মিয়ানমারে ফের বিস্ফোরণের শব্দ, মুসলিম রোহিঙ্গাদের নিধন করার টার্গেট!
- হুমায়ুন কবির জুশান, উখিয়া (কক্সবাজার)
- ২৯ জুন ২০২৪, ১৮:১৫
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তঘেঁষা রাখাইন রাজ্যের মংডুতে সরকারি বাহিনীর সাথে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সংঘাত এখনো চলমান। এতে রয়েছে মুসলিম রোহিঙ্গাদের নিধন করার টার্গেট।
শুক্রবার (২৮ জুন) ভোর সাড়ে ৫টায় বিকট শব্দে ঘুম ভাঙে সীমান্তের মানুষের। এরপর থেকে থেমে থেমে মিয়ানমার থেকে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসতে থাকে।
স্থল ও আকাশ পথে হামলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে আসা বিকট শব্দ এখনো থামেনি।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, ২০১২ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সংখ্যাগুরু আদিবাসী রাখাইন এবং রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে জাতিগত দাঙ্গা শুরু হলে বেশ কয়েকজন নিহত হন।
নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই ছিলেন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর। দাঙ্গায় প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। ওই ঘটনার পর সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের চলাচলের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে এবং ১৯৮২ সালের একটি বৈষম্যমূলক আইনের অধীনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে। অথচ এই রোহিঙ্গারায় মিয়ানমার পার্লামেন্টে সদস্য ছিলেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন।
২০১৮ সালের শেষ ভাগে স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে আরাকান আর্মি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। প্রায় দুই বছর ধরে তীব্র লড়াইয়ের পর ২০২০ সালের নভেম্বরে উভয় পক্ষ একটি যুদ্ধবিরতিতে আসে। কিন্তু মাত্র তিন মাসের মাথায় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে দেশটির সেনাবাহিনী। রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান হলেও কয়েক দিনের মাথায় সাধারণ মানুষ অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন শুরু করেন।
শান্তিপূর্ণ ওই আন্দোলন থামাতে সরকারের দমন-পীড়নে বহু মানুষ নিহত হয়। ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে দেশজুড়ে বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করে। গত বছরের অক্টোবরে কয়েকটি সসশস্ত্র সংগঠন জোট গঠন করে অপারেশন ২০১৭ নামে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে। আরাকান আর্মিও ওই জোটে যোগ দেয়। ফলে আজকের এই অবস্থা।
২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোয় অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দলে দলে বাংলাদেশে আসতে থাকে রোহিঙ্গারা। ওই সময় ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। তারা বর্তমানে উখিয়া-টেকনাফ ও ভাসানচর আশ্রয় শিবিরে বসবাস করছে। মিয়ানমারের চলমান সংঘাতে ঘরবাড়ি ও বহু লোকজনের হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে বাংলাদেশ সীমান্তের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ সীমান্তে মর্টার শেল ও বোমার বিকট শব্দে আতঙ্কে রয়েছেন সীমান্ত এলাকাসহ পাশ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দারা।
তবে বিজিবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভয়ের কোনো কারণ নেই। সীমান্তে বিজিবি কঠোর অবস্থানে রয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর সাথে স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সংঘাত চলছে।
মংডুতে অবস্থানরত কলিম উল্লাহ মোবাইলে তার বন্ধু সেলিম উল্লাহকে বলেন, রাজ্যের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমান জাতিগোষ্ঠীর ওপর চরম নির্যাতন শুরু হয়েছে। ব্যাপক হামলায় বাঁচতে রোহিঙ্গা মুসলমানেরা বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে ছুটে চলেছেন। ২৪ বছরের কলিম উল্লাহ সংঘাত শুরুর আগে রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করা একটি নাগরিক সংগঠনে চাকরি করতেন। সংঘাত শুরু হলে তাদের অফিস বন্ধ হয়ে যায়।
সেতারা নামের আরেক শিক্ষিত রোহিঙ্গা নারী উখিয়া ময়নাঘোনা ক্যাম্পের তার বান্ধবী নুরে জান্নাতকে জানান, মংডুতে আমরা বাড়িতে থাকতে পারছি না, কাজে যেতে পারছি না, এমনকি সময়মতো ঘুমাতেও পারছি না। যে সময়ে আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ার কথা সে সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ২০১৭ সালের ভয়াবহ জাতিগত দাঙ্গার পর থেকেই রাখাইন রাজ্য অশান্ত। ২০২১ সালের সেনা অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে লড়াইয়ের তীব্রতা বৃদ্ধির কারণে সেখানকার পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে।
এদিকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘাতে অন্তত ২০ দিনের বেশি বন্ধ ছিল টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে নৌ চলাচল।
তবে প্রশাসনের অনুমতিতে উত্তাল সাগরের বিকল্প পথে ঝুঁকি নিয়ে কিছু সংখ্যক নৌযান চলাচল করলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো অস্বাভাবিক। এতে জরুরি চিকিৎসা, নিত্যপণ্যের যোগান ও প্রয়োজনীয় কাজে যাতায়তসহ নানা ভোগান্তিতে রয়েছে সেন্টমার্টিনবাসী। অন্যদিকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলা সংঘাতে ওপার থেকে ভেসে আসা গুলির শব্দে আতঙ্কিত দ্বীপবাসী।
ভুক্তভোগী জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের দেয়া তথ্যে জানা যায়, নাব্যতা সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশী নৌযানগুলোকে নাফ নদীর মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া অংশ হয়ে যাতায়াত করায় সৃষ্টি হয়েছে ভোগান্তি। তাদের দাবি শাহপরীরদ্বীপ এলাকায় ভরাট হয়ে যাওয়া অংশ খনন করে নাব্যতা সৃষ্টির পাশাপাশি সাগরের গোলারচর পয়েন্টে জেটি ঘাট নির্মাণ করলে সঙ্কটের সমাধান হবে।
এ নিয়ে জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্বীপটির যোগাযোগ সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানে নাফ নদীতে খনন কাজের পাশাপাশি নতুন জেটিঘাট নির্মাণে সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। গত বছরের মধ্য অক্টোবর থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলছে দেশটির সরকারি বাহিনীর সাথে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সংঘাত। সম্প্রতি নাফ নদীর বাংলাদেশের জলসীমার কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে মিয়ানমারের নৌবাহিনীও ওই সংঘাতে অংশ নেয়। বিদ্রোহী গোষ্ঠীও মিয়ানমার নৌ বাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করে চালায় ভারী গোলাবর্ষণ। এতে বিবাদমান দুইপক্ষের মধ্যে চলছে তীব্র লড়াই। যার প্রভাব পড়েছে সেন্টমার্টিনসহ টেকনাফের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায়। তারমধ্যে গত ৫ জুন নাফ নদীর জলসীমায় নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকায় প্রথমবারের মতো টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে চলাচলকারী নৌযান লক্ষ্য করে মিয়ানমার থেকে গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটে। এরপর আরো কয়েকবার সেন্টমার্টিন যাতায়াতকারী নৌযান লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়েছে।
এতে নিরাপত্তার স্বার্থে ওই রুটে বন্ধ করে দেয়া হয় নৌযান চলাচল। এদিকে সেন্টমার্টিনের সাথে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম নৌপথ নাফ নদীর মোহনার দুই স্থানে জেগে উঠেছে ডুবোচর। এই ডুবোচরের কারণে সেন্টমার্টিনে যাতায়াতকারী নৌযানগুলোকে নাফ নদীর মিয়ানমার জলসীমার সামান্য একটি অংশ ব্যবহার করতে হয়। টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীরদ্বীপ এলাকায় নাফ নদীর ওই অংশে ড্রেজিং করা হলে সেন্টমার্টিনে যোগাযোগের জন্য মিয়ানমারের জলসীমা ব্যবহার করতে হবে না। এতে সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান হবে বলে জানান দ্বীপবাসী ও জনপ্রতিনিধিরা।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দা কেফায়াত উল্লাহ জানান, সীমান্তে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে দ্বীপের মানুষ একপ্রকার সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছেন। এতে চিকিৎসা, নিত্যপণ্যের যোগান ও প্রয়োজনীয় কাজে যাতায়াতসহ নানা ভোগান্তিতে পড়েছে। বর্তমানে বিকল্প পথে দৈনিক কয়েকটি করে ট্রলার যাতায়াত করলেও সাগর উত্তাল থাকায় চলাচলে জীবন ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই নাফ নদীতে জেগে উঠা ডুবোচর খননের পাশাপাশি সাগরের গোলারচর পয়েন্টে নতুন একটি জেটি ঘাট নির্মাণের দাবি দ্বীপবাসীর।
অন্যদিকে সীমান্তের নিরাপত্তার প্রসঙ্গে টেকনাফ-২ বিজিবির ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো: মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদী ও সীমান্তে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বিজিবি। রাখাইন পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আদনান চৌধুরী বলেন, মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ড টহল জোরদার করা হয়েছে। তবে মিয়ানমার থেকে আসা বিকট বিস্ফোরণের শব্দ এখনো থামেনি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা