‘আমাদের একটা ঘর করে দেন’
- এম মাঈন উদ্দিন, মিরসরাই (চট্টগ্রাম)
- ১৭ মে ২০২০, ১৫:৪৭, আপডেট: ১৭ মে ২০২০, ১৫:৫০
রেলওয়ের পরিত্যক্ত জীর্ণ-শীর্ণ কোয়াটারের কাছে যেতেই মিলনের দেখা। মুখে এক গাল হাসি, পরনে ছেড়া জামা। মিলনকে সাথে নিয়ে ওদের ঘরের কাছে যেতেই দরজায় দেখা মেলে মা আলেয়া বেগমের। সন্তানকে নিয়ে থাকেন এই কোয়াটারে। স্বামীর ঘরে ঠাই হয়নি তার।
মিরসরাই উপজেলার খইয়াছড়া ইউনিয়নের বারতাকিয়া রেলস্টেশনের পরিত্যক্ত কোয়াটারে সন্তানকে নিয়ে থাকেন আলেয়া বেগম। এলাকার দেলোয়ার বাবুর্চির সাথে কাজ করতেন বিয়ে বাড়িতে বা কোনো অনুষ্ঠানে। এখন তিনি কাজ আর করেন না। সপ্তাহে দুই দিন দুই শ’ টাকা বেতনে স্টেশন ঝাড়ু দেন আর মানুষের বাড়িতে কাজ করেন।
আর ছোট্ট মিলন, সে কী করে?
স্টেশনে টই টই করে ঘুরে বেড়ায়, গাছে গাছে উঠে টিয়া পাখির খোঁজে। দিন এভাবেই কেটে যায় মিলনের। সন্ধ্যা হলেই মা-ছেলে স্টেশনে বসে থাকেন। ঘরে বাতি জ্বালানোর তেল নেই। ঘুমানোর সময় হলেই অল্প সময়ের জন্য বাতি জ্বালিয়ে মা-ছেলে খেয়ে ঘুমাতে যান।
করোনার প্রসঙ্গ টানতেই বোঝা গেলো, এই ভাইরাসের ভয়ের চেয়ে বড় হলো ক্ষুধার যন্ত্রণা।
আলেয়া বেগমের বাবার বাড়ি রংপুর। তারা দুই বোন। বোন রাজিয়া ছাড়া আর কেউ নেই তার। শৈশবে বাবা বজলুছ ছোবহান স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে জীবিকার উদ্দেশ্য মিরসরাই আসেন। থাকতেন ভাড়া বাসায়। মানুষের জমিতে বর্গা চাষ করতেন।
আলেয়া বেগমের বয়স বাড়তে থাকে। বাবা বিয়ে দেন পাশ্ববর্তী জেলা ফেনীর নুরুল আমিনের কাছে। বিয়ের এক বছর পর তাদের ঘরে জন্ম নেয় মিলন। নুরুল আমিন পেশায় রিক্সাচালক ছিলেন। মিলনের যখন এক বছর তখন তার বাবা আবার বিয়ে করে তাদের রেখে চলে যান। সেই থেকে শুরু হয় আলেয়া বেগমের সংগ্রামী জীবন। আলেয়া বেগমের থাকার কোনো জায়গা নেই। আজ থেকে প্রায় আট বছর আগে তখনকার স্টেশন মাস্টার রেলস্টেশনের পাশেই পরিত্যক্ত একটি কোয়াটারে তাদের থাকার জায়গা করে দেন। তবে আজও কোয়াটারে নেই বিদ্যুৎ সংযোগ।
জীর্ণ-শীর্ণ ঘরের মেঝে, জানালা দরজা ভাঙ্গা। নেই খাট, ছেড়া পুরোনো শীতল পাটি মেঝেতে বিছিয়ে ঘুমায় মা-ছেলে। মশারি আর কিছু হাড়ি-পাতিল ছাড়া কিছুই নেই ঘরে। নেই গোসলের পানির ব্যবস্থা, স্টেশন পাশে পাহাড়ি ছড়া। সেই পানিতেই গোসল করা হয়। খাওয়ার পানি আনা হয় সেখান থেকেই।
আলেয়া বেগমের অভিযোগ, আশেপাশের কিছু মানুষ তাদের ঘৃণা করা। সরকারি ত্রাণ বা কোনো প্রকার সাহায্য পৌঁছায় না তাদের ঘরে। তবে এলাকার অনেক মানুষ সাহায্য সহযোগিতা করে মাঝে মাঝে এমনটাই জানান।
মিলনকে নিয়ে মায়ের অনেক স্বপ্ন ছেলে পড়ালেখা করবে একদিন মানুষ হবে। চলমান এই অবস্থার পরিবর্তন হবে মিলনের হাত ধরেই। কিন্তু মায়ের দুশ্চিন্তা ছেলের পড়ালেখার খরচ যোগাড় করবে কীভাবে? কে নিবে ছেলের পড়ালেখার দায়িত্ব?
মিলনের সাথে কথা বলতেই বলে উঠে, ‘আমাদের একটা ঘর করে দেন। আমাদের ঘর ভেঙ্গে ফেলবে।’
কেন ভেঙ্গে ফেলবে?
মিলন জানায়, এলাকার ছেলেরা নাকি বলেছে, ওদের ঘর ভেঙ্গে ফিলবে। এ নিয়ে মিলনের মায়ের ভীষণ দুশ্চিন্তা। কারণ তাদের নিজেদের ভিটে-বাড়ি এবং স্বজন কেউ নেই।
এ ব্যাপারে বারতাকিয়া রেলস্টেশেনের সহকারী স্টেশন মাস্টার গ্রেড-৪ আশরাফ আলী বলেন, ‘এখানে আমি নতুন এসেছি। জানতে পারি অনেক আগে এখানকার স্টেশন মাস্টার তাদের মা-ছেলেকে থাকতে দেয় পরিত্যক্ত কোয়াটারে। প্রতি শনিবার ও বৃহস্পতিবার স্টেশন ঝাড়ু দেয় মিলনের মা।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলরুট ব্রডগেজে রূপান্তরের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ব্রডগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। যার কারণে ভাঙ্গা পড়তে পারে রেলস্টেশনসহ পরিত্যক্ত কোয়াটার।’
স্থানীয় তরুণ মেহেরাব অনিক জানায়, আমরা বন্ধু-বান্ধবসহ আমি ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। মাঝে মাঝে খোজঁ খবর নিই। বাস্তবতা হচ্ছে ওরা ভিটে-মাটিহীন। সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসলে একটি পরিবার বেঁচে যায়।’