২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বায়দূষণে শীর্ষে কেন ঢাকা?

-

বায়ুদূষণের শিকার শহরগুলোর তালিকায় ঘুরেফিরে প্রথম স্থান দখল করছে রাজধানী ঢাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত চার কারণে এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন রাজধানীবাসী। প্রথমত, পুরনো যানবাহনের আধিক্য। দ্বিতীয়ত, অপরিকল্পিতভাবে শহরের যেখানে সেখানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও উন্নয়নকাজ। তৃতীয়ত, শহরের আশপাশের ইটভাটা ও শিল্প-কলকারখানার দূষণ। চতুর্থত, শহরের ভেতরে যে ময়লা আবর্জনা জমে সেগুলো পোড়ানোর ধোঁয়া। সরকার কঠোর না হওয়ায় এ পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটছে না বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ায় রাস্তাঘাট ও কলকারখানায় মানুষের ব্যস্ততা কমে যাওয়ায় বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের বায়ুদূষণ কমায় কার্বন নিঃসরণ কমেছে ব্যাপক হারে। বিশেষ করে বিশ্বের অন্যতম দূষিত বায়ুর দেশ ও কার্বন নিঃসরণকারী চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বায়ুর মানে ব্যতিক্রমী উন্নতি ঘটেছে। অবাক করার বিষয় হলো, ঢাকার বায়ুর মানে দেখা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র। এখানে বায়ুদূষণ আরো বেড়েছে। বিশ্বের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়াল ও যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশবিষয়ক সংস্থা নাসার পর্যবেক্ষণে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এয়ার ভিজ্যুয়ালের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিশ্বের শীর্ষ দূষিত বায়ুর শহরের তালিকা থেকে এই দেশগুলোর বেশির ভাগ শহরের নাম সরে গেছে। বিশেষ করে চীন ও ভারতের শহরগুলোর পরিবেশগত পরিস্থিতির উন্নতি লক্ষণীয়। এর মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রম হচ্ছে বাংলাদেশ। গত এক দিনের ব্যবধানে ঢাকার বায়ুর মান আরো খারাপ হয়েছে। গত শনিবার সকাল ৮টা থেকে ঢাকা শহর বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে।
দেড় কোটিরও বেশি মানুষের আবাসস্থল ঢাকা। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থানও প্রথম দিকেই। পরিবেশবিদরা বলছেন, অন্য দেশগুলো তাদের বড় বড় শহরগুলোর বায়ুদূষণ রোধে যেখানে পদক্ষেপ নিয়েই চলেছে, সেখানে ঢাকা ব্যর্থ। দূষণের সব থেকে বড় উৎস ঢাকার বর্জ্য, আর এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন করতে পারেনি দুই সিটি করপোরেশন। আবার শহরের মধ্যে উন্নয়নকাজের ফলে সৃষ্ট দূষণ নিয়ন্ত্রণও ঠিকঠাক মতো করে উঠতে পারছে না দুই সিটি করপোরেশনের কোনোটিই।
বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস হচ্ছে ধুলোবালু। এর মধ্য দিয়ে করোনাভাইরাসের জীবাণু সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে ধূলিকণা মুখে গেলে মানুষ যত্রতত্র থুথুু ও কফ ফেলে। তা ধুলার সাথে মিশে হাতসহ নানা মাধ্যম দিয়ে মানুষের শরীরে ঢুকতে পারে। এতে ওই ভাইরাস মানুষের শরীরে ঢুকতে পারে।
এ ব্যাপারে বায়ুদূষণ গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুস সালাম জানান, সাধারণ ধুলোবালুর সাথে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কথা নয়। তবে করোনায় আক্রান্ত রোগী যদি বাইরে এসে থুথুু বা কফ কোনো ধুলার মধ্যে ফেলে, আর ওই ধুলা কারো হাত লাগে এবং ওই হাত সে যদি মুখে দেয়, এভাবে ধুলার মাধ্যমে জীবাণু মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। ফলে সরকারের উচিত হলে দ্রুত রাজধানীর ধুলাদূষণ রোধে জরুরি পদক্ষেপ নেয়া। ড. আবদুস সালাম আরো জানিয়েছেন, অন্য দেশের চেয়ে আমাদের দেশে দূষণ বেশি। কারণ আমাদের অ্যাক্টিভিটি বেশি। কনস্ট্রাকশন বেশি, আর নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থাও নেই। দিল্লি বা কাঠমান্ডুতেও দূষণ হচ্ছে। তারাও মাঝে মধ্যে দূষণের শীর্ষে চলে আসে। কিন্তু ঢাকার মতো ধারাবাহিকভাবে প্রথম হয়নি। এ ছাড়া এসব দেশ বায়ুদূষণ রোধে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমরা সে তুলনায় কিছুই করছি না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধুলোবালুর মধ্যে মূলত ছয় ধরনের পদার্থ ও গ্যাসের কারণে ঢাকায় দূষণের মাত্রা বেড়ে গেছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা অর্থাৎ পিএম ২.৫ এর কারণেই ঢাকায় দূষণ অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। ক্ষতিকর ছয় ধরনের পদার্থের মধ্যে প্রথমেই আছে পিএম (পার্টিকুলেটেড ম্যাটার) ২.৫ অথবা ২ দশমিক ৫ মাইক্রো গ্রাম সাইজের ক্ষুদ্র কণা। এরপর পিএম-১০ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এই ধূলিকণার আকার বোঝাতে হলে উদাহরণ হিসেবে বলতে হবে, মাথার চুলের ডায়ামিটারের (ব্যস) ৬ ভাগের এক ভাগ হচ্ছে ২ দশমিক ৫। এটি এত ক্ষুদ্র যা খালি চোখে দেখা যায় না। বাকি চারটির মধ্যে আছে সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন, কার্বন মনোক্সাইড এবং সিসা। এই ছয় পদার্থ ও গ্যাসের ভগ্নাংশ গড় করেই বায়ুর সূচক নির্ধারণ করা হয়। সেই সূচককে বলা হয় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স।
বায়ুদূষণের সূচকে ঢাকার সূচক ৫০ হলে তা দূষণের পর্যায়ে পড়বে না। কিন্তু গত জানুয়ারি ও ফেব্র“য়ারি মাসের বেশ কয়েক দিন বারবার সূচকের মাত্রা ৩০০ তে গিয়ে ঠেকেছে। যখন ঢাকা প্রথম স্থানে থাকে তখন দেখা যায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা শহরগুলোর চেয়ে ঢাকার সূচকের মান প্রায় ১০০ বেশি; যা খুবই উদ্বেগজনক। ১০১ থেকে ১৫০ সূচক হলে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। ১৫০-২০০ সূচক হলে সেটি অস্বাস্থ্যকর। আর সূচক যদি ২০০ থেকে ৩০০ হয় তাহলে সেটি খুবই অস্বাস্থ্যকর। ৩০০ ওপরে হলে সেটিকে দুর্যোগপূর্ণ বলা হয়।
বায়ুদূষণ বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, গড়ে মাস হিসেবে দূষণমাত্রা বেশি নয়। তবে হলে অন্য দেশগুলোর চেয়ে মাসের মধ্যে অনেক দিনই সূচকের শীর্ষে ছিল ঢাকা। এই কারণে ঢাকাকে শীর্ষ দূষণের শহর বলা হচ্ছে। অন্য দেশের তুলনায় কেন ঢাকা বারবার শীর্ষে চলে আসছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একেক দেশের দূষণের কারণ সাধারণত ভিন্ন হয়। যেমনÑ নেপালে বায়ুদূষণের মূল কারণ হচ্ছে ইটভাটা ও পুরনো যানবাহন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ধূলিঝড়। অন্য দেশগুলোতে যেখানে দূষণের কারণ একটি বা দু’টি। সেখানে আমাদের দূষণের কারণ অনেক। মূলত চার কারণে দূষণ হয়। ঢাকা শহরের দূষণের জন্য প্রধানত দায়ী পুরনো যানবাহন, এরপর রাস্তার খোঁড়াখুঁড়ি এবং কনস্ট্রাকশনের জন্য রাস্তার পাশে রাখা ধুলোবালু, এরপর ইটের ভাটা, শিল্প-কারখানার দূষিত বাতাস, আবর্জনা পোড়ানো। এতগুলো কারণ থাকায় যেকোনো একটি নিয়ে কাজ করলে হবে না। আমাদের অনেকগুলো বিষয়কে সামনে রেখে পরিকল্পনা করতে হবে। দ্রুতগতিতে কাজ হবে এমন কিছু পরিকল্পনা করা দরকার।’
ড. সালামের মতে, বায়ুদূষণের তালিকার শীর্ষ থেকে নামতে হলে সরকারি সংস্থাগুলোকে তাদের কাজের পরিধি বড় করতে হবে, দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) সম্প্রতি ঢাকার ধুলাদূষণ নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। এতে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের গাছপালায় প্রতিদিন ৪৩৬ মেট্রিক টন ধূলিকণা জমে। সেই হিসাবে মাসে ১৩ হাজার মেট্রিক টন ধুলা জমার হিসাব পেয়েছেন তারা। এই জমে থাকা ধুলা দিনের বেলা বাতাসের সাথে মিশে যেমন দূষণ বাড়ায়, তেমনি রাতে গাড়ির অতিরিক্ত গতির সাথে বাতাসে উড়তে থাকে। আর তাই দিনের বেলা থেকে রাতের বেলা বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। ঢাকার চারটি পার্ক ও উদ্যানে বিভিন্ন প্রজাতির ৭৭টি গাছের পাতা সংগ্রহের পর ফেব্র“য়ারি মাসে এই গবেষণা পরিচালনা করে।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ধুলার মাধ্যমে ঢাকায় যাতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে না পড়তে পারে, সেই ব্যবস্থা দ্রুত নিতে হবে। কারণ গত পাঁচ দিন ধরে ঢাকার বায়ুদূষণ ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলেছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশের প্রধান শহরগুলোর বায়ুদূষণের সূচক ২০০-এর নিচে চলে গেছে। আর ঢাকায় আজ সকাল থেকে বায়ুর মানের সূচক ৩০০-এর কাছাকাছি চলে গেছে। ঢাকায় যানবাহন কমলেও এখনো ইটভাটাগুলো চালু আছে, বড় অবকাঠামো ও অন্যান্য নির্মাণকাজও চলছে। এয়ার ভিজ্যুয়ালের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ঢাকার বায়ুর মান গত শনিবার বেলা পৌনে ১১টায় খুবই অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় ছিল। ঢাকার পরেই ছিল যথাক্রমে ভারতের দিল্লি, থাইল্যান্ডের চিয়াংমাই, নেপালের কাঠমান্ডু ও সার্বিয়ার বেলগ্রেড। গত এক মাসের মধ্যে দূষিত শহরের শীর্ষ ১০-এর তালিকায় শুধু চীনের চেংদু শহরের নাম রয়েছে, তাও ৯ নম্বরে।
পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উৎস হচ্ছে ইটভাটা। এরপরই রয়েছে নির্মাণকাজের ধুলা, পরিবহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া।
যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ারের গত ২৫ ফেব্র“য়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণের দিক থেকে গত বছরের মতো এবারো বিশ্বের শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। রাজধানী ঢাকাও বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে গতবারের মতোই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement