ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে ইয়াবা কারবারির আত্মসমর্পণ
- বিবিসি
- ১৭ জানুয়ারি ২০১৯, ১৭:৪৬
বাংলাদেশের কক্সবাজারে ইয়াবা কারবারি হিসেবে অভিযুক্ত একজন ইউপি সদস্য ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন। অন্যদিকে সেখানে ইয়াবা কারবারিদের বাড়িতে ও নৌকায় হামলা চলছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
টেকনাফ সদরের ইউনিয়ন পরিষদে সদস্য এনামুল হক নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে মঙ্গলবার ঘোষণা দিয়ে আত্মসমর্পণ করতে যান।
গত ১৫ জানুয়ারি বিকেলে তিনি নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে "প্রিয় মাতৃভূমি টেকনাফবাসি" সম্বোধন করে যে স্ট্যাটাস দেন সেখানে লেখেন, "আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান যাত্রা শুরু করছি"।
আত্মসমর্থনের জন্য যাওয়ার সময় তার সাথে একজন পুলিশ সদস্য এবং একজন স্থানীয় সাংবাদিক ছিলো বলে সে ঐ ফেসবুক পোস্টে জানায়।
এনামুল হকের বড় ভাই হাফেজ মাওলানা নুরুল হক তার ভাইয়ের আত্মসমর্পণের খবর নিশ্চিত করেছেন বিবিসি বাংলাকে।
তিনি জানিয়েছেন, তার ভাইকে নিয়ে গেছে, কিন্তু কোথায় নিয়ে গেছে সেটা তাদের জানা নেই। যতটুকু জানি পুলিশ লাইনের কোথাও আছে। আমরা যোগাযোগ করেছিলাম, বলা হইছে চিন্তার কিছু নাই।
আরও জানান, শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের অপরাধ বিবেচনা করে কী সাজা দেয়া হবে - সেটা জানানো হবে বলে তাদের বলা হয়েছে।
তিনি বলেন,কিছুদিন আগে সরকারের মাদক-বিরোধী অভিযানের সময় ক্রসফায়ারে দেয়ার জন্য যে গায়েবি তালিকা করা হয়েছিল সেখানে তার (ভাই এনামুল হকের) নাম আছে শোনার পর থেকে আতঙ্ক বিরাজ করছিল"।
"যখন লোকজন অহরহ ধরে ধরে মেরে ফেলতেছে যেহেতু আমাদের শত্রু রয়েছে সেজন্য আমরা মনে করলাম এটা (আত্মসমর্পণ) করলে ভালো হবে, সমাজটা ইয়াবা মুক্ত হবে। এভাবে মুরুব্বিসহ সবাই মিলে তাকে বোঝানো হলে সে রাজি হয়"।
তিনি বলেন, তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসা, বাড়িঘরে হামলা মামলাসহ ২/৩টি অভিযোগে মামলা রয়েছে। কিন্তু এসবই ষড়যন্ত্রমূলকভাবে দায়ের করা হয়েছিল বলে তিনি দাবি করেন।
"সে ফুটবল খেলার জন্য পরিচিত। তাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ফাঁসানো হয়েছে, এইসব মামলা নিয়ে সামাজিকভাবে আমরা নিজেদের ছোট মনে করছি। প্রতিবেশী একজন ব্যক্তির সাথে জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে তার ভাইসহ ছয়জনকে ইয়াবা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
তিনি জানান, মাসখানেক আগে এলাকায় ইয়াবা কারবারিদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। কিছুদিন আগে পুলিশ তাদের বাড়িঘরেও তল্লাশি করে।
এখন তাদের আশা মহেশখালীতে জলদস্যুদের যেভাবে জেল হয়েছে সেভাবে তার ভাইসহ আত্মসমর্পণ করা অন্যান্যদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হবে। উল্লেখ্য, গত নভেম্বর মাসে চল্লিশ জনের বেশি জলদস্যু আত্মসমর্পণ করে।
তবে টেকনাফ থানার অফিসার ইন চার্জ (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস জানিয়েছেন, এনামুলের নামে ইয়াবা সম্পর্কিত ১৫টি মামলা আছে। সে ইউপি মেম্বার পরিচয়ের আড়ালে এলাকায় এলাকার একজন শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত।
ইয়াবা কারবারিদের বাড়িতে হামলা-ভাংচুরের অভিযোগ
এদিকে গত কয়েকদিনে টেকনাফ এলাকায় ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত হিসেবে সন্দেহভাজন অনেকের বাড়িতে হামলা ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। অনেক নৌকায় আগুন দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
স্থানীয় সংবাদকর্মীরা জানাচ্ছেন, এসব নৌকার একেকটিতে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকার বিনিয়োগ রয়েছে।
টেকনাফের পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, রাতের অন্ধকারে মুখোশ পরা লোকজন এসব হামলা চালাচ্ছে। কিন্তু পুলিশের কাছে কেউ অভিযোগ জানাচ্ছে না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কক্সবাজার জেলার সর্বশেষ তালিকায় এক হাজার ১৫১ জন ইয়াবা কারবারির নাম রয়েছে। তালিকাভুক্ত আসামীদের মধ্য থেকে ৭৩ জনকে শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন।
তিনি বলেন, "তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক কারবারিদের অনেকে আত্মসমর্পণ করে নিজেদের সংশোধন করে চায় বলে আবেদন করেছে। সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে সিগন্যাল পেয়ে সেই প্রক্রিয়া এখন চলছে"।
বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারানোর ভয়ে আত্মসমর্পণ করে অর্ধশতর বেশি বর্তমানে পুলিশের হেফাজতে আছে বলে স্থানীয়ভাবে জানা যাচ্ছে।
যদিও ঠিক কতজন আত্মসমর্পণ করেছেন বা কবে থেকে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সেটা নিশ্চিত করে বলতে চাননি এই পুলিশ কর্মকর্তা।
"শীর্ষ ব্যবসায়ী যারা আছে তাদের শর্ত সাপেক্ষে এই আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে"।
তিনি বলেন, "তারা এলে 'আমি ইয়াবা কারবারি' এই ঘোষণা দিয়ে আসতেছে। এর মাধ্যমে তাদের সংশোধনের ব্যাপারও থাকবে। ভবিষ্যতে তারা যদি আবার আগের পথে ফিরে যায় তাহলে যেভাবে আইনি অভিযান চলছে সেভাবে চলবে"।
'পুলিশ কোন অভিযোগ পায়নি'
এবিএম মাসুদ হোসেন কক্সবাজারের পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন তিনমাস হলো।
ইয়াবা বহনকারী নৌকায় আগুন দেয়ার ঘটনা কিংবা ইয়াবা কারবারি হিসেবে পরিচিতদের বাড়ি-ঘরে আগুন দেয়ার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, তারা এমনটা শুনেছেন। তবে কোনও অভিযোগ পায়নি পুলিশ।
তিনি বলেন, স্থানীয় লোকজন আগুন দিয়ে দিচ্ছে, কেউ এসে কমপ্লেইন করেনি। আমরা ধারণা করছি যেহেতু তারা ইয়াবা কারবারি তাই নৈতিক কারণে তারা এসে অভিযোগ জানায়নি।"
আইন ও শালিস কেন্দ্রে পরিসংখ্যান বলেছে, মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের 'জিরো টলারেন্স' নীতির অংশ হিসেবে সারা বাংলাদেশে চালানো অভিযানের সময় ১৫ মে থেকে ৩১ অক্টোবর ২০১৭ পর্যন্ত ২৭৬ জন নিহত হন র্যাব-পুলিশের সাথে কথিত 'বন্দুকযুদ্ধে'।
ক্রসফায়ারের সমালোচনা এড়াতে আত্মসমর্পণের কৌশল?
মাদক-বিরোধী অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারানোদের মধ্যে ৩২ জন টেকনাফের বাসিন্দা।
বন্দুকযুদ্ধে অভিযুক্ত মাদক কারবারি হত্যার ঘটনায় সমালোচনার প্রেক্ষাপটে প্রশাসন এই আত্মসমর্পণের কৌশল নিয়েছে কি-না?
এমন প্রশ্নে পুলিশ কর্মকর্তা এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, "এটা কোন কৌশল নয়।"
তবে তিনি স্বীকার করেন, "এই অভিযানে সমস্যা প্রচুর, নতুন নতুন অনেক কারবারি গড়ে উঠছে, কারণ এখানে কোন বিনিয়োগ করতে হয়না। বিনা পয়সায় এই ব্যবসাটি চলে। মায়ানমার থেকে যারা ইয়াবা পাঠায় তারা কোনরকম পয়সা ছাড়াই সেগুলো পাঠায়"।
তিনি বলেন, "ফলে ইয়াবার বিস্তার ঠেকাতে হলে অভিযানের পাশাপাশি সামাজিক মোটিভেশনাল প্রক্রিয়া চালাতে হবে।"
যেকোনো একটি বিষয়য়ের দ্বারা এই ব্যবসার বন্ধ করা খুবই কঠিন বলে উল্লেখ করেন এবিএম মাসুদ হোসেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা