০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২১ মাঘ ১৪৩১, ৪ শাবান ১৪৪৬
`

চট্টগ্রামে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে সিএমপি

৩ দিনে আটক ৭০
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের লোগো - ছবি : নয়া দিগন্ত

চট্টগ্রামে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে রয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরী একের পর এক ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল, যুবদল নেতার বিতর্কিত কাণ্ড, নেভি কনভেনশন সেন্টার থেকে আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেফতার এবং সবশেষে পুলিশ কমিশনারের হুঁশিয়ারি এ যেন এক অস্থিতিশীল নগরীর প্রতিচ্ছবি।

এসব ঘটনায় চট্টগ্রামবাসীর মনে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ ও শঙ্কা। তবে, পুলিশের কঠোর অবস্থানের ফলে কিছুটা হলেও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে নগরবাসী।

এর আগে ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগরের জিইসি মোড়ে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিলের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ঘটনার সূত্রপাত। এ ঘটনায় কর্তব্যরত এক উপপরিদর্শককে বরখাস্ত করা হয়। সিএমপি কমিশনারের কড়া বার্তা ছিল ‘ভবিষ্যতে এ ধরনের মিছিল তারা (ছাত্রলীগ) করতে পারবে না’। কিন্তু কে শোনে কার কথা!, পর দিনই ১ ফেব্রুয়ারি ডবলমুরিং থানার পাঠানটুলি রোডে আবারো ঝটিকা মিছিল করে নিষিদ্ধ সংগঠনটি।

এই ঘটনার পর পরই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজে ৫২ সেকেন্ডের একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়। ভিডিওর ক্যাপশনে লেখা ছিল, ‘অবৈধ ইউনূসের বিরুদ্ধে ডবলমুরিং থানা ছাত্রলীগ আয়োজিত চট্টগ্রাম নগরীর পাঠানটুলী রোডে মিছিল’। তবে, পুলিশ এই ভিডিওর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও মিছিল করার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে দাবি পুলিশের।

এমনকি মিছিল দেখেছে এমন কোনো প্রত্যক্ষদর্শীও পাওয়া যায়নি। পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা, ভিডিওটি ভুয়া এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গুজব ছড়ানোর জন্য এটি প্রচার করা হচ্ছে। গুগলম্যাপ ঘেঁটে ভিডিওর সাথে ক্রসচেক করে পুলিশের মনে হয়েছে মিছিলটি পুরোনো।

৩০ জানুয়ারি জিইসি এলাকায় মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি মিজানুর রহমান। পুলিশ তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে পাঁচজন ছাত্রলীগ কর্মীকে গ্রেফতার করে। খুলশী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) হৃদয় মাহমুদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক মামলার সুপারিশ করা হয়েছে।

একই দিন সন্ধ্যায় চেরাগী পাহাড়-জামালখান সড়কে গণ-অভ্যুত্থানের হামলা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ জড়িত সবার বিচার দাবিতে অনশনরত শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের জবাবে নগর পুলিশের কমিশনার হাসিব আজিজ বলেছিলেন, ‘সকাল ৬টার দিকে দেড় মিনিটের মিছিল করেছে। তারা নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন। তারা প্রকাশ্যে এভাবে মিছিল করতে পারে না। আশা করছি, ভবিষ্যতে এ ধরনের মিছিল তারা করতে পারবে না।’

এদিকে ৩০ জানুয়ারি জিইসি মোড়ে ছাত্রলীগের মিছিলের পর যুবদল নেতা আব্দুল হামিদ পিন্টু ছাত্রলীগকর্মী অভিকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনার ঘটনা এবং পরবর্তীতে সেই যুবদলনেতাকে বহিষ্কারের ঘটনাও বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। ৩১ জানুয়ারি নেভি কনভেনশন সেন্টার থেকে ছাত্রদের দাবির মুখে আটক হন এক আওয়ামী লীগ নেতা। এ ঘটনাও নগরীতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।

একের পর এক অপ্রীতিকর ঘটনার প্রেক্ষিতে ছাত্রলীগের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে সিএমপি। গত তিনে দিনে চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন থানায় অভিযান চালিয়ে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগের প্রায় ৭০ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মামলা রয়েছে।

সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে গণমাধ্যমে প্রেরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে পুলিশ জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় সিএমপির বিভিন্ন থানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রুজু করা মামলাসহ সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মোট ৪২ জন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বায়েজিদ থানার আসামি মামনুর রশিদ মামুন, তারিকুল ইসলাম, মো: আশেকুল আলম আশিক, মোহাম্মদ এরশাদ, ইরাত শরীফ বিজয়, আব্দুল আজিম অপু, ইয়াছিন আরাফাত, এস এম নাজমুল আলম শুভ, মো: আসরাফ উদ্দিন সাদমান, সাজেদা বেগম, মো: ইশতিয়াক মুন্না, মো: ইলিয়াছ, মো: মজনু, রাজীব দে, চান্দগাঁও থানার আসামি আদিত্য পাল, সাইদ ইমতিয়াজ সানি, আহমদ আলী, মো: শাহারিয়ার শাওন, আব্দুল হান্নান (হিরা), মো: মাসুদ রানা, মেহেদী হাসান, মো: ফরহাদ, শাহাদাত হোসেন রুমান, মো: জহির উদ্দিন, চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্র লীগের সহ-সম্পাদক আবির সেন গুপ্ত, চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্র লীগের উপ-ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক অনিক সেন গুপ্ত, চট্টগ্রাম স্টেশন রোডস্থ হকার্স লীগের সভাপতি মো: কবির প্র: সেন্ট কবির, তানভীর রহমান নওশাদ, আলী আকবর, রেজাউল করিম, মোহাম্মদ ফারুক, মো: ইকবাল হোসেন, মো: রাজু, আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নওয়াব আলী, ১৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক মো: সেলিম, ১৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মো: ওবায়েদ, মো: আলমগীর, মো: হাসান, কর্ণফুলী থানার চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আহম্মদ আলী, মো: সোহাগ এবং সাইফুল ইসলাম।

আসামিদের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতার উপর হামলাসহ বিশেষ ক্ষমতা আইনে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে এক বা একাধিক মামলা রয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। এর আগে, চট্টগ্রাম নগরের সদরঘাট থানা এলাকায় মিছিলের প্রস্তুতিকালে অভিযান চালিয়ে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের ১০ নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তারও আগে শনিবার আরো ১৫ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

চট্টগ্রামে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের লাগামহীন তৎপরতায় যে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল, পুলিশের এই হার্ডলাইন অবস্থানের ফলে তা কিছুটা হলেও লাঘব হবে বলে মনে করছেন চট্টগ্রামবাসী।

চট্টগ্রাম মহানগর শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি এস এম লুৎফর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো অত্যন্ত উদ্বেগজনক। নিষিদ্ধ সংগঠনের প্রকাশ্যে মিছিল, রাজনৈতিক নেতাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড এবং পুলিশের কঠোর অবস্থান সব মিলিয়ে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে, পুলিশের এই হার্ডলাইন অবস্থান এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুততম সময়ে ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে নগরবাসী কিছুটা হলেও আশার আলো দেখতে পাচ্ছে।’

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) জনসংযোগ বিভাগের এডিসি মাহমুদা বেগম নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের অপতৎপরতা রোধে আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক আছি। সিএমপি কমিশনারের নির্দেশে নগরজুড়ে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রয়োজনে আরো কঠোর হবে পুলিশ। কোনোভাবেই অপরাধীদের ছাড় দেয়া হবে না।’


আরো সংবাদ



premium cement