পছন্দ হলেই মাদকের অভিযোগে নারীদের তুলে এনে ধর্ষণ করতেন ওসি প্রদীপ
- হুমায়ুন কবির জুশান, উখিয়া (কক্সবাজার)
- ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৬:৩৭, আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৬:৪৩
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেজর সিনহা মো: রাশেদ খান হত্যা মামলার আসামি টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপের মৃত্যুদণ্ডাদেশ শোনার পরই একে একে মুখ খুলতে শুরু করেছেন ভুক্তভোগীরা। মাদক নির্মূলের বাহানায় ক্রসফায়ারের নামে কন্ট্রাক্ট কিলিং, লোকজনকে জিম্মি করে টাকা আদায়, পছন্দ হলেই যেকোনো মেয়েকে মাদক কারবারির তকমা দিয়ে বাড়ি থেকে তুলে থানায় এনে ধর্ষণ করেছেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগে বলা হচ্ছে, এ পর্যন্ত টেকনাফের শতাধিক তরুণীকে ধর্ষণ করেছেন তিনি।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ ছাড়াও মামলার তদন্ত কর্মকর্তার তদন্তে উঠে এসেছে পুলিশের এই সাবেক কর্মকর্তার ধর্ষণ-সম্পৃক্ততার নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। অভিযোগ রয়েছে, অনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে প্রদীপ আয় করেছেন শত শত কোটি টাকা। দেশ-বিদেশে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।
বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশের চাকরিজীবনের পুরোটাই সমালোচনা ও বিতর্কে ভরা। বিতর্কিত এই পুলিশ কর্মকর্তা নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে চাকরিজীবনে বরখাস্ত ও প্রত্যাহার হয়েছেন কমপক্ষে পাঁচবার। প্রতিবার কোনো না কোনো খুঁটির জোরে ফিরেছেন স্বপদে। পদে ফিরেই পুনরায় ধারণ করেছেন হিংস্ররূপ।
ভুক্তভোগী পরিবার ও স্থানীয়দের দাবি, টেকনাফ থাকার সময়ে ওসি প্রদীপ ও তার সহযোগীরা ৫০ জনের বেশি নারীকে ‘ইয়াবা কারবারি’ বলে বাড়ি থেকে তুলে এনে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করেছেন। তখন প্রদীপের ভয়ে কেউ এ ব্যাপারে মুখ খোলার সাহস পাননি।
উখিয়ার কোর্ট বাজারের নির্যাতিতা এক তরুণীর অভিভাবক জানান, ২০১৯ সালের শেষের দিকে তাদের কলেজপড়ুয়া মেয়ে টেকনাফে প্রেমিকের সাথে দেখা করতে গেলে প্রেমিকসহ কয়েকজন মিলে তাকে ধর্ষণ করেন। বিষয়টি ওসি প্রদীপ পর্যন্ত গড়ায়। ওই সময় ধর্ষকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে প্রদীপ নিজেও কয়েক দিন আটকে রেখে একাধিকবার ধর্ষণের পর ইয়াবা দিয়ে ওই তরুণীকে কোর্টে চালান করে দেন।
‘ওসি প্রদীপ ও তার সহযোগীরা ২০২০ সালে আমার দুই কিশোরী মেয়েকে অস্ত্র ঠেকিয়ে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যান। এরপর দীর্ঘদিন থানার দ্বিতীয় তলায় আটকে রেখে ধর্ষণ করেন ওসি প্রদীপ। পরে ওদের ইয়াবা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। ছাড়া পেয়ে মেয়েরা বাড়ি ফিরে এলে কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়।’
রাশেদ হত্যা মামলার রায়ের দিন ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধনে অংশ নিতে এসে আদালতে এভাবেই মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন এক নারী। তিনি সিনহা হত্যা মামলার ২০তম সাক্ষী।
প্রশাসন ওসি প্রদীপের পক্ষে থাকায় তখন মামলা করার সাহস পাননি দাবি করে ওই নারী জানান, মেজর সিনহা হত্যা মামলার পর তিনি সাহস পেয়েছেন। আদালতে ধর্ষণ মামলা করেছেন ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে। মামলাটি বর্তমানে আদালতের নির্দেশে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত করছে।
সিনহা হত্যা-পরবর্তী টেকনাফে প্রদীপ আমলের কথিত বন্দুকযুদ্ধে ১৬১ জনকে হত্যা ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায়ের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ওই সময় ভুক্তভোগীদের কেউ মামলা না করায় ধামাচাপা পড়ে প্রদীপের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগগুলো।
ধর্ষণের শিকার টেকনাফের নাজিরপাড়া এলাকার এক গৃহবধূ অভিযোগ করেন, স্বামীকে ধরে নিয়ে গিয়ে ৪৫ লাখ টাকা দাবি করেন ওসি প্রদীপ। তিন লাখ টাকা, ব্যবহারের স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে স্বামীকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় যান তিনি। স্বামীকে ছেড়ে দেয়ার কথা বলে তিন দিন পর্যন্ত আটকে রেখে ওসি প্রদীপসহ কয়েকজন মিলে তাকে ধর্ষণ করেন। পরে স্বামীকে ছেড়ে দেয়া হবে বলে তাকে বাড়ি চলে যেতে বলা হয়। পরদিন তার স্বামীর গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। ওই সময় ধর্ষণের বিষয়ে মুখ খুললে পরিবারের সবাইকে হত্যার হুমকি দেন প্রদীপ। নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে চুপ থাকেন তিনি।
ওসি প্রদীপের ধর্ষণের শিকার হওয়ার অভিযোগ করে টেকনাফের হ্নীলার আরেক গৃহবধূ জানান, তার স্বামীর কাছে চাঁদা দাবি করে স্থানীয় সন্ত্রাসী গিয়াস বাহিনীর লোকজন। চাঁদা না দেয়ায় একদিন সন্ধ্যায় এসআই মশিউর বাড়িতে এসে তাকে (গৃহবধূ) ইয়াবা কারবারি বলে ধরে নিয়ে যান। পরে অজ্ঞাত স্থানে টানা তিন দিন আটকে রেখে ওসি প্রদীপ ও সন্ত্রাসীরা তাকে ধর্ষণের পর মরিচের গুঁড়া দিয়ে গোপনাঙ্গে পাশবিক নির্যাতন চালান। এরপর ইয়াবা দিয়ে আদালতে চালান করে দেয়া হয়। তার দাবি, একইভাবে প্রদীপের ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তাদের পরিবারের ছয় নারী।
অভিযোগ আছে, টেকনাফ হোয়াইক্যং এলাকার এক ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে গিয়ে অর্ধকোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন ওসি প্রদীপ। টাকা দিতে না পারায় তিন দিন পর কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে তাকে হত্যা করা হয়। এ বিষয়ে প্রতিকার পেতে নিহতের মেয়ে এবং বোন কক্সবাজার আদালতে যান। খবর পেয়ে ওই দুই নারীকে তুলে নিয়ে যান ওসি প্রদীপের লোকজন। তাদের থানায় আটকে রেখে টানা পাঁচ দিন গণধর্ষণের পর ইয়াবা দিয়ে চালান দেয়া হয়।
এদিকে ধামাচাপা পড়ে যাওয়া একাধিক ধর্ষণের অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান করেন প্রতিবেদক। ভুক্তভোগী নারীদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে খোঁজ করে পাওয়া যায় কক্সবাজার জেলা কারাগারের তৎকালীন মেডিক্যাল রাইটার হাজতি মো: ইউসুফকে। তিনি প্রদীপের কাছে ধর্ষিত হওয়া অসংখ্য নারীকে কারাগারে থাকাকালে চিকিৎসা দিয়েছেন বলে জানান।
ইউসুফ জানান, ঘটনাক্রমে একটি মিথ্যা মামলায় ফেঁসে গিয়ে দীর্ঘদিন কারাভোগের পর ২০২০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। হাসপাতালের টেকনোলজিস্ট ও চিকিৎসার বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকায় তাকে কারা মেডিক্যালের রাইটার হিসেবে দায়িত্ব দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। সেই সুবাদে কারাগারে থাকা সব রোগীর তিনি দেখভাল করতেন।
তিনি আরো জানান, টেকনাফের ১৬ বছরের এক তরুণী তাকে জানিয়েছিল, বাড়ি থেকে ধরে এনে তাকে থানায় ১৫ দিন আটকে রাখেন ওসি প্রদীপ। এ সময়ের মধ্যে একাধিকবার প্রদীপ তাকে ধর্ষণ করেন। পরে আরো কয়েকজন পুলিশ সদস্যও তাকে ধর্ষণ করেন। ধর্ষণের পর প্রত্যেকবার গোপনাঙ্গে মরিচের গুঁড়া দিয়ে নির্যাতন করা হয় তাকে। এ সময় যন্ত্রণায় চিৎকার করলে প্রদীপ ও তার সহযোগীরা উল্লাস করতেন বলে জানান ওই তরুণী। পরে তাকে ইয়াবা দিয়ে চালান করে দেয়া হয়েছিল। কারাগারে এসে অসুস্থতার কারণে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন ওই তরুণী। পরে সদর হাসপাতালে নিয়ে তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল। তার বুকে-পিঠে অমানুষিক নির্যাতনের চিহ্ন ছিল।
একইভাবে কারাগারে আসা টেকনাফের রঙ্গিখালীর এক তরুণী ইউসুফকে জানিয়েছিল, বাড়ি থেকে তুলে এনে এক মাসের বেশি সময় আটকে রেখে একাধিকবার ধর্ষণ করেন ওসি প্রদীপ। পরে মরিচের গুঁড়া দিয়ে তাকেও নির্যাতন করা হয়। সর্বশেষ ইয়াবা দিয়ে তাকেও চালান করে দেয়ার ভয়াবহ বর্ণনা ওই তরুণীর মুখে শুনেছেন ইউসুফ। এভাবে কারাগারে আসা অনেক নারী চিকিৎসা নিতে এসে প্রদীপের ধর্ষণের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ইউসুফ।
উখিয়া রাজাপালং ইউনিয়নের বর্তমান মেম্বার হেলাল উদ্দিন বলেন, আমার বাবা সাবেক মেম্বার বখতিয়ার অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন জনপ্রতিনিধি ছিলেন। ওসি প্রদীপ টেকনাফ থানা থেকে এসে তৎকালীন উখিয়া থানার ওসি মর্জিনাসহ বাড়িতে প্রবেশ করে টাকা-পয়সা সব লুটে নিয়ে বাবাকে তুলে নিয়ে যান টেকনাফে। সেখানে গুলি করে হত্যা করা হয় বাবাকে।
সিনহা হত্যা মামলা তদন্ত করতে গেলে অনেক নারী ওসি প্রদীপের ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন মামলার সংশ্লিষ্টরা। প্রদীপের বিরুদ্ধে ধর্ষণের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে জানিয়ে আদালতে একটি আলাদা প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে জানিয়েছিলেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
গত বছরের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো: রাশেদ খান। এ ঘটনায় পুলিশ তিনটি (টেকনাফে দু’টি, রামুতে একটি) মামলা করে। ঘটনার পর ওই বছরের ৫ আগস্ট কক্সবাজার আদালতে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন মেজর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। সোমবার ওই মামলায় প্রদীপ কুমার দাশকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা