শরণার্থী সমস্যায় ইউরোপের মুখোশ উন্মোচন
- মু: ওমর ফারুক আকন্দ
- ১২ মার্চ ২০২০, ০০:০০
এশিয়া ও আফ্রিকায় দীর্ঘ দিন ধরে লেগে আছে অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত আর যুদ্ধ। এসব যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্রগুলোর লাখো মানুষ নিজ দেশে মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে পাশের ভ্রাতৃপ্রতিম রাষ্ট্রগুলোতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু এসব মানুষ নানা সমস্যার কারণে ইউরোপে পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছে। সর্বজনীন মানবাধিকারের মূলনীতিতে ওই সমস্যা সমাধানের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা নানামুখী অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এসব কারণে আবারো ইউরোপের শরণার্থী সঙ্কট গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
শরণার্থীর চাপে আধুনিক ইউরোপের উদারবাদী মুখোশ খসে তাদের কুৎসিত চেহারাও খানিকটা বেরিয়ে এসেছে। নতুন করে সিরিয়া যুদ্ধের কারণে তুরস্কের সীমান্তে ক্রমেই বাড়ছে শরণার্থীর চাপ। সেই চাপ সামলাতে না পেরে কয়েক দিন আগে সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয় ৪০ লাখের অধিক শরণার্থীদের আশ্রয় দেয় তুরস্ক। ফলে ফের শরণার্থী সঙ্কটের মুখে পড়েছে ইউরোপ।
তুর্কি সীমান্ত খুলে দেয়ার পরেই গ্রিস দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করে শরণার্থীরা। এ সময় গ্রিস এসব শরণার্থীদের সাথে খুবই নৃশংস-অমানবিক আচরণ করে। ইউরোপীয় দেশগুলো শরণার্থীদের জন্য তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে, তাদের ফেরত পাঠানোর জন্য আঘাত করা হচ্ছে ও তাদের নৌকা ডুবিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাদের ওপর গুলি চালানো হয়। এ ঘটনা মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাকে পদদলিত করছে। ইউরোপীয়দের এমন আচরণে স্তব্ধ পুরো বিশ্ব।
সীমান্তে এমন নৃশংতার জেরে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান বলেন, তারা যেকোনো মূল্যে তাদের দেশে শরণার্থী আসা বন্ধ করতে চায়, এমনকি তাদের ডুবিয়ে বা জীবিত গুলি চালিয়ে হত্যা করতে চায়। তাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, একদিন তাদেরও এমন অবস্থায় পড়তে হতে পারে। এমন করুণার প্রয়োজন তাদেরও হতে পারে।
ইউরোপ অভিমুখী শরণার্থীদের সাথে অমানবিক ও পাশবিক আচরণ করছে গ্রিসের পুলিশ ও কোস্টগার্ড। কখনো অভিবাসী বোঝাই নৌকা লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছে। আবার কখনো নৌকাগুলো ডুবিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমগুলোতে এমনই কিছু লোমহর্ষক ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। একটি ভিডিওয়ে দেখা যায়, গ্রিক উপকূলের কাছে সাগরের মধ্যে শরণার্থীবোঝাই একটি ডিঙ্গিনৌকা ডুবিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে কোস্টগার্ড কর্মকর্তারা। এ সময় নৌকা লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু গুলি ছুড়তেও দেখা যায়। যদিও গুলি নৌকায় না লেগে কাছাকাছি পানিতে পড়ে।
তুরস্কে এখনো পর্যন্ত ৪০ লাখের মতো শরণার্থী ও অভিবাসীকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই সিরিয়ার। এ ছাড়াও আফগানিস্তান থেকে আসা অনেককেও তুরস্কে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। ইদলিবের যুদ্ধে নতুন করে যে ১০ লাখ শরণার্থী হয়েছে তুরস্কের ক্ষমতা নেই তাদের আশ্রয় দেয়ার।
মূলত দীর্ঘদিন ধরে শরণার্থী সমস্যা মোকাবেলায় সহযোগিতা না পেয়ে অনেকটা চাপে আছে তুরস্ক। বিপুলসংখ্যক এসব শরণার্থী নিয়ে নিরাপদ জোট গঠনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি দীর্ঘ দিন ধরে আহ্বান জানিয়ে আসছেন এরদোগান। তবে তুর্কির সেই আহ্বানে কোনো কর্ণপাত করেননি ইউরোপীয় নেতারা। সিরিয়া সঙ্কটের শুরু থেকেই শরণার্থীদের সহায়তার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন তুরস্কের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিল। তুরস্ককে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো সহায়তা করেনি ইইউ।
ফলে সব শেষ কিছু দিন আগে তুর্কি প্রেসিডেন্ট হুমকি দিয়েছিলেন যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি বিষয়টি নিয়ে কোনো সুরাহায় না আসে তাহলে তুরস্ক ইউরোপ সীমান্ত খুলে দেবে। ঘোষণা অনুযায়ী সীমান্ত খুলে দিয়েছে দেশটি।
এদিকে ইউরোপের অনেক জাতিরাষ্ট্রই এখন মুখের ওপরে দরজা বন্ধ করে দিতে উদ্যত। শরণার্থীদের চাপে তাদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে, এই ছুতো দেখিয়ে তারা চায় না কোনো শরণার্থী ইউরোপে প্রবেশ করুক। অথচ তারা নিজেদের মানবাধিকারের দর্পণ হিসেবে উপস্থাপন করতে চায় বিশ্ববাসীর কাছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়ে নিজেরা মানবাধিকার ও উন্নয়নের বুলি আওড়াতে ব্যস্ত।
অথচ এসব দেশগুলোর মূল সমস্যার পেছনে ইউরোপীয়রাই দায়ী। তারা এক দিকে আফ্রো-এশিয়ার এসব দেশগুলোতে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করে। তারপর এসব দেশ থেকে মূল্যবান খনিজ ও অন্যান্য সামগ্রী লুট করতে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে। আবার এদের কাছেই অস্ত্র বিক্রি করে নিজেরা লাভবান হয়।
এশিয়া ও আফ্রিকার এসব অঞ্চলে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে বহু বছর ধরে। আজ এক দেশ তো কাল অন্য দেশ। এসব যুদ্ধের শিকার নিরীহ আদম সন্তানেরা। নিজ দেশেই তারা আজ পরবাসী। জীবন বাঁচাতে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিচ্ছে। ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকায় নিজের প্রাণ বাজি রাখে একটু শান্তিতে বাঁচার আশায়।
শরণার্থী সমস্যাটি এখন আর ইউরোপীয় নয়। এ সমস্যাকে গুরুতর বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে আমলে নিয়ে সমাধানের জন্য দ্রুত আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। যথাসময়ে সমাধান করতে না পারলে তা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। হ