তাজিয়া মিছিলে হামলার ৫ বছর : থমকে আছে বিচার
- শহিদুল ইসলাম রাজী
- ২৯ আগস্ট ২০২০, ১০:১৩
সাক্ষীর অভাবে থমকে আছে পুরান ঢাকার হোসেনী দালানে তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলার বিচারপ্রক্রিয়া। এ হামলার পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি বিচারকার্য। তবে এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আশাবাদী, করোনা পরিস্থিতি কেটে গেলে বিচারকার্য আবারো পুরোদমে শুরু হবে। তখন তারা বাকি সাক্ষীদেরও হাজির করতে পারবেন। দ্রুত সময়ে বিচারও শেষ হবে।
জানা গেছে, এ মামলায় সাক্ষীর সংখ্যা ৪৬ জন। কিন্তু গত বছর পর্যন্ত মাত্র ১১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে। সর্বশেষ সাক্ষ্য গ্রহণ হয় গত বছরের ২২ অক্টোবর। এরপর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালে বেশ কয়েকটি নির্ধারিত শুনানির তারিখে রাষ্ট্রপক্ষ কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেনি। এরই মধ্যে আরো একটি বছর চলে গেল; কিন্তু এখনো নতুন করে কারো সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়নি। ওই দিন বোমা হামলায় নিহত একজনের ভাই আবু সাইদ সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। এরপর বেশ কয়েকটি তারিখ থাকলেও কোনো সাক্ষী আসেনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৫ সালের আলোচিত এই ঘটনায় মামলার বিচারকাজে গতি নেই। সাক্ষী হাজির করা সম্ভব হচ্ছে না। অনেকে তখন সাক্ষী হলেও এখন আসছেন না। সাক্ষী হাজির করতে না পারায় এক বছর ধরে সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে আটকে আছে মামলার বিচারকাজ। চার বছর আগে হওয়া এ হামলা মামলার অভিযোগপত্র জমা দিতেও এক বছর দেরি করেছিল তদন্তসংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়াও বিচারকার্যে জটিলতাটা বাধে একজন আসামি শিশু হওয়ায়। তার বয়স ছিল ১৭ বছর, যা পরবর্তী সময়ে জন্মসনদ, সার্টিফিকেটে প্রমাণিত হয়। আর এসব বিষয় পর্যালোচনা, যাচাই-বাছাই করতেই সময় লেগে যায়।
জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর প্রথম প্রহরে তাজিয়া মিছিলে শরিক হওয়ার জন্য অনেকেই হাজির হন। ওই সময় হঠাৎ করেই তিনটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। আহত হন প্রায় অর্ধ শতাধিক মানুষ। এর মধ্যে দু’জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। প্রত্যদর্শীরা জানিয়েছিলেন, রাত দেড়টা থেকে হোসেনী দালানের ফটকে একটি তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি চলছিল। মিছিলটি পল্টনে যাওয়ার কথা ছিল। মিছিলে যোগ দিতে এসেছিলেন তরুণ, বৃদ্ধ, নারী ও শিশুরা। এর মধ্যেই রাত পৌনে ২টার দিকে বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা।
এরপর এ ঘটনায় চকবাজার থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা হলে সেটি তদন্তের দায়িত্ব পান ডিবির পরিদর্শক শফিউদ্দিন শেখ। টানা একটি বছর চলে তদন্ত। তদন্ত শেষে মামলার চার্জশিট দেয়া হয়। তাতে উল্লেখ করা হয়, এই হামলা চালিয়েছে জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্যরা। ওই চার্জশিটে ১০ জনকে আসামি করা হয়। পরে মামলার ১০ আসামির মধ্যে চারজন জামিন পেয়েছেন। এরা হলেন- নেত্রকোনার কলমাকান্দার লেংগুড়া মধ্যপাড়ার ওমর ফারুক মানিক, একই উপজেলার হাফেজ আহসান উল্লাহ মাসুদ, গাজীপুরের কালিয়াকৈরের বড়ইতলী গ্রামের শাহজালাল মিয়া এবং গাইবান্ধার সাঘাটার ডিমলা পদুম শহরের চান মিয়া। কারাগারে আছেন- সাঘাটার কচুয়া দক্ষিণপাড়ার কবির হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে আশিক, বগুড়ার আদমদীঘির কেশরতা গ্রামের মাসুদ রানা মাসুদ ওরফে সুমন, রুবেল ইসলাম ওরফে সজীব, দিনাজপুর কোতোয়ালির ঘাসিপাড়ার আবু সাঈদ রাসেল ওরফে সোলায়মান ওরফে সালমান ওরফে সায়মন, রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের পশ্চিম ইব্রাহীমনগর বালুরমাঠ এলাকার আরমান ওরফে মনির, কামরাঙ্গীরচরের পূর্ব রসুলপুরের জাহিদ হাসান ওরফে রানা ওরফে মুসায়াব ও দিনাজপুরের রুবেল ইসলাম ওরফে সজীব ওরফে সুমন।
এদের মধ্যে জাহিদ, আরমান, রুবেল ও কবির আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। এর মধ্যে একজন শিশুও ছিল। যার কারণে পরবর্তী সময়ে সম্পূরক চার্জশিট দেয়ার জন্য বলেছিলেন আদালত। আলোচিত এই মামলায় প্রথমে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। এরপর গত বছর আইনজীবী পরিবর্তন হয়। বর্তমানে মামলাটি দেখছেন আইনজীবী গোলাম সারয়ার খান জাকির।
সরকারি পক্ষের আইনজীবী গোলাম সারয়ার খান জাকির সাংবাদিকদের বলেন, এ পর্যন্ত ১১ জনের মতো সাক্ষ্য দিয়েছেন। বাকিরাও দেবেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে বিচারকার্যে কিছুটা ভাটা পড়েছে। করোনা কাটলে বিচারকার্য আবারো শুরু হবে। দ্রুত সময়ে শেষও হবে বলে আশাবাদী তিনি।
আদালত সূত্রে জানা যায়, হোসেনী দালানে বোমা হামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে জেএমবি ১৩ সদস্যকে গ্রেফতার করেছিল গোয়েন্দারা; কিন্তু তার মধ্যে তিনজন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। তারা হলেন- শাহাদাত ওরফে আলবানি ওরফে মাহফুজ ওরফে হোজ্জা, আব্দুল্লাহ বাকি ওরফে আলাউদ্দিন ওরফে নোমান, সাঈদ ওরফে হিরন ওরফে কামাল।
মামলার নথিতে বলা হয়, বন্দুকযুদ্ধে নিহত আবদুল্লাহ বাকি ওরফে নোমান ছিলেন হোসেনী দালানে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী। হামলার আগে ১০ অক্টোবর তারা বৈঠক করে হামলার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। বোমা হামলার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন- জাহিদ, আরমান ও কবির। কবির ও জাহিদ ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করেন। হামলার পর আশ্রয়ের জন্য কামরাঙ্গীরচরে বাসা ভাড়া করেন আরমান ও রুবেল। ঘটনাস্থলে আরমান পরপর পাঁচটি বোমা ছোড়েন। বাকি পাঁচজন চান মিয়া, ওমর ফারুক, আহসানউল্লাহ, শাহজালাল ও আবু সাঈদ হামলার চিত্র ভিডিও করা ছাড়াও হামলায় উদ্বুদ্ধ ও সহায়তা করেন। আসামি মাসুদ রানারও হামলায় অংশ নেয়ার কথা ছিল; কিন্তু আগের দিন গাবতলীতে পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে এএসআই ইব্রাহীম মোল্লাকে হত্যার সময় ঘটনাস্থলে গ্রেফতার হন তিনি।
মামলার নথিপত্রে আরো দেখা যায়, সাক্ষীরা প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে মামলার ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন; কিন্তু কেউই মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে কোনো কিছু বলেননি। এই কারণে আসামিদের আইনজীবী ফারুক আহাম্মাদ তাদের জেরাও করতে চাননি। বাদি আদালতে দেয়া সাক্ষ্যেও কোনো আসামিকে শনাক্ত করেননি বলে জানান আইনজীবী ফারুক।
আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মাদ সাংবাদিকদের বলেন, এ মামলায় চারজন জামিনে রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষীরা কোনো সাক্ষ্য দেননি ও আসামিরা ১৬৪ ধারায় কোনো জবানবন্দীতে তাদের নাম বলেননি। তাই বিচারক তাদের জামিন মঞ্জুর করেছেন। ফারুক আহাম্মাদ বলেন, আমরা আশাবাদী আসামিরা মামলা থেকে খালাস পাবেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা