জামালপুরে তিনটি বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানই রুগ্ণ
- খাদেমুল বাবুল জামালপুর
- ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
জামালপুরের তিনটি বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানই লোকসানের বোঝা বহন করতে করতে এখন রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হয়েছে। অযত্নে বহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কিংবা খোয়া যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল্যবান যন্ত্রাংশ। এসব দেখার যেন কেউ নেই। পাটশিল্পের ‘দ্বিতীয় ড্যান্ডি’ হিসেবে খ্যাত জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলা। যমুনা নদী বিধৌত, ঝিনাই ও সুবর্ণখালী বেষ্টিত এই জনপথ দূরঅতীতে কামারদানী পরগনার অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাটশিল্পে সমৃদ্ধি পাওয়ায় এটিকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ড্যান্ডি বলা হতো।
এই সরিষাবাড়ীতেই ছিল একটি-দুইটি নয়-২২টি পাটের কুঠি। এই কুঠিগুলোতে ২২ হাজারেরও বেশি শ্রমিক কাজ করে তাদের ও পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করতেন। বাংলাদেশে পাট ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে নারায়ণগঞ্জকে বলা হতো প্রথম ড্যান্ডি এবং সরিষাবাড়ীকে বলা হতো দ্বিতীয় ড্যান্ডি।
জানা গেছে, কুনিরাম শেঠী নামে এক ব্যবসায়ী সর্বপ্রথম সরিষাবাড়িতে ‘কুনিরাম শেঠী অ্যান্ড কোং’ নামে একটি পাটক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করেন। ১৯০৫ সালের মধ্যে জামালপুর মহকুমায় একমাত্র সরিষাবাড়ীতেই ভারতীয় ব্যবসায়ীদের মালিকানায় প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘বিড়লা ব্রাদার্স লি:’, ‘লক্ষ্মী নারায়ণ মুদ্রা লি:’, ‘লুইচ ডেফার্স অ্যান্ড কোং’ এবং ‘বেঙ্গল জুট বেলিং’সহ ২২টির অধিক জুট প্রেস হাউজ।
যমুনা নদীপথে কলকাতা ও ইউরোপকেন্দ্রিক ব্যবসা প্রসারের কারণে সরিষাবাড়ী এলাকাটি বাণিজ্যিক রফতানিকেন্দ্র হিসেবে উপমহাদেশের দেশগুলোয় বেশ পরিচিতি হয়ে উঠছিল।
ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে সদর থানার ইটাইল নদীবন্দর থেকে এক সময় পাট নিয়ে বড় বড় নৌকা চলে যেত কলকাতা, মাদ্রাজ ও হুগলিতে। সরিষাবাড়ীতে উৎপাদিত পাট নেয়ার জন্য হাজার হাজার বজরা নৌকা পাল তুলে যমুনা নদীতে ভেসে চলত।
এ ছাড়া কৃষিনির্ভর এই জনপদে ১৯৫৮ সালে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করা হয় পাকজিল সুগার মিলস, যা ’৭১এর স্বাধীনতার পর জিলবাংলা সুগার মিলস লি: নামে নামকরণ করা হয়। লোকসানের বোঝা বইতে বইতে এই শিল্পটি এখন রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হয়েছে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে এক সময়ের লাভজনক এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৬৭ সালে সরিষাবাড়ীতে স্থাপিত হয় ‘আলহাজ জুট মিল লি:’ নামের আরেকটি বৃহৎ পাট শিল্প। যেটি এখন বছরের পর বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। খোয়া যাচ্ছে এই শিল্পের বহু মূল্যবান যন্ত্রপাতি ও সম্পদ। শিল্পায়নের জন্য অতীত ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় সরিষাবাড়ী তারাকান্দিতে স্থাপিত হয়েছে এশিয়ার অন্যতম বৃহৎশিল্প ইউরিয়া উৎপাদনকারী কারখানা ‘যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লি:’। যেটিকে কেন্দ্র করে সরিষাবাড়ীর তারাকান্দি এলাকার যমুনার চরাঞ্চল যেন শহরের পরিণত হয়। কিন্তু সেটিও এখন প্রায় রুগ্ণয় জর্জরিত। ১৩ মাস বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি চালু হয়েছে শিল্পটি। কিন্তু এর উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ শো মেট্রিক টন থেকে কমতে কমতে এখন নেমে এসেছে ১২ শো মেট্রিক টনে।
সোনালী আঁশের দেশ বাংলাদেশ। বৃহত্তর ময়নসিংহ জেলার জামালপুরে প্রচুর পাট উৎপন্ন হয়। চরাঞ্চলের অপেক্ষাকৃত নিচু জমিতে পাটের ফলন হয় ভালো। এখানকার পাট খুবই উন্নত জাতের হয়ে থাকে।
জামালপুরের বৃহৎ পাট শিল্প বর্তমানে বন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে আলহাজ জুট মিল লিমিটেড। স্থানীদের অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে এই বৃহৎ পাট শিল্পকে। পতিত আওয়ামী সরকারের আমলে বন্ধ থাকা এই জুট মিলটি চালু করার কোনো উদ্যোগ না নিয়ে উল্টো এই মিল অঞ্চলের বড় বড় গাছ কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে মাত্র এক কোটি ৩২ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। যদিও ওই গাছগুলোর মূল্য ১০ কোটি টাকারও বেশি বলে ধারণা করছেন স্থানীয়রা। মিলের মূল্যবান পিতলের যন্ত্রাংশসহ আরো অনেক যন্ত্রাংশ প্রতিনিয়তই চুরি হয়ে যাচ্ছে।
সরিষাবাড়ী মাইজবাড়ি-দিয়ারকৃষ্ণাই এলাকায় ৩৯ একর জমির ওপর ১৯৬৭ সালে স্থাপিত শতভাগ রফতানিমুখী এই জুট মিলে পাটের বস্তা, ব্যাগ, কার্পেট ও কার্পেটের সুতা তৈরি করা হতো। প্রতিদিন প্রায় ১৫ টন পণ্য উৎপাদনে সক্ষম এই মিলটিতে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করতেন।
জানা যায়, এই জুট মিলে ছিল ৩৯টি স্পিনিং ফ্রেম, ১৫০টি হেসিয়ান তাঁত ও ১০০টি সেকিং। দুই লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন পাটের চাহিদা সম্পন্ন জামালপুরের ঐতিহাসিক পাট শিল্প আলহাজ জুট মিলস লিমিটেড আজ অচল হয়ে পড়ে আছে। এ শিল্পটিকে যেন দেখার কেউ নেই।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা