এবার পাউবোর সুপার ডাইক প্রকল্প আলোর মুখ দেখছে
সম্ভাব্য ব্যয় ৬০ হাজার কোটি টাকা- এস এম রহমান পটিয়া-চন্দনাইশ (চট্টগ্রাম)
- ১০ মে ২০২৪, ০০:০৫
প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, ১৮ হাজার কোটি টাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ বাস্তবায়নের পর অবশেষে আলোর মুখ দেখছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের গৃহীত চার লেনের সড়কসহ সুপার ডাইক নির্মাণ প্রকল্প। আর এতে সম্ভাব্য ব্যয় হবে ৬০ হাজার কোটি টাকা। আগামী সপ্তাহের মধ্যে প্রকল্পের ডিপিপি প্রস্তুত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন পাউবো চট্টগ্রামের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খ ম জুলফিকার তারেক। এই প্রকল্পে চীন অর্থায়ন করছে বলে জানান তিনি। ২০১৯ সাল থেকে বাপাউবো সুপার ডাইক প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। আপাতত কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের মিরসরাই পর্যন্ত সুপার ডাইক প্রকল্প বাস্তবায়ন করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে পানি উন্নয়ন প্রকল্প।
জানা গেছে, সুপার ডাইক প্রকল্পটিতে অর্থায়নের জন্য বেশ কয়েকটি দেশ আগ্রহ দেখিয়েছে। পরবর্তীতে সুপার ডাইকের পরিবর্তে কক্সবাজার থেকে মিরসরাই পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। ওই সময়ে ২০২২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ‘আলোর মুখ দেখছে পৃথিবীর দীর্ঘতম মেরিনড্রাইভ প্রকল্প’ শিরোনামে নয়া দিগন্তে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের জোড়ারগঞ্জ থেকে কক্সবাজারের শহরতলি পর্যন্ত (প্রায় ১৬৮ কিলোমিটার) এই মেরিন ড্রাইভ নির্মিত হওয়ার কথা ছিল। ট্রাফিক ভলিউম ও প্রয়োজনীয়তার ওপর ভিত্তি করে মেরিনেড্রাইভটি চার এবং ছয়লেন হিসেবে করা আর প্রতি লেনের দৈর্ঘ্য হবে ছিল ৩.৫ মিটার করে। জোড়ারগঞ্জ থেকে নগরীর পতেঙ্গা কর্ণফুলী টানেলের মুখ পর্যন্ত হচ্ছে ছয়লেন এবং টানেলের আনোয়ারা প্রান্ত থেকে কক্সবাজার শহরতলি পর্যন্ত ছিল চারলেন। আর প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৩.৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার-সমীক্ষা প্রতিবেদনে এমনটাই সুপারিশ করা হয়েছিল বলে সমীক্ষায় নিয়োজিত আন্তর্জাতিক কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে।
এর আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড বঙ্গোপসাগর উপকূলে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম হয়ে মিরসরাই এবং ফেনীর রেগুলেটর থেকে নোয়াখালীর রহমতখালী রেগুলেটর ও পুরো হাতিয়াসহ ৬৪২ কিলোমিটার উপকূল সুরক্ষায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০ মিটার উঁচু করে সুপার ডাইক নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। ২০১৯ সালের শুরুতে বাপাউবো কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ থেকে মিরসরাই এবং ফেনী রেগুলেটর থেকে নোয়াখালীর রহমতখালী রেগুলেটর পর্যন্ত (পুরো হাতিয়ার ৮৬ কিলোমিটারসহ) ৬৪২ কিলোমিটার দুইমুখী সড়কসহ গড়ে ১০ মিটার উঁচু করে সুপার ডাইক নির্মাণ প্রকল্প প্রণয়ন করেছিল এবং নানা ধরনের সমীক্ষাসহ প্রাথমিকভাবে প্রজেক্ট প্রোফাইল প্রস্তুত করে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওই প্রকল্পের কারিগরি সমীক্ষা সম্পন্নের পাশাপাশি পাউবোর কারিগরি কমিটিও ওই প্রকল্প অনুমোদন করেছিলেন। আগ্রহী দাতাদেশগুলোর কাছে প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠানোর জন্য ডিপিপি প্রণয়নের কাজ শেষ হয়েছিল। ওই সময়ে নেদারল্যান্ডস ও চায়না উপকূল সুরক্ষা প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য প্রাথমিকভাবে তাদের আগ্রহ প্রকাশের বিষয়টি জানিয়েছিলেন পাউবোর শীর্ষ কর্মকর্তারা।
বর্তমান সরকার জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলার সাথে আগামী ১০০ বছরের টেকসই উন্নয়ন ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে ডেল্টাপ্ল্যান প্রণয়ন করেছেন। কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবেই ২০১৯ সালের মে মাসের শেষ দিকে কক্সবাজার থেকে শুরু করে মিরসরাই হয়ে নোয়াখালীর রহমতখালী রেগুলেটর থেকে ফেনী রেগুলেটর পর্যন্ত পৃথক দুই প্রকল্পে ৬৪২ কিলোমিটার উপকূল সুরক্ষায় সুপার ডাইক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। একই সাথে পাউবোর সাবেক প্রধান প্রকৌশলী (নকশা) মোহাতার হোসেনকে প্রধান করে দুটি পৃথক কমিটি করে দেয়া হয়েছিল।
প্রথম পর্যায়ে ওই প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮০ হাজার ১৩২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের মিরসরাই পর্যন্ত ৪৩০ কিলোমিটার সুপার ডাইক নির্মাণের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৪ হাজার ৩৬ কোটি ৮৩ লাখ টাকা এবং অপর অংশে নোয়াখালীর রহমতখালী রেগুলেটর থেকে ফেনী রেগুলেটর পর্যন্ত ১২৬ কিলোমিটার ও পুরো হাতিয়া উপকূলের ৮৬ কিলোমিটারসহ ২১২ কিলোমিটার সুপার ডাইক নির্মাণের জন্য সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৫ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা।
ওই সময়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছিল, প্রস্তাবিত সুপার ডাইক নির্মাণ হবে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০ মিটার উঁচু করে এবং সুপার ডাইকের ওপর দুই লেনের (মেটোরেভল পেভমেন্ট) সড়ক এবং তীরের দুই দিকে ঢাল সুরক্ষায় নেয়া হবে বিশেষ ব্যবস্থা। জানা গেছে, কক্সবাজার জেলা থেকে চট্টগ্রামের মিরসরাই পর্যন্ত ৪৩০ কিলোমিটার সুপার ডাইক নির্মাণের মধ্যে, ১৯১ কিলোমিটার সন্দ্বীপ, ৬৩ কিলোমিটার কুতুবদিয়ায়, ধলঘাটায় ৩৮ কিলোমিটার এবং মহেশখালীতে ৯০ কিলোমিটার সুপার ডাইক নির্মাণ করা হবে। তাছাড়া তা বাস্তবায়নে রেগুলেটর ৩০টি, কানেকটিং ব্রিজ ৭টি (সাঙ্গু নদীতে ৬৮০ মিটার, জলকদর খালে ২৩২ মিটার, ছনুয়া খালে ১২০ মিটার, ইদগাহ খালে ১৪০ মিটার, বাকখালী খালে ২৫০ মিটার, মাতামুহুরী নদীতে ২৩০ মিটার ও বারুয়াখালী খালে নির্মিত হবে ১৬০ মিটার দীর্ঘ ব্রিজ)। অপরদিকে রহমতখালীর রেগুলেটর থেকে ফেনী রেগুলেটর পর্যন্ত ১২৬ কিলোমিটার সুপার ডাইক নির্মাণের মধ্যে ৭০টি রেগুলেটর, ১২টি কোজার ও ব্রিজ একটি রয়েছে। এ ছাড়া পুরো হাতিয়ার ৮৬ কিলোমিটার সুপার ডাইক (ঢাল) নির্মাণকাজ অন্তর্ভুক্ত ছিল ওই প্রকল্পে। পরবর্তীতে প্রথম পর্যায়ে ওই প্রকল্পের কক্সবাজার থেকে মিরসরাই পর্যন্ত অংশে ৪৩০ কিলোমিটার সুপার ডাইক নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় সংশোধিত করে ৪৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ধরা হয়েছিল এবং তা বাস্তবায়ন কাজ খুব দ্রুত এগিয়েছিল।
সমন্বিত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে কক্সবাজার থেকে শুরু করে নোয়াখালী হাতিয়া জেলা পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষের জীবন জীবিকার সুরক্ষার পাশাপাশি এই সুপার ডাইক কেন্দ্র করে শিল্প পর্যটন ও কৃষি ক্ষেত্রে নতুন বিপ্লবের সূচনা ঘটবে। মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী, সীতাকুণ্ড ইকোনমিক জোন, কোরিয়ান ইপিজেড, চট্টগ্রাম বন্দর, বাঁশখালীতে নির্মাণাধীন এস আলম কোল পাওয়ার প্ল্যান্ট, কক্সবাজারের মগনামাঘাট এলাকায় নৌবাহিনীর সাবস্টেশন, ধলঘাট এলএনজি টার্মিনাল ও কোল পাওয়ার স্টেশন, মহেশখালীর মেগা সিটি প্রকল্প, সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজমসহ শিল্প এলাকাসহ পুরো উপকূলীয় এলাকা সব ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হতে রক্ষা করবে এবং নতুন নতুন শিল্প কারখানা স্থাপনের মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে সুপার ডাইক। প্রস্তাবিত সুপার ডাইকের সাগর অংশের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে টেকসই বনায়ন ও সমুদ্রের মধ্যে সম্মিলন ঘটিয়ে ইকোট্যুরিজম স্পট সৃষ্টিসহ প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। এ ছাড়াও প্রস্তাবিত সুপার ডাইক জুড়ে টেকসই উপকূলীয় বনায়নের মাধ্যমে পাখির অভয়ারণ্য সৃষ্টি করা হবে ফলে, পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখাসহ জীববৈচিত্র্যও সুরক্ষিত হবে বলে বলা হয়েছিল সমীক্ষা প্রতিবেদনে।
জানা গেছে, সরকারের বিশেষ উদ্যোগ ডেল্টাপ্ল্যানের অংশ হিসেবে সুপার ডাইকের আদলে গৃহীত চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেজা) বন্যা নিয়ন্ত্রণ সড়ক কাম বেড়িবাঁধ প্রতিরক্ষা নিষ্কাশন শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলতি জুনে সম্পন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, ভারতসহ দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ইতোমধ্যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ শুরু করেছে বলে নিশ্চিত করেছিলেন সুপার ডাইক প্রকল্পের সদস্যসচিব ও পানি উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রাম ডিভিশন-২ এর সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী খ ম জুলফিকার তারেক (বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী)।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা