রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলার অভাব
- সুমনা শারমিন
- ১২ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০
নির্দিষ্ট স্টপেজে থামছে না রাজধানীর গণপরিবহনগুলো। যাত্রী দেখলেই যত্রতত্র থেমে যায় বাস। যাত্রীরাও রাস্তার মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে ওঠানামা করছেন। কাছেই পদচারী সেতু। কিন্তু সেদিকে ভ্রƒক্ষেপ নেই পথচারীদের। ঝুঁকি নিয়ে সড়ক বিভাজকের কাঁটাতারের বেড়া টপকে সড়ক পার হচ্ছেন। ধেয়ে আসা চলন্ত বাসের সামনে হাত উঁচিয়ে বিপজ্জনকভাবে দৌড়ে রাস্তা পার হচ্ছেন পথচারীরা। অন্য দিকে তর সয় না মোটরসাইকেল চালকদের। ফাঁকফোকর গলিয়ে সামনে এগোনোর দুরন্ত চেষ্টা। রাজধানীর সড়কে এসব দৃশ্য নিত্যদিনের।
বড় দুর্ঘটনার পরে রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও কয়েক দিনের মধ্যেই তা হারিয়ে যায়। কখনো কখনো কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অসহযোগিতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদাসীনতার কারণে তা বাস্তবায়ন হয় না। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আধুনিক পরিবহনব্যবস্থার কথা বারবার বলা হলেও বাস্তবে তা দৃশ্যমান হচ্ছে না।
ঢাকার সড়ক ও পরিবহন খাতে এক দশকে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি প্রকল্প নিয়েছে সরকার। এর পরও রাজধানী শহরে যানবাহন চলছে হাতের ইশারায়, সঙ্কেতবাতি প্রায় অকার্যকর। নাজুক গণপরিবহনব্যবস্থায় নগরবাসীর দুর্ভোগের অন্ত নেই।
ঢাকা মানেই যানজট, সড়কে মৃত্যু, দূষণ আর বেহাল সড়কের শহর। এই পরিস্থিতির জন্য পরিবহন বিশেষজ্ঞরা সরকারের অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা ও নীতিকে দায়ী করছেন। সরকার ২০০৫ সালে ঢাকার জন্য ২০ বছরের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) তৈরি করেছিল, যা ২০২৪ সালে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু পরিকল্পনা অনুসারে অনেক কাজই হয়নি। এরপর ২০১৫ সালে সংশোধিত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি) তৈরি করা হয়, যার মেয়াদ ২০৩৫ সাল পর্যন্ত। ঢাকায় যত প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে ও হবে, এর সবই এই পরিকল্পনার আওতায় হওয়ার কথা। আরএসটিপিতে নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল যানবাহন পরিচালনা নিশ্চিত করা এবং বাসসেবার উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তা বাদ দিয়ে সরকার বিপুল ব্যয়ে উড়াল সড়কের মতো বড় প্রকল্পকে গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু নগরবাসীর দুর্ভোগ তো কমেইনি, বরং কয়েক বছর ধরে বৈশ্বিক সূচকে বসবাসের অনুপযোগী শহরের তালিকায় ঢাকা প্রথম দিকেই থাকছে। গত বছর লন্ডনভিত্তিক ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের জরিপ অনুযায়ী বিশ্বে বসবাসের অনুপযোগী শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়।
সড়কে বাসের রেষারেষি চলছেই। দুই বাসের মাঝে চাপা পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন পথচারী। মাত্র একজন চালক ও একজন সহকারীর কাছে বাসভর্তি যাত্রীরা জিম্মি। মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালাচ্ছেন চালক। যাত্রীরা নিষেধ করলেও সেদিকে কর্ণপাত করেন না। রাজধানীর সড়কে মৃত্যুর অন্যতম কারণ একাধিক কোম্পানির বাসের বেপরোয়া চলাচল। এ বিষয়টি সরকারিভাবে আরএসটিপি প্রণয়নের সময় জাপানের আন্তর্জাতিক সংস্থা জাইকার গবেষণাতেও উঠে এসেছে।
২০১৫ সালে ঢাকার পরিবহনব্যবস্থা নিয়ে সর্বশেষ ওই গবেষণা বলছে, ঢাকায় দিনে দুই কোটি ৯০ লাখ যাতায়াত (ট্রিপ) হয়। একজন মানুষ কোনো যানে উঠে নির্দিষ্ট গন্তব্যে নেমে গেলে একটা ট্রিপ হিসেবে গণ্য করা হয়। মোট ট্রিপের সর্বোচ্চ ৪৭ শতাংশ হয় বাস-মিনিবাসে।
আরএসটিপিতে বাসের বিশৃঙ্খলার পেছনে মালিকানার ধরন, পরিচালনা ও সড়কব্যবস্থায় ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হয়। এর জন্য বিক্ষিপ্তভাবে বাসের অনুমোদন না দিয়ে পরিকল্পিত ব্যবস্থা চালুর কথা বলা হয়েছিল। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মরহুম আনিসুল হক এই ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকার বাস ছয়টি কোম্পানির অধীনে ছয়টি পথে চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। প্রতিটি কোম্পানির বাসের রঙ থাকবে আলাদা। বিদ্যমান পরিবহন মালিকেরা এই কোম্পানিগুলোতে অন্তর্ভুক্ত হবেন। বিনিয়োগের হার অনুসারে মালিকেরা লভ্যাংশ পাবেন। এটা করা হলে পথে বাসের চালকদের মধ্যে পাল্লাপাল্লি করার প্রয়োজন হবে না। কিন্তু ২০১৭ সালে আনিসুল হকের মৃত্যুর পর প্রক্রিয়াটি থেমে যায়।
বিশেষজ্ঞ ও পরিবহন সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এর আগে সরকারের তরফ থেকে ‘সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থার পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে’ উদ্যোগ নেয়া হলেও এখন পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। পরিবহনব্যবস্থার উন্নতি ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে ফুটপাথ দখলমুক্ত করার পাশাপাশি ফিটনেস ও রুট পারমিটবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে। নির্দিষ্ট বাসস্ট্যান্ড থেকে যাত্রী ওঠানামা করানো ও রিকশা চলাচল নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। সড়কের পূর্ণ ব্যবহারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন ও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার আওতায় নেয়ার ওপরও তারা গুরুত্ব আরোপ করেন। সরকারের নেয়া মেগা প্রকল্পগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে নগরবাসী। সবার বিশ্বাস, এগুলোর বাস্তবায়ন হলে আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা ও সড়কে শৃঙ্খলার সুফল মিলবে।
যানজট কমাতে রাজধানীতে সড়কে শৃঙ্খলা মেনে চলার বিষয়টি বার বার উচ্চারিত হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে সড়কে শৃঙ্খলার বড়ই অভাব। গাড়ি লেন ধরে চলে না, একই রাস্তায় ভিন্ন ধরন ও গতির গাড়ি, ফুটপাথগুলো দখলে, ফুটওভার ব্রিজ থাকলেও তার বেশির ভাগই দখলে, বেশির ভাগ আবার ব্যবহারের অনুপযোগী। এ ছাড়া নাগরিক সচেতনতারও অভাব রয়েছে। এ অবস্থায় শুধু জরিমানা করে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাবে না। জনসচেতনতার পাশাপাশি রাস্তায় সার্বিকভাবে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
ঢাকা মহানগরের সড়কগুলো আর যাই হোক, বিপুল পরিমাণ মানুষ আর যান বাহনের চাপ সামলানোর মতো নয় বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। সরু সেই সব রাস্তার অবস্থা আরো করুণ হয়ে যায়, যখন যত্রতত্র পার্কিংয়ে এই রাস্তা আরো সরু হয়ে যায়।
ঢাকার রাস্তায় আরেক যন্ত্রণা সৃষ্টি করে খোদ পথচারীরাই। নির্ধারিত জায়গার পরিবর্তে যেখানে সেখানে রাস্তা পার হয়ে যান তাঁরা। রাজধানীতে পথচারীদের আইন না মানার প্রবণতাও এখানকার দুর্ঘটনার একটা কারণ। সব কিছু মিলিয়ে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে বলে মনে করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।