রাজধানীজুড়ে ভেজালের সমাহার
- মাহমুদুল হাসান
- ২৮ মে ২০১৯, ০০:০০
রাজধানী ঢাকার বর্তমানে ফুটপাথ থেকে শুরু করে নামী-দামি হোটেল রেস্টুরেন্টের কোনো পণ্যই ভেজালমুক্ত নয়। প্রয়োজনের তাগিদে জেনে বুঝেই আমরা এসব খাবার খাচ্ছি। উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ প্রতিটি স্তরেই এর ছড়াছড়ি। সহজপ্রাপ্যতা, আইনপ্রয়োগ ও যথাযথ নজরদারির অভাবে এসব ঘটেই চলেছে। খাদ্য মানেই এখন কার্বাইড, ফরমালিন, হাইড্রোজ, ইথোপেনসহ নানা ক্ষতিকর রঙ ও রাসায়নিক
বিষ। এর প্রমাণ মিলেছে রমজান মাসজুড়ে চলমান ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে। লিখেছেন মাহমুদুল হাসান
নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে রোজার শুরু থেকেই আলাদাভাবে ভেজালবিরোধী অভিযান শুরু করেছে র্যাব, পুলিশ, সিটি করপোরেশন, বিএসটিআই, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরসহ বেশ কয়েকটি সংস্থা। শুধু রমজান মাসে নয়, সারা বছর এমন অভিযান পরিচালনা করার পক্ষে মত দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষ বলছেন, নিরাপদ খাদ্য আইনের কঠোর প্রয়োগ নেই বলেই সবাই খাদ্যে ভেজাল দিচ্ছে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সারা বছর অভিযান চালানোর দাবি করেন তারা।
নামী-দামি রেস্তোরাঁয় পচাবাসি খাবার
পচাবাসি খাবার, নোংরা পরিবেশ, খাবারের ক্ষতিকারক রঙ মেশানোর অভিযোগে ফার্মগেট ও তেজগাঁও এলাকার কয়েকটি রেস্তোরাঁকে জরিমানা করা হয়েছে। গত ১২ মে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের একটি দল ভেজালবিরোধী অভিযানে যায় রাজধানীর অফিসার্স ক্লাবে। তাদের ক্যাফেটরিয়ায় পচাবাসি খাবার, পুরনো তেল ব্যবহার, খাবারে ক্ষতিকারক রঙ মেশানো ও নোংরা পরিবেশ খাবার তৈরির অভিযোগে দুই লাখ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
এ দিকে ফার্মগেটের কস্তুরি, নিউ স্টার, প্রিন্সসহ চারটি প্রতিষ্ঠানকে দুই লাখ ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ডিএমপির ভ্রাম্যমাণ আদালত।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে গত ১৩ মে গুলশান-২ নম্বরে ধানসিঁড়ি রেস্তোরাঁয় পুরনো-পচাবাসি এসব খাবারের দেখা মেলে। এসব হাঁস, মুরগি, মাছ বিক্রির জন্য বহুদিন আগ থেকে ফ্রিজে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছিল। ভেজাল, পচা ও বাসি খাবার রাখার কারণে ওই রেস্তোরাঁকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের ভ্রাম্যমাণ আদালত। গুলশান-২ নম্বর এলাকায় খাদ্যে ভেজালবিরোধী এ অভিযানের একপর্যায়ে ওয়েস্টিন হোটেলের উত্তর পাশের ধানসিঁড়ি রেস্টুরেন্টে যান ভ্রাম্যমাণ আদালত।
অভিযানে থাকা কর্মকর্তারা জানান, ফ্রিজ থেকে রান্না করা একটি হাঁস বের করে দেখা যায় তাতে ছত্রাকের আবরণ পড়েছে। এই হাঁস ১৫ শতাংশ ভ্যাট ছাড়াই দুই হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি করা হতো। এ ছাড়া ফ্রিজে বড় আকারের নষ্ট হয়ে যাওয়া দু’টি কোরাল মাছও পাওয়া যায়। রেস্তোরাঁটিতে চার হাজার ৮৫০ টাকা পর্যন্ত কোরাল মাছ বিক্রি করা হয়। পাবদা, বড় কাতল, রুই, দেশী মুরগিসহ ফ্রিজ থেকে যা বের করা হয়েছে, সবই ছিল পচা ও বাসি।
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ভেজাল ও পচাবাসি খাবার প্রস্তুত এবং মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য রাখায় গত ১৫ মে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের ভ্রাম্যমাণ আদালত। রাজধানীর ফকিরাপুল, আরামবাগ ও শান্তিনগর এলাকায় অভিযান চালিয়ে এসব জরিমানা করা হয়। ঢাকা মহানগর এলাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো: আবদুল্লাহ আল মামুনের নেতৃত্বে গোয়েন্দা পুলিশ ও পুলিশের ক্রাইম বিভাগের সমন্বয়ে এসব এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়।
ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, পচাবাসি খাবার রাখা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার প্রস্তুতের অভিযোগে ফকিরাপুলের এশিয়া গার্ডেন রেস্তোরাঁকে ৫০ হাজার টাকা, একই এলাকার নিউ আল ইমাম হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার তৈরির দায়ে ৩০ হাজার টাকা এবং দি গাউছিয়া হোটেলকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। একই অপরাধে আরামবাগের ঘরোয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁকে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় বলে জানান তিনি।
গত শনিবার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মিষ্টান্ন মজুদ ও উৎপাদনের অপরাধে মোহাম্মদপুরের বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। দোকানে মূল্য তালিকা না থাকায় ওই এলাকার চারটি স্বর্ণের দোকানকেও ১০ হাজার টাকা করে মোট ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। দোকানগুলো হলোÑ রিয়াল জুয়েলার্স, মা জুয়েলার্স, দুবাই জুয়েলার্স ও সিঙ্গাপুর জুয়েলার্স। একই দিন বিভিন্ন অপরাধে মিঠাইকে ১০ হাজার টাকা, কিডস কর্নারকে ১০ হাজার টাকা ও ইভা সুপার শপকে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।
আগোরা, মিনাবাজার ও স্বপ্নকে জরিমানা
মোড়কজাত পণ্যে উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ না থাকায় অভিজাত চেইন সুপার শপ আগোরা, মিনা বাজার ও স্বপ্নকে জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। গত ১০ মে রাজধানীর উত্তরা এলাকায় পৃথক দু’টি অভিযান চালিয়ে এ জরিমানা করা হয়। অভিযান পরিচালনা করেন অধিদফতরের ঢাকা বিভাগের কার্যালয় সহকারী পরিচালক আফরোজা রহমান ও প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মাসুম আরেফিন।
মিনা বাজারকে ৩০ হাজার টাকা, মোড়কজাত পণ্যের উৎপাদনের তারিখ না থাকায় আগোরা সুপার শপকে ২৫ হাজার টাকা, স্বপ্ন সুপার শপকে ২৫ হাজার টাকা, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রির করায় ননী মিষ্টি দইঘরকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও হাইড্রোজ দিয়ে জিলাপি তৈরিতে ও দীর্ঘ দিনের পচাবাসি খাবার বিক্রির অপরাধে হাভেলি রেস্টুরেন্টকে ৬০ হাজার টাকাসহ আটটি প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ ৯৬ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
আলমাস ও মুস্তাফা মার্টকে জরিমানা
নামী-দামি ব্র্যান্ডের কসমেটিকস অবৈধভাবে আনা ও বিক্রির অপরাধে বসুন্ধরা সিটির আলমাস সুপারশপ ও মুস্তাফা মার্টকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। গত ২০ মে দুপুরে ওই অভিযান পরিচালনা করেন অধিদফতরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার। তিনি বলেন, বিভিন্ন বিদেশী প্রসাধনী বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রসাধনীর গায়ে আমদানিকারকের নামও লেখা নেই। এটি আসলে ব্র্যান্ডের পণ্য নাকি কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা ও চকবাজারে তৈরি নকল কসমেটিকস, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ ছাড়া এসব পণ্যে ইচ্ছামতো মূল্য লিখে বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে এক দিকে ভোক্তাদের ঠকাচ্ছে, অন্য দিকে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে, যা আইনত দণ্ডনীয়। বসুন্ধরা সিটির কসমেটিকসের দোকানে অভিযান এবং বিদেশী বিভিন্ন অবৈধ কসমেটিকস, ব্যাগ ইত্যাদি বিক্রির অপরাধে আলমাসকে এক লাখ টাকা, মুস্তাফা মার্টকে এক লাখ টাকা, বিবিবি কসমেটিকসকে এক লাখ টাকা, সেভলি কসমেটিকসকে ৫০ হাজার টাকা, নিউ কসমেটিকসকে ৫০ হাজার টাকা ও আমরিন ফ্যাশনকে ১০ হাজার টাকা জরিমানাসহ দোকানটি সাময়িক বন্ধ রাখা হয়।
বাটা ও ইনফিনিটিকে জরিমানা
বিদেশী পণ্য আমদানির তথ্য উল্লেখ না করায় জনপ্রিয় জুতার ব্র্যান্ড বাটা ও দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড ইনফিনিটিকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ারের নেতৃত্বে ওই অভিযানে সহকারী পরিচালক তাহমিনা আক্তার ও মাহফুজ রহমানও অংশ নিয়েছিলেন।
তাহমিনা বলেন, মোহাম্মদপুরে বাটা ও ইনফিনিটির শোরুমে নিজস্ব পণ্য বিক্রির পাশাপাশি বিদেশী বিভিন্ন পণ্যও বিক্রি করছিল। তবে এসব পণ্য আমদানির পক্ষে তারা কোনো কাগজ দেখাতে পারেনি।