২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

জার্মানিতে নিরাপত্তা শঙ্কায় মুসলমানরা

-

জার্মানিতে চরমপন্থী এক বন্দুকবাজের গুলিতে সম্প্রতি নিহত হয়েছে ৯ জন। পরে নিজের মাকেও গুলি করে হত্যা করে আত্মঘাতী হয় ওই আততায়ী। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সময় রাত ১০টায় জার্মানির হানাউ শহরে ঘটে এ ঘটনা।
কিভাবে ঘটল এমন ঘটনা? প্রথমে ‘মিডনাইট’ নামে একটি হুকা বারে ঢুকে এলোপাথাড়ি গুলি চালায় ৪৩ বছরের ওই ব্যক্তি। টোবিয়াস নামের ওই ব্যক্তি জার্মান নাগরিক। ‘মিডনাইট’ থেকে বেরিয়ে সে আট কিলোমিটার দূরের ‘এরিনা বার অ্যান্ড ক্যাফে’ নামে আর একটি বারে প্রবেশ করে। বন্দুক নিয়ে সেখানে বেশ কিছুক্ষণ তাণ্ডব চালানোর পরে নিজের বাড়ি ফিরে যায় সে। খবর যায় পুলিশে। তারা প্রথমে ভেবেছিল আততায়ী হয়তো একাধিক। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য শুনে বোঝা যায়, একাই দু’টি জায়গায় তাণ্ডব চালিয়েছে বন্দুকবাজ। সারা রাত তল্লাশি অভিযানের পর শেষ রাতে প্রকাশ্যে আসে টোবিয়াসের পরিচয়। পরে তার ফ্ল্যাটে হানা দেয় পুলিশ। সেখানে গিয়ে প্রথমে ৭২ বছরের এক বৃদ্ধার গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তারা জানতে পারে, নিহত বৃদ্ধা টোবিয়াসের মা। পরে সেই ফ্ল্যাট থেকেই টোবিয়াসের লাশ উদ্ধার হয়। প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশের ধারণা, মাকে হত্যা করে নিজেকে গুলি করেছে টোবিয়াস।
কেন এভাবে গুলি করে এতগুলো মানুষকে খুন করল টোবিয়াস, তার ব্যাখ্যাও দিয়েছে পুলিশ। তারা জানিয়েছে, অভিবাসীদের হত্যা করতেই ওই বার দু’টিতে ঢুকেছিল সে। অপরাধের অবশ্য কোনো অতীত-রেকর্ড ছিল না টোবিয়াসের। তবে সে যে অতি দক্ষিণ চরমপন্থায় বিশ্বাসী, তা তার বিভিন্ন অনলাইন পোস্ট থেকে জানা গেছে। তার আগ্নেয়াস্ত্রটির লাইসেন্স ছিল। গাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছে প্রচুর ম্যাগজিন।
ঘটনার পরদিন বার্লিনে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল। তার মন্তব্য, জাতিবিদ্বেষের কারণেই যে এই হামলা, তা স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘জাতিবিদ্বেষ হলো বিষ। ঘৃণা হলো বিষ। আর আমাদের মানতে হবে, এই বিষ আমাদের সমাজেই রয়েছে। এই বিষ বহু অপরাধের জন্য দায়ী।’ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান জানিয়েছেন, নিহতদের মধ্যে অন্তত পাঁচজন তার দেশের নাগরিক। তার আশা, জার্মান সরকারের যথাযথ তদন্তে হামলার প্রকৃত উদ্দেশ্য উঠে আসবে। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘এই হামলা এটাই প্রমাণ করে, ইউরোপে জাতিবিদ্বেষ ও ইসলামবিদ্বেষ বাড়ছে।’
হামলাকারী অতীতে আরব এবং মুসলিম দেশগুলো সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেছিল বলে জানা গেছে।
সাম্প্রতিক এ হামলার ঘটনার পর জার্মানির চারটি সবচেয়ে বড় ইসলামিক অ্যাসোসিয়েশন উগ্র ডানপন্থীদের চরমপন্থা রুখতে আরো উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। মুসলমানদের সমন্বিত কাউন্সিল কেআরএম জানিয়েছে, তারা গত কয়েক মাস ধরেই ইসলামবিদ্বেষের বিরুদ্ধে একটি পরিষ্কার অবস্থান নিতে কর্তৃপক্ষের প্রতি দাবি জানিয়েছে আসছিল।
জার্মানিতে গত কয়েক বছরে মসজিদসহ মুসলমানদের ওপর হামলার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। দেশটি ২০১৫ সালে ১০ লাখের বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ার পর এ ধরনের হামলা বেড়ে যায়। জার্মানির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালে ৯১০টি ইসলামবিদ্বেষী হামলার ঘটনা রেকর্ড করেছে। সংখ্যাটি ২০১৭ সালের তুলনায় কিছুটা কম। সে বছর এ ধরনের এক হাজার ৭৫টি অপরাধের ঘটনা রেকর্ড হয়েছিল। যদিও মুসলমানদের ওপর সরাসরি হামলা আগের চেয়ে ক্রমেই বাড়ছে। ২০১৭ সালে যেখানে ৩২ জন আহত হয়েছিল, ২০১৮ সালে তা বেড়ে ৪০ জনে পৌঁছে।
মুসলিমদের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল মনে করে, এই সংখ্যা দিয়েও ঠিক বাস্তবতা বোঝা যাবে না। কেননা, অপরাধের সব ঘটনা পরিসংখ্যানে আসে না। হামলার শিকার যারা হয়, তাদের একটি বড় অংশই সেগুলো প্রকাশ করে না। আবার পুলিশ এবং তদন্তকারীরা কিছু অপরাধ ভুলভাবে শ্রেণিভুক্ত করে। এর ফলেও ইসলামবিদ্বেষী অনেক ঘটনা বাদ যায়। এমনটাই বলা হয়েছেÑ স্থানীয় আঞ্চলিক গণমাধ্যমের ‘নয়ে অসনাব্রুকার সাইটুং’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে।
ইসলামভীতি ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের সব স্তরে
এরোফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ইসলাম বিশেষজ্ঞ কাই হাফেজের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৫০ ভাগেরও বেশি জার্মান ইসলামভীতি পোষণ করেন। থিউরিংগিয়া এবং স্যাক্সোনির মতো কিছু অঞ্চলে এই হার ৭০ ভাগ বা তার চেয়েও বেশি। একসময় প্রবণতাটি সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ে থাকলেও এখন তা ছড়িয়ে পড়ছে বিস্তৃতভাবে। জার্মান ‘অ্যান্টি ডিসক্রিমিন্যাশন অ্যাসোসিয়েশন’-এর সদস্য বিয়ার্তে ভাইসও বিষয়টি স্বীকার করেন। প্রতিদিনই মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাব বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি।
আয়মান মাজাইক বলেন, ‘থুথু দেয়া বা কড়া দৃষ্টি তেমন ক্ষতিকর অভিজ্ঞতা নয়, বরং রাস্তাঘাটে এখন আমাদের প্রায়ই মৌখিক ও শারীরিক নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়। সহনশীলতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমেই, বাড়ছে বর্ণবাদী নিন্দা কিংবা অপমান করার প্রবণতা।’ মাজাইক বলেন, এ পরিস্থিতির মুখোমুখি এখন মুসলিম আর ইহুদি দুই পক্ষই। সংখ্যাগরিষ্ঠের চেয়ে যারাই আলাদা, তারাই এমন আচরণের শিকার হচ্ছেন।
মাজাইকের মতেÑ অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ‘শিশু ও নারীরা এখন মসজিদে আসতে ভয় পায়। শুক্রবার জুমার নামাজে যাওয়ার সময় তারা বিচলিত বোধ করে। অনেকে আবার ভয়ে মসজিদে আসাও ছেড়ে দিচ্ছেন।’
হত্যাকারীদের উর্বর ক্ষেত্র জার্মানি
রাজনীতিবিদ এবং সুশীল সমাজকে এটা স্বীকার করতে হবে, হত্যাকারীদের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে জার্মানি। হত্যাকাণ্ডগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। ঘটনাগুলো উদারপন্থী রাজনীতি, ইহুদি না মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘটছে, তার চেয়ে বড় কথাÑ জার্মানির বর্তমান সামাজিক কাঠামোতে এরা আবার মাথাচাড়া দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে। বিশ্বের জন্য এটা একটা সতর্কবার্তা। ধর্ম-বর্ণ-জাতি-লিঙ্গ নির্বিশেষে সংবিধান অনুসারে সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement