আগুনে সর্বস্ব হারালেন অসহায় মানুষ
- মাহমুদুল হাসান
- ২০ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০
সন্ধ্যা ৭টার দিকে মিরপুর-৭ নম্বরে রূপনগর থানার পেছনে চলন্তিকা বস্তিতে আগুন লাগে। সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের সাতটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। আগুনের ব্যাপকতা দেখে পরে আরো ইউনিট বাড়ানো হয়। শেষ পর্যন্ত ২০টি ইউনিট কাজ করে রাত সাড়ে ১০টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। গত শুক্রবার সন্ধ্যার পর বস্তির মাঝামাঝি এলাকা থেকে আগুনের সূত্রপাত। এই বস্তিতে কয়েক হাজার পরিবারের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ বসবাস করতেন বলে এলাকাবাসীর ধারণা। ৫০০-৬০০ বস্তিঘর পুড়ে ৩০০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী।
চলন্তিকা মোড় থেকে রূপনগর আবাসিক এলাকা পর্যন্ত ঝিলের ওপর কাঠের পাটাতন দিয়ে ছোট ছোট ঘর বানিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল বস্তিটি। গতকাল সোমবার বস্তির সামনে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বিলাপ করছিলেন বস্তিবাসীরা। ঝিলপাড় বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে তাদের ঘর পুড়ে অঙ্গার হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের পর এক কাপড়ে ফুটপাতেই রাত কাটাচ্ছে শিশুরা। তবে অনেকের অভিযোগ, এটি দুর্ঘটনা নয়। আগুন দিয়ে বস্তি পুড়িয়ে দিয়েছে কেউ। এটা করা হয়েছে দখল আরো পাকাপোক্ত করার জন্য। অনেক অনৈতিক বাণিজ্য ছিল এই বস্তি ঘিরে।
আগুনে মুহূর্তের মধ্যে নিঃস্ব হয়েছে ঝিলপাড় বস্তির লক্ষাধিক মানুষ। টেলিভিশন, মোবাইল, টাকা-পয়সা, আসবাবসহ অনেকের শেষ স্মৃতিটুকুও কেড়ে নিয়েছে আগুনের লেলিহান শিখা। সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে অনেকেই এখনো কাঁদছেন। অনেকে আবার আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘরের ধ্বংসাবশেষ হাতড়ে পুরনো স্মৃতি খোঁজার চেষ্টা করছেন। হতভাগ্য বেশির ভাগ বস্তিবাসীর অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবে উচ্ছেদ করতেই বস্তিতে আগুন দেয়া হয়েছে। ঈদের সময় বস্তির প্রায় ১০ হাজার ঘরের অধিকাংশ ছিল তালাবদ্ধ। ঈদে অনেকেই গ্রামের বাড়ি গিয়েছেন। বস্তির অধিকাংশ বাসিন্দা রিকশাচালক, গৃহকর্মী, পোশাক কারখানার শ্রমিক ও দিনমজুর। হতাহতের ঘটনা এড়াতে আগুন দেয়ার জন্য এই সময়টাকেই বেছে নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ বস্তির বাসিন্দাদের। অনেকে বলছেন, বস্তির বড় দখলদারদের দখল আরো বিস্তৃত করার জন্যই আগুন দেয়া হয়েছে।
শুক্রবার সন্ধ্যায় লাগা ভয়াবহ আগুন ফায়ার সার্ভিসের ২৪টি ইউনিটের চেষ্টায় রাত সাড়ে ১০টার দিকে নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে পুরোপুরি নির্বাপণ করা সম্ভব হয় রাত দেড়টার দিকে। অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১০ জন আহত হন। ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার কামরুল হাসান জানিয়েছেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করবে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট কিংবা বিদ্যুতের সংযোগ থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।
গতকাল সরেজমিন দেখা মিলে আলিশান একটি বাড়ির সামনে অগ্নিকাণ্ডে সর্বস্ব হারানো মানুষ আর্তনাদ করছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সেটির মালিক ফকির কবির আহমেদ। তার দখলে আরামবাগ ও ঝিলপাড় বস্তির দুই শতাধিক ঘর। কবিরের আলিশান বাড়ির আলো বস্তিতে না পৌঁছালেও বস্তিবাসীর টাকায়ই আলোকিত হয়েছে তার প্রাসাদ। প্রভাব খাটিয়ে ঘরপ্রতি তিন হাজার টাকা হিসেবে মাসে অন্তত ছয় লাখ টাকা ভাড়া আদায় করেন কবির। শুধু কবির নন, রূপনগরের ঝিলপাড় বস্তি ছিল অনেকের কাছে ব্যবসার মাধ্যম। সরকারি জায়গা দখল করে গড়ে তোলা ওই বস্তি ঘিরে অবৈধ গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, ডিশ লাইন বাবদ লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিত একটি সঙ্ঘবদ্ধ চক্র। শুধু অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দিয়ে ঝিলপাড় বস্তি থেকে মাসে তোলা হতো ৫০ লাখ টাকা। চার দশকের বেশি বয়সের ঝিলপাড় বস্তি ওদের কাছে ‘সোনার ডিম’ পাড়া হাঁস। ক্ষমতার পালাবদলেও বস্তি ঘিরে এই চক্রের কোনো সমস্যা হয় না।
বস্তিবাসী ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ঝিলপাড় বস্তিতে ঘর তুলে যারা ভাড়া দেন ও অন্যভাবে অর্থ হাতিয়ে নেন তাদের মধ্যে রয়েছেন কেবল ব্যবসায়ী ‘ডিশ বাবু’। বস্তিতে তার প্রায় ২০০ ঘর রয়েছে। ঘর ছিল খলিলুর রহমান ওরফে বাইট্টা খলিলের, ফকির কবির আহমেদ, ফারুক, সালাম মিয়া, গাল কাটা বাবু, লন্ড্রি বাবু, যুবলীগ নেতা রহিম, জাহাঙ্গীর হোসেন ও হেলাল মিয়ার। প্রায় পুরো বস্তিতে প্লাস্টিকের পাইপের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস লাইন দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেন যুবলীগ নেতা দুলাল। ঘরপ্রতি মাসে ৫০০ টাকা গ্যাস বিল তুলতেন তিনি। এ হিসাবে বস্তি থেকে তার অবৈধ আয় ছিল মাসে ৫০ লাখ টাকার বেশি।
রূপনগরের স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানান, বস্তি যাদের কোটি কোটি টাকা তৈরির রাস্তা করে দিয়েছে, এলাকার সবাই তাদের চেনে। তবে ভয়ে কেউ মুখ খোলে না। এই অবৈধ আয়ের অর্থ পৌঁছে যায় অনেকের পকেটে। ঝিলপাড় বস্তি থেকে তোলা অর্থ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসাধু সদস্যরা পেয়ে থাকে।
‘উত্তরাধিকারসূত্রে’ ঝিলপাড় বস্তিতে ১০টি ঘর পেয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যুবক। তিনি জানান, প্রতি মাসে ঘরের ভাড়া তিনি পেলেও গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির টাকা অন্যদের দিতে হয়। ঝিলপাড় বস্তিতে ৩৫টি ঘরের মালিক স্থানীয় হেলাল মিয়া। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে বস্তিতে ঘর তুলে গরিব মানুষকে থাকার ব্যবস্থা করছি। এখানে ঘর পাকা হলেও পানি ছাড়া বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইন অবৈধ। সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে অনেকে এই বাণিজ্য করে আসছে। অনেক আগে থেকে শুনেছি এ জায়গায় পার্ক করা হবে। জানি না আগুনের পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে কি না। তবে বস্তিবাসীকে বিপদে ফেলে অন্য কিছু ভাবা উচিত হবে না। হেলাল মিয়া ছাড়াও এই এলাকার কাউন্সিলরের একাধিক আত্মীয়ের দখলে বস্তিতে অনেক ঘর রয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।
ভোলার ফারুক হোসেন স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ঝিলপাড় বস্তিতে বসবাস করছিলেন। আগুনে পুড়ে সব অঙ্গার হয়েছে তার। ফারুক বলেন, দেশে নদীতে ভিটা হারিয়েছি আর ঢাকায় ঘর পুড়ল। এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াব। একই এলাকার রাজিয়া বেগম স্বামী, দুই সন্তান নিয়ে বস্তিতে বসবাস করতেন। সব কিছু হারিয়ে তার চোখ ছলছল করছিল। রাজিয়া জানান, ফ্রিজ, টিভি, হাঁড়ি-পাতিল কিছু বের করতে পারেননি। স্কুলে খেলাধুলাসহ ভালো ফলের জন্য অনেক সনদ পেয়েছে তার মেয়ে। পুড়ে গেছে সবই। স্থানীয়রা জানান, বস্তি যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের অনেকে একসময় বস্তিতেই ছিলেন। অনেক টাকার মালিক হওয়ার পর বস্তির ঘর ভাড়া দিয়ে তারা এখন বহুতল ভবনের মালিক হয়েছেন। অনেকে আবার ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকেন।
‘আগুন আগুন কইয়া মানুষ খালি দৌড়াইতাছিল। ঘরের ভেতর থিক্যা পোলা-মাইয়া কুলে লইয়া আমি এক দৌড়ে বাইরে আইছি। খালি জানটা বাঁচছে, কোনো জিনিসপত্র বাইর করবার পারি নাই। এহন গায়ে পরইন্না কাপড় ছাড়া কিছুই নাই আমগো। সব কিছু পুইড়া ছাই। যে আগুন লাগছিল, পুরা বস্তি পুইড়া গেছে। তাও আমার ঘরের কোনো জিনিস ভালা আছে নাকি দেখতাছি। আমার মেয়ের জন্মের পর একটা খাট আর একটা টেবিলফ্যান কিনছিলাম। খাটের তোশকের তলে পাঁচ হাজার ট্যাকা রাখছিলাম। কোরবানির ঈদের দিন বাড়ি বাড়ি গিয়া কিছু মাংস পাইয়া পাশের ঘরের ভাড়াটিয়ার ফ্রিজে রাখছিলাম। আগুনে সব পুড়ছে।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বললেন মিরপুর-৬ নম্বরের ঝিল বস্তিতে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ঝুনু বেগম। ঝিল বস্তিতে একটি ঘরে ভাড়া নিয়ে বাস করতেন ঝুনু। তার স্বামী পেশায় রিকশাচালক। গত সাত বছর ধরে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে এই বস্তিতেই বাস করে আসছিলেন তিনি।
শুধু ঝুনু নয়, তার মতো আরো অনেকেই আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তারাও ধ্বংসস্তূপে পুড়ে যাওয়া আসবাবপত্র ও টিন উল্টে-পাল্টে দেখছিলেন। ঘরের ভেতরে থাকা জিনিসপত্রের কিছু অবশিষ্ট রয়েছে কি না, তা খুঁজে দেখছেন তারা। এই বস্তিতে ২০-২৫ হাজার ঘর ছিল। ৫০-৫৫ হাজার লোক বাস করত। আগুনে তাদের সব মালামাল পুড়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্তরা বর্তমানে রাস্তা ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত পাঁচটি স্কুলে রাত্রিযাপন করছেন।
গতকাল সকালে বস্তি এলাকায় গিয়ে দেখা যায় হাজার হাজার মানুষ রাস্তা, ফুটপাথ, গ্যারেজ ও আশপাশের স্কুলে অবস্থান নিয়েছেন। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও অনেকে খিচুড়ি রান্না করে বিতরণ করেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ও স্থানীয় এমপি ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা। মিরপুরের ঝিলপাড় বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের সব ধরনের সহযোগিতা দানের আশ্বাস দিয়েছেন মেয়র আতিকুল। তিনি বলেছেন, বস্তিবাসীর পুনর্বাসনের জন্য ২০১৭ সালে বাউনিয়া বাঁধে জায়গা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে ইতোমধ্যে পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়েছে। এখানকার ১০ হাজার পরিবারকে পর্যায়ক্রমে সেখানে স্থানান্তর করা হবে।
স্থানীয় এমপি ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা বলেন, যারা ৫০-১০০টি ঘর তৈরি করে ভাড়া তুলত তাদের সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া হবে। সেটা যে দলেরই হোক। নতুনভাবে এই জায়গায় বস্তির লোকজনকেই পুনর্বাসন করা হবে। বস্তি এলাকায় সুন্দর রাস্তাও তৈরি করে দেয়া হবে।
মিরপুর ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রজ্জব হোসেন বলেন, যারা অনেক দিন ধরে বস্তি নিয়ন্ত্রণ করত নতুনভাবে তাদের ঘর তৈরি করতে দেয়া হবে না। অবৈধভাবে মালিক বনে তারা বস্তির বাসিন্দাদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করত।