমন ধারণা থেকে বাবাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। এর অংশ হিসেবে গত ১৯ অক্টোবর সন্ধ্যায় বাবা নিবু মিয়াকে বাড়ির পাশের তেলিবাড়ী বন্দে ডেকে নিয়ে যায় সোহেল। হত্যার শিকার নিবু মিয়ার বাড়ি উপজেলার পিরিজপুর ইউনিয়নের সুলতানপুর গ্রামে। তার বাবা মরহুম সুন্দর আলী মুন্সি।

এই হত্যা-পরিকল্পনা ও ঘটনায় সহযোগী হিসেবে ছিল নিহতের ছেলে সোহেলের দুই বন্ধু মো: বাবুল মিয়া (৩২) ও মো: সুমন মিয়া (২৬)। বাবার গলা কাটার জন্য সোহেল ডেকে আনে এলাকার তার পরিচিত কসাই মো: নজরুল ইসলামকে ((৪৫)। হত্যার পর নিবু মিয়ার সাথে থাকা ৭০ হাজার টাকা হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া ছেলে সোহেলসহ চারজনে মিলে ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়ে যায়।’

পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী জানান, নিবু মিয়াকে হত্যার আগে প্রথমে তার হাত পা এবং মুখ গামছা দিয়ে বেঁধে নেয়া হয়। গলায় ছুরি চালায় কসাই নজরুল। ছুরি চালানোর সময় ছেলে সোহেল মিয়া নিবু মিয়ার মাথা মাটির সাথে চাপা দিয়ে ধরে রাখে। অন্য দুজন গামছা দিয়ে বাধা হাত ও পা চাপা দিয়ে ধরে রাখে।

এ বিষয়ে হত্যায় জড়িত মো: বাবুল মিয়া শুক্রবার আদালতে ১৬৪ ধারায় হত্যার বর্ণনা ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন।

নিবু মিয়াকে জবাইয়ের পর তার ক্ষতবিক্ষত লাশ বন্দের একটি ধানী জমির কোণায় বিএডিসি সেচ প্রকল্প হাউজে পানির ড্রেনের মধ্যে ফেলে রেখে যায়।

পরদিন ২০ অক্টোবর সকালে এলাকাবসীর খবরের ভিত্তিতে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহত নিবু মিয়ার লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনার মূল হোতা নিহতের ছেলে মো: সোহেল মিয়াসহ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত চারজনকেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাজিতপুর উপজেলার দক্ষিণ পিরিজপুর বাজারের একটি রেস্টুরেন্ট থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে মো: বাবুল মিয়া (৩২) শুক্রবার আদালতে ১৬৪ ধারায় হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দি নেয়া শেষে তাকে কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগারে পাঠানো হয়।

বাবুল মিয়া বাজিতপুর উপজেলার পিরিজপুর ইউনিয়নের সুলতানপুর গ্রামের মো: রহিম উদ্দিনের ছেলে। গ্রেফতার অন্য তিনজন হলেন নিহতের ছোট ছেলে এবং হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ও হত্যার সাথে জড়িত থাকা মো: সোহেল মিয়া (২৪), সুলতানপুর বরকান্দা গ্রামের মরহুম ইয়াকুব আলীর ছেলে এলাকার পরিচিত কসাই নজরুল ইসলাম (৪৫), সুলতানপুরের ডুয়াইগাঁও গ্রামের মো: ফালু মিয়ার ছেলে মো: সুমন মিয়া (২৬)।

তিনি জানান, হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া নিবু মিয়ার চার ছেলে ও দুই মেয়ে। সোহেল মিয়া সবার ছোট ছেলে। বছর দেড়েক আগে নিবু মিয়া ছয় লাখ টাকা খরচ করে সোহেলকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে পাঠায়। তখন নিবু মিয়া ২১ লাখ টাকার জমি বিক্রি করেন। কিন্তু তিন মাস পরই সোহেল দেশে ফিরে আসে। এ নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে সোহেলের কলহ তৈরি হয়। এ পরিস্থিতিতে তাকে বিয়ে করানো হয়। বিয়ের পর এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে সোহেলকে একটি অটোরিকশা কিনে দেয়া হয়। কিন্তু সোহেলের এতে মন বসত না। সে আড্ডাবাজি করে দিন পার করত। টাকার জন্য সোহেল তার বাবা নিবু মিয়াকে চাপ দিত। এ নিয়ে পারিবারিক কলহ আরো বাড়তে থাকে। সম্প্রতি জমি বিক্রির এক লাখ টাকা নিবু মিয়া পান। এই টাকা থেকে সোহেল টাকা চাইলেও নিবু মিয়া তাকে টাকা দেননি। ভবিষ্যতে নিবু মিয়া বাকি জমিও বিক্রি করে দিলে সে টাকা পাবে না- এ রকম আশঙ্কা পেয়ে বসে সোহেলকে। এ রকম পরিস্থিতিতে সে ক্ষিপ্ত হয়। সে বাবাকে হত্যা করে সহায়-সম্পত্তির ভাগ নেয়ার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সোহেল তার আড্ডার সাথী ইলেকট্রিশিয়ান বাবুল মিয়া, রাজমিস্ত্রী সুমন মিয়া ও কসাই নজরুল ইসলামের সহায়তায় কিলিং মিশনে অংশ নেয়। নিবু মিয়ার মুখ গামছা দিয়ে বেঁধে সোহেল তার মাথা, বাবুল মিয়া তার পা ও সুমন মিয়া তার হাত ধরে রাখে এবং কসাই নজরুল ইসলাম গলায় ছুরি চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় পরদিন ২০ অক্টোবর সকালে কৃষক নিবু মিয়ার লাশ উদ্ধারের পর এ ঘটনায় নিহতের মেজো ছেলে আব্দুর রহমান হৃদয় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে বাজিতপুর থানায় মামলা করেন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ভাগলপুর তদন্ত কেন্দ্রের এসআই বি এম তমিকুল ইসলামের কুশলী তদন্তে এ হত্যা রহস্যের জট খুলে। প্রেস ব্রিফিংয়ে মামলার দিক-নির্দেশনা প্রদানকারী অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) মো: আল আমিন হোসাইন এবং গ্রেফতার অভিযানে নেতৃত্ব প্রদানকারী বাজিতপুর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সত্যজিৎ কুমার ঘোষ ও বাজিতপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো: মুরাদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।


আরো সংবাদ



premium cement