খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষের বিষয়ে যা জানা যাচ্ছে
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২২:১১
বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি ও বাঙালি মধ্যে সঙ্ঘাত ও সহিংসতার রেশ ছড়িয়েছে পার্শ্ববর্তী রাঙামাটি জেলায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দুটো জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়িতে অন্তত তিনজন নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে, যাদের সবাই পাহাড়ি। সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র প্রতিষ্ঠান আইএসপিআর এক বিবৃতির মাধ্যমে জানিয়েছে, সেনাবাহিনীর সাথে ‘গোলাগুলিতে’ তিনজন নিহত হয়েছে।
সেনাবাহিনীর ভাষ্য হচ্ছে, তারা ‘আত্মরক্ষার্থে’ গুলি করেছে। এ পরিস্থিতির জন্য পাহাড়িদের সংগঠন ইউপিডিএফকে দায়ী করছে সেনাবাহিনী। তবে বিষয়টি নিয়ে নিয়ে ইউপিডিএফ-এর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
দুই পার্বত্য জেলায় সহিংসতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের দফতর থেকে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সৃষ্ট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সরকার।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো সে বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সকল বাহিনীকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে এবং পার্বত্য তিন জেলায় বসবাসকারী সকল জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
শুক্রবার দুপুর দেড়টায় ১৪৪ ধারা জারির সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে জানান রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন।
ঘটনার শুরু কিভাবে
বাইক চুরি করাকে কেন্দ্র করে একজন বাঙালিকে পিটিয়ে মারার ঘটনায় স্থানীয় বাঙালি শিক্ষার্থীরা দীঘিনালা সরকারি কলেজ থেকে মিছিল নিয়ে লারমা স্কয়ারে এলে তাদের বাধা দেয় পাহাড়িরা। এতে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।
দীঘিনালা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো: নুরুল হক জানান, খাগড়াছিতে একজন বাঙালি মৃত্যুর প্রতিবাদে দীঘিনালা কলেজের ছাত্ররা একটি মিছিল বের করে।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, মিছিলটি নতুন বাজার ঘুরে লারমা স্কয়ারে এলে মিছিল থেকে এক পাহাড়িকে ঢিল মারা হয়। এর থেকেই সহিংসতার সূত্রপাত হয় এবং এসময় বেশ কয়েকজন আহত হয় বলে জানান তিনি।
শুক্রবারও সেখানে থমথমে পরিস্থিতি রয়েছে। এরইমধ্যে দীঘিনালায় আগুন ও সহিংসতার প্রতিবাদে পাহাড়িদের পক্ষ থেকে শুক্রবার মিছিল বের করলে আবারো ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়।
তবে স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে, ঘটনার শুরু বুধবার থেকে। সেদিন ভোরে খাগড়াছড়ি শহরের নোয়াপাড়া এলাকায় মোহাম্মদ মামুন নামের এক ব্যক্তিকে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে মারধর করা হয় এবং এই ঘটনার ভিডিও ধারণ করা হয়। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে তার মৃত্যু হয়।
বাংলাদেশের তিনটি পার্বত্য জেলায় নিরাপত্তা ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে গত কয়েক দশক ধরে সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে।
খাগড়াছড়ির ঘটনা নিয়ে সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র প্রতিষ্ঠান আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর বা আইএসপিআর শুক্রবার একটি বিবৃতি দিয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বৃহস্পতিবার দীঘিনালা কলেজ থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি দীঘিনালার বোয়ালখালী বাজার অতিক্রম করার সময় ইউপিডিএফের (মূল) কতিপয় সন্ত্রাসী মিছিলের উপর হামলা করে ও ২০-৩০ রাউন্ড গুলি ছড়ে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিক্ষুব্ধ জনতা বোয়ালখালী বাজারের কয়েকটি দোকানে অগ্নি সংযোগ করে।’
বিষয়টি নিয়ে খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো: আরেফিন জুয়েল বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘দীঘিনালায় বাঙালি ছাত্ররা একটি মিছিল বের করে। তার আগে শহরে একটি চুরির ঘটনায় একজন চোর প্রথমে এক্সিডেন্ট করে, পরে গণপিটুনিতে মারা যায়। এটার প্রতিবাদেই মিছিল হয়।’
মিছিল থেকে বোয়ালখালী বাজারে ছাত্রদের সাথে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। একপর্যায়ে তা পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে রূপ নেয় বলে জানান তিনি। তবে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার কারণ হিসেবে দুই পক্ষই একে ওপরকে দোষারোপ করছে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে স্থানীয় বাঙালিদের প্রতিবাদ মিছিলটি লারমা স্কোয়ার এলাকায় গেলে পাহাড়িরা বাধা দেয় বলে মিছিলে উপস্থিত কয়েকজন অভিযোগ করেন। আবার পাহাড়িদের অনেকে পাল্টা অভিযোগ করেন যে মিছিল থেকে পাহাড়িদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে।
এই ঘটনায় পাহাড়িদের ১০০টির মতো দোকান আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় বলে জানান দীঘিনালা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নুরুল হক।
সেনাবাহিনীর সাথে ‘গোলাগুলিতে’ নিহত
বৃহস্পতিবারের সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন খাগড়াছড়ি জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক কর্মকর্তা রিপল বাপ্পী চাকমা।
হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, নিহত তিনজনই পাহাড়ি। তারা হলেন জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল (৩০)। এদের মধ্যে একজন দীঘিনালার এবং দু’জন খাগড়াছড়ি সদরের বাসিন্দা।
আইএসপিআর’র বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘খাগড়াছড়ি জোনের টহল দল রাত সাড়ে ১০টায় একজন মুমূর্ষ রোগীকে নিয়ে খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভর এলাকায় পৌঁছালে অবস্থানরত উত্তেজিত জনসাধারণ ইউপিডিএফের (মূল) নেতৃত্বে বাধা সৃষ্টি করে।’
বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, ‘এক সময় ইউপিডিএফের (মূল) সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীর টহল দলের সদস্যদের উপর গুলি করে এবং আত্মরক্ষার্থে সেনাবাহিনী পাল্টা গুলি চালায়। উক্ত গোলাগুলির ঘটনায় তিনজন নিহত এবং কয়েকজন আহত হয় বলে জানা যায়।’
বৃহস্পতিবার রাত ১০টা থেকে ১১টার দিকে সদর এলাকায় গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে বলে জানায় স্থানীয়রা।
আহতদের মধ্যে চারজনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যালে পাঠানো হয়েছে এবং বর্তমানে পাঁচজন ভর্তি আছেন বলে জানান খাগড়াছড়ি জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক কর্মকর্তা রিপল বাপ্পী চাকমা। তিনি বলেন, সন্ধ্যার পর থেকে একের পর এক আহত ব্যক্তিরা হাসতালে ভর্তি হন।
দীঘিনালায় সহিংসতায় সাতজন আহত হয়েছে বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে দু’জনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যালে পাঠানো হয়েছে, তাদের একজন পাহাড়ি এবং অন্যজন বাঙালি। তবে বৃহস্পতিবারের চেয়ে শুক্রবার পরিস্থিতি শান্ত আছে বলে জানান ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা হক। তিনি আরো বলেন, পুলিশ এবং সেনাবাহিনী গতকাল বিকেল থেকে এখন পর্যন্ত ওখানে উপস্থিত আছে এবং গতকাল রাত ৮টার মধ্যে আমরা সব কন্ট্রোল করে ফেলছি। লোকাল গাড়ি চলছে।’
তবে স্থানীয় সাংবাদিকরা বলছেন, আতঙ্ক ও গুজব মিলিয়ে সেখানকার পরিস্থিতি এখনো বেশ থমথমে।
মানবাধিকার কর্মী ত্রিরতন চাকমা জানান, পাহাড়ে এখনো উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজমান রয়েছে। মূল সড়কে অবস্থান নিতে দেখা গেছে সেনাবাহিনী ও বিজিবিকে।
খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে ১৪৪ ধারা জারি
খাগড়াছড়ির দীঘিনালা ও সদরে সহিংসতার জেরে নতুন কোনো নাশকতা ঠেকাতে জেলাটির পৌর শহরে ১৪৪ ধারা জারি করেছে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসক মো: সহিদুজ্জামান বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, যেকোনো ধরনের সহিংসতা রোধে এ ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন।
খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট সুজন চন্দ্র রায় স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘উদ্ভুত পরিস্থিতি ও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৮৯৮ সালের ১৪৪ ধারা মতে নিষেধেজ্ঞা আরোপ করা হলো। শুক্রবার দুপুর ২টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকবে।’
এদিকে দীঘিনালায় ঘটা ঘটনার প্রতিবাদে শুক্রবার দুপুরে রাঙামাটি স্টেডিয়াম এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে রাঙামাটির পাহাড়িরা। এতে অংশ নেন কয়েক হাজার মানুষ। পরে মিছিলটি বনরুপা বাজারে গেলে গুজব ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে সংঘর্ষে জড়ায় দুই পক্ষ। পরে একাধিক স্থানে সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়। পরে দুপুর থেকে পৌর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে গণবিজ্ঞপ্তি দেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘দীঘিনালার সাথে এটার যোগসূত্র আছে। ওটা নিয়েই এখানে সঙ্কট ছিল। একটা মব ক্রিয়েট হয় এবং মব ক্রিয়েটের প্রেক্ষিতে দোকানপাট ভাঙচুর হয়। যেহেতু এখানে দুই পক্ষ মুখোমুখি হয়েছিল তাই জান ও মালের ক্ষতি হওয়ার একটা আশঙ্কা তৈরি হয়। এ কারণেই ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।’
কোনো এক পক্ষ থেকে দোকানপাটে হামলা শুরু হলে দুই পক্ষ সংঘাতে জড়ায় বলে জানান তিনি।
সরকার কী বলছে
খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সৃষ্ট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সরকার। শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে এমনটাই জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, ‘১৮ সেপ্টেম্বর জনৈক ব্যক্তিকে গণপিটুনি ও পরবর্তী সময়ে তার মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে চলমান হামলা, আক্রমণ ও প্রাণহানির ঘটনায় সরকার গভীরভাবে দুঃখিত এবং ব্যথিত। সরকারের পক্ষ থেকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সকল বাহিনীকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে এবং পার্বত্য তিন জেলায় বসবাসকারী সকল জনগনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেখানে শান্তি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি নিশ্চিতকরণে সরকার বদ্ধপরিকর।’
এছাড়াও আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়া এবং ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত না হওয়ার জন্য সকলকে নির্দেশ দেয়া হয়। আইন নিজ হাতে তুলে নেয়া এবং যেকোনো সম্পত্তি ধ্বংস করা দণ্ডনীয় ও গর্হিত অপরাধ বলে এতে উল্লেখ করা হয়।
‘সহিংসতার সাথে সম্পর্কিত সকল ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত আর দায়ী ব্যক্তিদের বিচার নিশ্চিত করা হবে। এ লক্ষ্যে একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি খুব শিগগিরই গঠন করা হবে। আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’
শনিবার রাষ্ট্র উপদেষ্টার নেতৃত্বে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি পরিদর্শন করবেন বলেও বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
প্রতিনিধি দলে থাকবেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এবং প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়নবিষয়ক প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা