২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

সুন্দরবনে ফের সক্রিয় বনদস্যুরা বনজীবীদের মধ্যে আতঙ্ক

প্রায়ই ঘটছে জেলে-বাওয়ালিদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়
-


সুন্দরবনঘেঁষা খুলনার কয়রা উপজেলায় দুই লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। এলাকায় তেমন কোনো কর্মসংস্থান না থাকায় অধিকাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। উপজেলার অনেকে মাছ-কাঁকড়া ধরা, মধু, গোলপাতা আহরণসহ সুন্দরবনভিত্তিক নানা পেশার সাথে জড়িত। অর্ধযুগেরও বেশি সময় সুন্দরবনে বনদস্যুদের উৎপাত কম ছিল; কিন্তু সম্প্রতি সুন্দরবনে আবারো বনদস্যুদের উৎপাত বেড়েছে। প্রায়ই শোনা যাচ্ছে জেলে-বাওয়ালিদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের কথা ।

বনজীবী সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের নলবুনিয়া, খাঁশিটানা, বজবজিয়া, মোল্লাখালী, মার্কি, নিশিনখালী, খড়কুড়িয়া, মান্দারবাড়িয়া, আড়–য়া শিবসা, আদাঁচাই, পাতকোষ্ট, গেওয়াখালী, ভোমরখালী, আন্ধারমানিক, নীলকমল, কাগাদোবেকী, হংসরাজসহ খুলনা রেঞ্জের অধিকাংশ জায়গায় জলদস্যুদের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। গত চার/পাঁচ মাসে পশ্চিম সুন্দরবনে অন্তত ১০টিরও বেশি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ৮ নভেম্বর কয়রা উপজেলার দুই জেলে আতাহার হোসেন ও রফিকুল ইসলামকে অপহরণ করা হয়েছিল। ডাকাতদল নিজেদের দয়াল বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে তাদের পণবন্দী করে পরিবারের কাছে কাছে চার লাখ টাকা মুক্তিপণ নিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়।

২০১৮ সালে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত অঞ্চল বলে ঘোষণা করেছিল সরকার। এই অঞ্চলের ডাকাতদলকে সমাজের মূল স্রোতে ফেরানোর জন্য বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার। এরপর অনেকেই আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন।
আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ৩২টি দলের ৩২৮ জন আত্মসমর্পণ করেন। তারা ৪৬২টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ২২ হাজার ২৪ রাউন্ড গোলাবারুদ জমা দেন। আত্মসমর্পণের পর অনেকে সরকারি পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় আর্থিক সহায়তাও পেয়েছেন। তবে গত কয়েক বছর ধরে নিয়মিত নজরদারির অভাবে অনেকে পুনরায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ফিরে গেছেন। ফলে জলে, বাওয়ালী ও মৌয়ালসহ বনজীবীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে সুন্দরবন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, আসাবুর বাহিনী, শরীফ বাহিনী, আবদুল্লøাহ বাহিনী, মঞ্জুর বাহিনী, আলিফ ওরফে দয়াল বাহিনী, সাগর বাহিনী, আলম ওরফে পাটওয়ারী বাহিনী ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এসব বাহিনীর সদস্যদের পশ্চিম সুন্দরবন, খুলনার কয়রা ও দাকোপ উপজেলা এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে আনাগোনা করতে দেখা যাচ্ছে ।

বনসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের ধারণা, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় জেল থেকে পালিয়ে যাওয়া কিছু আসামি এবং আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের সদস্যরা এ কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে। কয়েকদিন আগে আসাবুর বাহিনীর প্রধান আসাবুরসহ তার সহযোগী আটক হলে এ ধারণা দৃঢ় হয়।
গত ১৬ ডিসেম্বর কয়রা উপজেলার দশহালিয়া গ্রামের শের আলী মোল্যার ছেলে ইমদাদুল হক (৩৩), সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার হরিনগর গ্রামের নাজির সরদারের ছেলে রেজাউল ইসলাম (৩৮) ও গোলাম মোস্তফার ছেলে সুজন গাজীকে (২৭) সুন্দরবনের ফিরিঙ্গি নদীর মোল্যাখালী খাল থেকে একটি বনদস্যুদল অপহরণ করে। পরবর্তী সময়ে তাদের পরিবারের সাথে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে মুক্তিপণের পরিমাণ জানাবে বলেও জানায় তারা। তবে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা (অপহরিত জেলেরা) মুক্তি পাননি।

কয়রা গ্রামের জেলে শাহাদাৎ হোসেন (ছদ্মনাম) বলেন, আমরা নৌকা সাজিয়ে তিনজনের একটি দল নিয়ে বৈধ প্রক্রিয়ায় সুন্দরবনে মাছ ধরার জন্য যাই। তখন শিবশা এলাকায় আমরা ডাকাতদলের আক্রমণের শিকার হই। তারা আমাদের নৌকা থেকে একজন জেলেকে উঠিয়ে নেয়। পরে ২০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। আমরা বাড়িতে ফিরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের (বিকাশ) মাধ্যমে মুক্তিপণের ২০ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনি। পরে আর সুন্দরবনে মাছ ধরতে যাইনি। এখন পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে দিন পার করছি।

১৫ দিন আগে কয়রার দাসের (২২) ও খায়রুল ইসলাম (৪০) নামের দুই জেলেকে নিশিনখালী এলাকা থেকে অপহরণ করে সাগর বাহিনী নামের বনদস্যুদল। অপহরণের পর তাদের কাছ থেকে বিকাশের মাধ্যমে ৯০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায় করে তাদের ছেড়ে দেয়। বেশ কয়েকজন জেলে-বাওয়ালি বলেন, সুন্দরবনে আগের মতো বেশ কয়েকটি বনদস্যু সক্রিয় হয়েছে। এখন আর আগের মতো মাছ-কাঁকড়া আহরণ করা যায় না, কারণ সুন্দরবনে গেলে তাদের টাকা দিতে হবে। টাকা দিতে না পারলে দীর্ঘ দিন আটকিয়ে রেখে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করে। এই ভয়ে সুন্দরবনে যাচ্ছি না। তবে এলাকায় তেমন কোনো কর্মসংস্থান না থাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে খুব কষ্টে দিন পার করছি।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে বলেন, আমাদের কাছে বনদস্যুদের বিষয়ে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু তথ্য আসছে। আমরা চেষ্টা করছি অন্যান্য আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে সাথে নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে, যাতে বনদস্যুরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে।

 


আরো সংবাদ



premium cement