২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

‘আরাকান আর্মি-জান্না বাহিনী উভয়েই রোহিঙ্গা নির্মূল করছে’

সম্প্রতি দালালের মাধ্যমে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গারা - সংগৃহীত

মিয়ানমারের বুচিডং মুত্তফিজপাড়ায় থাকেন নুর কায়দা। তার ভাই আদম আগেই এসেছেন বাংলাদেশে। আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর চলমান যুদ্ধে বুচিডং মুত্তফিজপাড়া, ছিন্দিপ্রাং, ওয়ারিচং, পুইমালিপাড়া, গোদামপাড়া, ছামিলাপাড়া এখন (মগবাগি) আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে।

নুর কায়দার চাচা হাকিম আলী এখন বাংলাদেশে। তিনি জানেন না তার ভাইয়ের মেয়ে নুর কায়দাসহ তার স্ত্রী, পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ের খবর।

গত ৪ আগস্ট রাতে মিয়ানমার থেকে ট্রলারযোগে নাফ নদী পেরিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন টেকনাফ নয়াপাড়া ২৪ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ই-ব্লকের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। একটি দালাল চক্রের হাতে মিয়ানমারের মুদ্রা পাঁচ লাখ কিয়াট দেয়ার পর তাকে মিয়ানমারের প্যারাংপুরু এলাকায় নৌকায় ওঠার সুযোগ দেয়া হয়।

ওই নৌকায় তখন তার সাথে ১০ জন এসেছেন। এমনি করে প্রতিদিন শত শত রোহিঙ্গা আসছে বলে জানান হাকিম আলী।

দু’দিন আগে পালিয়ে আসা সেতারা বেগম ও তার স্বামী কলিম উল্লাহ জানান, মিয়ানমারের জান্তা ও আরাকান আর্মির লড়াইয়ে তাদের বাড়ি-ঘর বিধ্বস্ত হওয়ার পর বৃদ্ধ মা-বাবা ও তিন সন্তানের খবর জানেন না। তারাও দালালের মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে এসেছেন।

সানা উল্লাহ নামের আরেক রোহিঙ্গা যুবক জানান, তিনি মংডুর কাছাকাছি এলে আরাকান আর্মির সদস্যরা তাকে আটকে রাখে। তাদের ক্যাম্পে নির্যাতন করে নানা বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়। ক্যাম্পে তিনি টানা তিন মাস ছিলেন। তাকে ছেড়ে দেয়ার পর অনেক চেষ্টায় টেকনাফ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক আত্মীয়ের সহযোগিতায় টেকনাফের এক দালালের সাথে আলাপ করেন। ওই দালালের দেয়া তথ্য অনুযায়ী প্যারাংপুরু এলাকায় নাফ নদীর প্যারাবনে অবস্থান নেন। নৌকা নিয়ে দালালরা যাওয়ার পর মিয়ানমারের পাঁচ লাখ কিয়াট দিলে নৌকায় তুলে এপাড়ে নিয়ে আসে। এরপর লুকিয়ে ক্যাম্পে পৌঁছেন।

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আত্মীয়ের বাড়িতে আসা আরেক রোহিঙ্গা কেফায়েত উল্লাহ জানান, তার সাত ছেলে-মেয়ে জীবিত থাকলেও স্ত্রী বোমার আঘাতে মারা গেছেন। সেখানে দু’পক্ষের সঙ্ঘাতে অনেকেই হতাহত হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা জীবন বাঁচাতে এদিক-ওদিক পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বেশিভাগই সীমান্তে জড়ো হয়েছে। এরাও আমাদের মতো বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে চায়।’

একইসাথে আলাপ হয় মংডু শহরের নিকটবর্তী এলাকার বৃদ্ধা রাহানুমা আক্তারের (৫২) সাথে। তিনিও পাঁচ লাখ কিয়াট দেয়ার পর দালালের সহায়তায় চার দিন আগে উখিয়ায় পৌঁছান। তিনি জানান, ২০১৭ সালে তার ছেলে বাংলাদেশে এসে ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিল। তিনি স্বামীসহ বাড়িতে থাকলেও সংঘর্ষের সময় তার বাড়ি পুড়ে যায়। স্বামী কোথায় আছেন তিনি জানেন না। পালিয়ে ছেলের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অনেকেই বলেছেন, সাড়ে চার লাখ থেকে পাঁচ লাখ কিয়াট দেয়ার পর নৌকায় তুলে তাদের টেকনাফ নিয়ে আসছে।

নয়াপাড়া ২৬ নম্বর ক্যাম্পের ই-ব্লকের কমিউনিটি নেতা (মাঝি) নুরুল আলম নতুন রোহিঙ্গা আসার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি জানান, নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা তাদের আত্মীয়-স্বজনের শেডে আশ্রয় নিচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো তাদের তালিকা হচ্ছে না বা খোঁজা হচ্ছে না।

গত রোববার বিকেলে উখিয়ার লম্বাশিয়া ক্যাম্পে নতুন আসা রোহিঙ্গা হাবিব উল্লাহর সাথে কথা হয়। তিনিও স্ব-পরিবারে আশ্রয় নিয়েছেন এখানে। তারা আসার আগে তার বাবাকে হত্যা করেছে আরাকান আর্মি। তিনি জানান, তার বাবাকে হত্যার পর তারা প্রাণ বাঁচাতে নৌকা নিয়ে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। মংডুর উত্তরের একটি গ্রামে তার বাড়ি, ওখানে এখন ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে। একের পর এক বোমা নিক্ষেপের কারণে এলাকার চিত্র পর্যন্ত পাল্টে গেছে।

প্যারাংপুরুসহ নাফ নদীর পাড়ের বেশ কিছু গ্রামে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছে। পালিয়ে আসা একাধিক রোহিঙ্গা কান্নাজাড়িত কণ্ঠে বলেন, তারা মংডু শহরের দলিয়াপাড়া ও সুদাপাড়া এলাকা থেকে এসেছেন। ওই পাড়ায় এখন রোহিঙ্গা শূন্য। সেখানে উভয়পক্ষ শক্তিশালী গ্রেনেড, বোমা, মর্টারশেলের পাশাপাশি ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। যুদ্ধবিমান থেকেও বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছে। তাতে অনেক মানুষ হতাহত হচ্ছে। প্রাণ রক্ষায় যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। দালালদের জনপ্রতি বাংলাদেশী ৩০ হাজার টাকা দিয়ে তারা সীমান্ত অতিক্রম করেছেন। এখন ক্যাম্পে প্রবেশের চেষ্টা করছেন।

বাংলাদেশী এক টাকায় মিয়ানমারের মুদ্রায় ১৭ কিয়াটের বেশি।

উখিয়ায় ১১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কথা হয় আরাকান সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান ডা. জুবায়েরের সাথে।

তিনি বলেন, ‘জাতিসঙ্ঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা ক্রাইসিসকে গুরুত্ব না দেয়ায় আজকের দিনের এই চিত্র দেখতে হচ্ছে। মূলত আরাকান আর্মি ও জান্না বাহিনীর লড়াই দেখিয়ে রোহিঙ্গা নির্মূল করা হচ্ছে। সে কারণে নিরস্ত্র, নিরীহ রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে এদেশে ছুটে আসছে। এতে সমস্যা আরো জটিল হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার বোঝা সহ্য করে যাচ্ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘নতুন করে রোহিঙ্গারা যাতে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত না হয় সে জন্য এখনই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আওয়াজ তুলতে হবে।’


আরো সংবাদ



premium cement