২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
মৃত্তিকাসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট

‘উপজেলা নির্দেশিকা’ বই না ছাপিয়ে টাকা উত্তোলন

নিয়োগ ও কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগ
-


মাটির নমুনা সংগ্রহের পর তা মৃত্তিকা গবেষণারের ল্যাবে পরীক্ষা শেষে মাটির গুণাগুণের তথ্য নিয়ে ভূমি ও মৃত্তিকাসম্পদ ব্যবহার নির্দেশিকা বা উপজেলা নির্দেশিকা প্রকাশ করে মৃত্তিকাসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই)। বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৫টি উপজেলার মাটির গুণাগুণ নিয়ে নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে এসআরডিআই। প্রতি উপজেলায় ২৫০ কপি করে প্রকাশিত উপজেলা নির্দেশিকার পেছনে খরচ হয়েছে প্রায় ৪৩ লাখ টাকা। সংশ্লিষ্ট মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান রিমিনি ইন্টারন্যাশনাল ওই টাকা উত্তোলনও করেছে; কিন্তু উপজেলা নির্দেশিকা এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
বিষয়টি জানার জন্য এসআরডিআই’র মহাপরিচালক (ডিজি) মো: জালাল উদ্দীনের দফতরে গেলে প্রথমে তিনি জানান, সব হয়েছে। ৩৫টি উপজেলার নির্দেশিকার তালিকা দেখিয়ে সেগুলো দেখতে চাইলে ডিজি মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (সিএসও) মো: আব্দুল হালিমকে দেখিয়ে দেন। তিনি সয়েল সার্ভে অ্যান্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ডিভিশনের প্রধান। ওই ডিজির দফতরেই বসা ছিলেন হালিম। তিনি বলেন, বই ছাপানোর কাজ চলছে।

১০ কার্যদিবসের মধ্যে উপজেলা নির্দেশিকা সরবরাহের কথা ছিল মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানকে- এখনো মুদ্রণ না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শোনেন এটা পেপারসের কথা। বাস্তব কথা হলো- আমাদের কাজটা চলতেই থাকে। কারেকশনের কাজ শেষ করতে পারে না। কারেকশন করেই তো প্রেসে দেয়া হয়- এ প্রসঙ্গে আব্দুল হালিম বলেন, আগে হলেও (সম্পাদনা) কত কাজ, কল্পনাও করতে পারবেন না। বিল দিলেও সিকিউরিটি রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
ঢাকা বিভাগের একটি জেলার এসআরডিআই’র এক আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তা জানান, তার জেলায় দু’টি উপজেলা নির্দেশিকা মুদ্রণ হয়েছে বলে জানতে পেরেছেন। কিন্তু একটি ল্যাবের রিপোর্ট এখনো জমাই দেয়া হয়নি। এ রকম আরো অনেক উপজেলা আছে বলে জানা যায়। অনেক উপজেলা ল্যাব রিপোর্ট না এলেও মুদ্রণের জন্য প্রেসে পাঠানোর বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন করা হয়। এ নিয়ে ডিজি নিজেও বিস্ময় প্রকাশ করেন। জবাব দেন আব্দুল হালিম। তিনি জানান, ল্যাবের কেমিক্যাল ডাটা’র পার্টটা অনেকসময় দেরিতে আসে। কিন্তু আমরা তো আর সে সময় পর্যন্ত বসে থাকি না। কিছু সমস্যা তো আছেই। করোনা পরবর্তী সময়ে এভাবে দেরিতেই নির্দেশিকা ছাপানো হচ্ছে বলে জানান সিএসও। তিনি বলেন, আমরা একটা জটে থাকি। আটটা উপজেলা নির্দেশিকা যেকোনো দিন প্রেসে প্রিন্ট হয়ে যাবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মাটির নমুনা সংগ্রহ করে আঞ্চলিক মৃত্তিকা গবেষণাগারে পাঠান এসআরডিআই’র আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তা। একটি উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে মাটির সর্বোচ্চ ২০০টি (আয়তন অনুযায়ী কম-বেশি) পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহ করে আঞ্চলিক কার্যালয়। একেকটি নমুনার ১৪টি উপাদান নিয়ে এনালাইসিস (বিশ্লেষণ) করেন আঞ্চলিক গবেষণাগারের সংশ্লিষ্টরা। মাটির গুণাগুণ বিশ্লেষণ করে তারা রিপোর্ট তৈরি করে আঞ্চলিক মৃত্তিকা কর্মকর্তার মাধ্যমে ঢাকার খামারবাড়িতে প্রধান কার্যালয়ের উপজেলা নির্দেশিকা সেলে পাঠান। সারা দেশ থেকে এভাবে নির্দিষ্ট উপজেলা থেকে ল্যাব রিপোর্ট জমার পর সম্পাদনার দায়িত্বে থাকা আব্দুল হালিম সম্পাদনা সম্পন্ন করার পর টেন্ডারের মাধ্যমে মুদ্রণের জন্য উপজেলা নির্দেশিকা সেলে পাঠান।
জানা গেছে, বরাদ্দের সব টাকা উত্তোলন করে টেন্ডার পাওয়া প্রতিষ্ঠান রিমিনি ইন্টারন্যাশনালকে দেয়া হয়েছে ইতোমধ্যে। একই প্রতিষ্ঠানকে গত বছরও মুদ্রণকাজ দেন সংশ্লিষ্টরা। অভিযোগ রয়েছে, ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে অনৈতিক সুবিধা নিয়েছে এসআরডিআই’র সিন্ডিকেট। তবে, প্রতিষ্ঠানটির মোবাইল নম্বরে কল দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

আব্দুল হালিম বলেন, সরকারি টাকা খরচ করা অনেক কঠিন। একবার বরাদ্দের টাকা ফেরত চলে গেলে সেটি আর পাওয়া যায় না। যে কারণে গত অর্থবছরের বরাদ্দের টাকা সবগুলো উত্তোলন করা হয়েছে। এ টাকা আত্মসাৎ হচ্ছে সেটি কোনোভাবে বলা যাবে না। আমরা ওই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে গ্যারান্টির একটি চেক নিয়ে রেখেছি, সেটি সিকিউরিটি হিসেবে। পরে উপজেলা নির্দেশিকা সেলে গিয়ে কথা হয় সেলের প্রধান নীলিমা আক্তার কোহিনূরের সাথে। তিনি বলেন, অনেক উপজেলার প্রতিবেদন এখনো পাওয়া যায়নি। খসড়া রেডি করা যায়নি। সে জন্য দেরি হচ্ছে। নির্দেশিকা প্রস্তুত না হলেও কেন টেন্ডার দিয়ে সরকারি টাকা উঠিয়ে নেয়া হলো- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বছরের পর বছর এভাবেই কাজগুলো হয়ে আসছে।
এ দিকে গত অর্থবছর শুধু নয়, তার আগের অর্থবছরের নির্দেশিকাও ঠিকঠাক ছাপানো হয়নি। প্রতি উপজেলায় আড়াই শ’ কপি নির্দেশিকা ছাপানোর বরাদ্দ থাকলেও নামেমাত্র কিছুসংখ্যক কপি ছাপিয়ে টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে বেশ অনেক বছর ধরেই। আগের বছর (২০২২-২৩ অর্থবছর) ৩৫টি উপজেলা নির্দেশিকা ছাপানো হয়। তবে, নির্দেশিকা সেলে গিয়ে ২৪টি উপজেলার নির্দেশিকা পাওয়া যায়। নিয়ম অনুযায়ী সব উপজেলার কপি সেখানে থাকার কথা- এ নিয়ে নীলিমা আক্তার কোহিনূর বলেন, এখানে নেই, লাইব্রেরিতে থাকার কথা। যদিও লাইব্রেরিতে সেটি পাওয়া যায়নি।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, কথিত একটি সিন্ডিকেট গত অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় থেকে কয়েক কোটি টাকা লোপাট করেছেন। পতিত স্বৈরাচার সরকারের শেষের দিকে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। এই নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েও দলবাজি ও অনিয়মের অভিযোগ তুলে তা বাতিলের দাবি উঠেছে। নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন সিএসও মো: আব্দুল হালিম ও সদস্যসচিব ছিলেন পিএসও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান।
এ ছাড়া গত অর্থবছরে কম্পিউটার-সামগ্রী ক্রয় না করেই এই খাতের ১০ লাখ টাকা, প্রধান কার্যালয়ে মাঠে কোনো গবেষণার কাজ না করেই ১৬ লাখ টাকা, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি খাত থেকে কোনো কিছু ক্রয় না করেই ১৮ লাখ টাকা, গবেষণা সরঞ্জামাদি খাত থেকে ৬৫ লাখ টাকা, কম্পিউটার সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের নাম করে ১২ লাখ টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়াও আউটসোর্সিং ও অনিয়মিত শ্রমিক হিসেবে টাকার বিনিময়ে কর্মচারী নিয়োগের অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। তবে, সংশ্লিষ্টরা অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement