৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১, ২৭ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

মুখ খুলছেন এলাকাবাসী বেরিয়ে আসছে নানা তথ্য

রিমান্ডে গৌরনদীর ত্রাস হারিছ
বরিশাল আদালতে হারিছুর রহমান হারিছ : নয়া দিগন্ত -


দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা একাধিক মামলার আসামি বরিশালের গৌরনদী পৌরসভার সাবেক মেয়র হারিছুর রহমানের গ্রেফতার ও রিমান্ডের খবরে আনন্দ প্রকাশ করেছে এলাকাবাসী। গত মঙ্গলবার রাজধানীর রামপুরা থেকে তাকে গ্রেফতারের পর বরিশাল চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক সারাহ্ ফারজানা তার পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। হারিছের গ্রেফতারের খবরে গৌরনদীজুড়ে দিনভর মিষ্টি বিতরণ এবং জুতা ও ঝাড়ু মিছিল করেছে বিক্ষুব্ধ জনতা। হারিছের ক্ষমতার থাবায় এত দিন ভয়ে চুপ থাকলেও গ্রেফতারের পর তার (হারিছ) অপকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে জনগণ।
উপজেলা ঘুরে জানা যায়, বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া) আসনের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর আশীর্বাদপুষ্ট হারিছ একতরফা ভোটে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন টানা তিনবার। শুধু গৌরনদী পৌরসভা নয়; হারিছের রাজনীতির থাবা ছিল পুরো গৌরনদী উপজেলাজুড়ে। এ ছাড়া ভিন্নমতাদর্শী নেতাকর্মীদের হত্যাচেষ্টা, টর্চার সেলে নিয়ে নিজ হাতে অমানসিক নির্যাতন, বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের জোরপূর্বক নিজ দলে যোগদান করানো ও সাংবাদিক সংগঠনে প্রভাব বিস্তারসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন হারিছ। এমনকি বিতর্কিত এই হারিছের হাত থেকে রেহাই পায়নি প্রকৃত ত্যাগী ও নির্যাতিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও।

গৌরনদী উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক রুবেল গোমস্তা জানান, সাড়ে চার দশক ধরে বরিশাল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অভিভাবক বনে যাওয়া আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর ছত্রছায়ায় গৌরনদীতে একটি সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল হারিছ। সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষক, নৈশপ্রহরী নিয়োগ থেকে শুরু করে বাজার কমিটি, মসজিদ-মন্দির কমিটিও ছিল তার নিয়ন্ত্রণে এমনকি টিসিবি পণ্য থেকে শুরু করে নানা অনুদানেও প্রভাব বিস্তার করতেন তিনি। ক্ষমতায় থাকাকালীন সব কাজ পেয়েছেন তার পছন্দের ঠিকাদাররা। কাউন্সিলরদের মধ্যেও করেছেন বৈষম্য। আওয়ামী লীগের ১৭ বছরে পৌরসভার কাক্সিক্ষত সেবা পায়নি সাধারণ জনগণ বরং পৌরসভায় গেলে দুর্ব্যবহারের কারণে জন্মনিবন্ধন থেকে যেকোনো ধরনের প্রত্যয়নে স্বাক্ষর আনতে যেতে ভয় পেতেন মানুষ। তার দুর্নীতি ছিল মাত্রাহীন ও লাগামহীন।

গৌরনদী উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব শরীফ জহির সাজ্জাদ হান্নান জানান, ২০০৬ সালে বড় ভাই হাবিবুর রহমানের বিশেষ সুপারিশে গৌরনদী উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক হিসেবে পদ পায় হারিছ। এর পর ২০১১ সালে প্রথম মেয়র এবং ২০১২ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়ে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। একাধারে পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় গৌরনদীতে হারিছ বাহিনী নামে একটি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম শুরু করে হারিছ। ফলে টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি, বাড়ি, ডিস লাইন দখল, নদীর বালু উত্তোলন, চাঁদাবাজি ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে নির্যাতনসহ নানাবিধ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও অপকর্মের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থবিত্তের মালিক বনে গেছেন হারিছ। এমনকি হারিছুর রহমানের আপন ভাই হাবিবুর রহমান কয়েক মাস আগে গণমাধ্যমে একটি সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করে বলেছিলেন হারিছের এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় হারিছ তার ভাইদেরকেও বাড়ি ছাড়া করেছেন। গৌরনদীর দানব হারিছ তাদের বাড়িটিকে টর্চার সেল বানিয়ে সেখানে রাতের আঁধারে মানুষদের ধরে এনে অত্যাচার-নির্যাতন করেছেন বলেও জানান তার আপন ভাই হাবিব। হারিছের এই অবৈধ সম্পদের সুষ্ঠু তদন্ত পূর্বক আইনের আওতায় আনার জন্য দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এই নেতা।

গৌরনদী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক সৈয়দ সরোয়ার আলম বিপ্লব জানান, গৌরনদীর সব দফতর ও কাজের ধরন অনুযায়ী হাসানাত আব্দুল্লাহকে ১০% থেকে ১২% টাকা দিতে হতো। আর এ সব কাজ ও টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন গৌরনদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র হারিছুর রহমান। এ ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি (৪০ দিন) প্রকল্পের শ্রমিক সাপ্লাই দিতেন হারিছ। গৌরনদী থেকে প্রতিদিন ৩০০ লেবারের প্রতিদিন ৪০০ টাকা করে ৪০ দিনের পারিশ্রমিক ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়ে সেই টাকা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর কাছে পৌঁছে দিতেন হারিছ। আর এসব কাজে হারিছকে সহায়তা করতেন উপজেলার কতিপয় ইউপি চেয়ারম্যান। তাই হারিছসহ একই ব্যক্তিকে প্রতিবার নমিনেশন দিয়ে পুরস্কৃত করতেন হাসানাত আবদুল্লাহ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরুর দিকেই আত্মগোপনে চলে গেছেন বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ও বরিশাল-১ আসনের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং তার ছেলে স্ব-ঘোষিত যুবরাজ আশিক আবদুল্লাহ। এ ছাড়া ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর আত্মগোপনে রয়েছেন, গৌরনদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এইচ এম জয়নাল আবেদীন, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান শামীম, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি আনিচ ফকির, উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি জুবায়ের ইসলাম সান্টু, সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমান, কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি সুমন মাহমুদ, হারিছের ব্যক্তিগত সহকারী কালা আলামিন, হারিছ বাহিনীর প্রধান ক্যাডার শরীফ নাহিয়ান ইসলাম রাতুল, মিঠু বেপারীসহ প্রায় অর্ধশত উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাকর্মীরা।

 


আরো সংবাদ



premium cement