২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

চকবাজার থেকে বনানী কান্নার শেষ কোথায়?

-

চকবাজারের কান্নার দাগ হয়তো এখনো অনেকেরই শুকোয়নি। এরই মধ্যে যোগ হলো বনানীর নাম। গত বৃহস্পতিবার বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত নিহতের খবর পাওয়া গেছে ২৫ জনের। আহত হয়েছেন ৭৩ জন। বনানীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অসহায়ত্বের একটা বড় দৃশ্য চোখে পড়েছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। হয়তো তাদের কাছে প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট থাকলে এতগুলো প্রাণহানির ঘটনা ঘটতো না।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, যেকোনো ভবন সাততলার ওপর হলেই সেটিকে বহুতল ভবন হিসেবে গণ্য করা হয়। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে বনানীর ১৭ নম্বর রোডে ২২ তলা এফআর টাওয়ারের নবম তলায় এ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিট কাজ করে। এদের সাথে যোগ দেন সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর সদস্যরা।
এলাকার সাধারণ মানুষও উদ্ধার কাজে অংশ নেন। উদ্ধার কাজে অংশ নেয় পাঁচটি হেলিকপ্টার। বালু-পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা চালানো হয়। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ছয় ঘণ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। খুব অল্প সময়েই বনানী ফের চোখে জল আনল, কতজন হারাল স্বজন।

জরুরি নির্গমন পথ নেই
রাজধানীর বনানীতে এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগার ঘটনায় শতসহস্র প্রত্যক্ষদর্শীর সামনে দৃশ্যমান মূল সমস্যাটি ছিল ওই ভবন থেকে বেরিয়ে আসার জরুরি কোনো পথ ছিল না। ফায়ার এক্সিট বা আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার জরুরি নির্গমন পথ থাকলে হয়তো এত প্রাণহানি ঘটত না। কিংবা আগুন নেভানোর নিজস্ব ভালো ব্যবস্থা থাকলে ক্ষয়ক্ষতি এতটা হতো না।
ঢাকায় দিনের পর দিন বহুতল ভবন গড়ে উঠছে। এসব ভবনে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা রাখাসহ নিয়মকানুন মেনে চলার কথা বলা হয়েছে। বহুতল ভবন গড়তে হলে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালকের কাছ থেকে ফায়ার সিস্টেমের অনুমোদন নিতে হয়। সব কাজ সম্পন্ন হলে নিতে হয় সনদ। এর পরও প্রতি তিন মাস পরপর ফায়ার ড্রিল বা অগ্নিনির্বাপণ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সুউচ্চ ভবনে কমপক্ষে দু’টি সিঁড়িপথ থাকবে।

আগুন নিয়ন্ত্রণে যা থাকা প্রয়োজন
বহুতল ভবনে হাইড্রেন্ট ও স্প্রিংলার সিস্টেম থাকতে হয়। থাকতে হয় স্মোক ডিটেক্টর বা ধোঁয়া শনাক্তকারী যন্ত্র। এ যন্ত্র বসানো হলে কোনো তলায় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা এর ওপরে উঠে গেলেই একটি শব্দ করে ভবনের সবাইকে সতর্ক করে দেবে। থাকবে হিট ডিটেক্টর সিস্টেম। এই যন্ত্র বসানো হলে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে সবাইকে জানিয়ে দেবে। এ ছাড়া একজন অগ্নিনির্বাপক কর্মকর্তা থাকবেন, যিনি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে সব কিছু তদারক করবেন। সুউচ্চ ভবনে হেলিপ্যাড থাকা বাধ্যতামূলক। প্রতি সাড়ে ৫০০ বর্গফুট আয়তনের জন্য একটি করে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র থাকতে হবে।
¯িপ্রংলার পদ্ধতিতে কোনো তলায় ৬২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর তাপমাত্রা হলেই ওই পাইপ থেকে ঝরনার মতো পানি ছিটিয়ে পড়ে। ১০ ফুট পরপর ¯িপ্রংলার সিস্টেম বসাতে হয়। এই পদ্ধতিতে নিচে তিনটি পানির পাম্প থাকে, এই পাম্প স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যায়। ফায়ার পাম্প চলে বিদ্যুতে। বিদ্যুৎ না থাকলে স্ট্যান্ড বাই পাম্প জেনারেটর চালু হবে, না হলে জকি পাম্প থাকে। জকি পাম্প প্রতিটি ফ্লোরে সমান গতিতে পানি ছিটিয়ে দেয়। এরপর রয়েছে পিএ সিস্টেম। এই পদ্ধতিতে নিচে একটি কন্ট্রোল রুম বা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থাকবে। সেই কক্ষ থেকে কন্ট্রোলার ওই ভবনের নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা বিএবিএক্সের মাধ্যমে কোন তলায় আগুন লেগেছে তা জানিয়ে দেবেন।
অনেক সময় দেখা যায়, কোনো ভবনে আগুন লাগলে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে লোকজন দিশেহারা হয়ে যায়। ধোঁয়ার কারণে বের হতে পারে না। ফলে নিহতের সংখ্যা বেড়ে যায়। এ কারণে প্রতি তলায় ‘এক্সিট সাইন বা প্রস্থান চিহ্ন’ থাকা আবশ্যক। এটি থাকলে বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও অটোমেটিক বা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে এটি আলো জ্বেলে পথ নির্দেশ করবে, যাতে অগ্নিকাণ্ডের শিকার বা কবলে থাকা ব্যক্তি সহজে ওই নির্দেশ অনুসরণ করে বের হয়ে যেতে পারবে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী, এসব নিয়ম সুউচ্চ বা বহুতল ভবনগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক। এখন প্রশ্ন হলো, বহুতল ভবনে এসব নিয়মকানুন মেনে চলা হচ্ছে কি?
বিল্ডিং কোড অনুসরণে জোর প্রধানমন্ত্রীর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ‘বিল্ডিং কোড’ যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। অগ্নিকাণ্ডসহ ভবনের সার্বিক নিরাপত্তা ভবনমালিক ও ব্যবহারকারীকে নিশ্চিত করতে হবে। তা ছাড়া সরকারি সংস্থাগুলোর কঠোর নজরদারি বাড়ানোসহ জনসচেতনতা সৃষ্টির ওপরও বিশেষ গুরুত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী।
বনানী দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর, সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থীদের সাহসী ও কার্যকর ভূমিকার জন্য সভার পক্ষ থেকে শেখ হাসিনা সবাইকে ধন্যবাদ জানান।

এটা হত্যাকাণ্ড : গণপূর্তমন্ত্রী
রাজধানীর বনানীর এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ড নিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, এটা গাফিলতি না, হত্যাকাণ্ড। এ ঘটনার জন্য যেসব আইনগত ব্যবস্থা নেয়া দরকার তাই নেয়া হবে। গত শুক্রবার সকালে এফ আর টাওয়ারের দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের মন্ত্রী এ কথা বলেন।
শ ম রেজাউল করিম বলেন, এফ আর টাওয়ার কী করে ১৮ তলার অনুমোদন নিয়ে ২৩ তলা হয়ে গেল, সে সম্পর্কিত কাগজপত্র রাজউকের রেকর্ডবুকে পাওয়া যায়নি। এ কথা বলেছেন। ১৯৯৬ সালে রাজউক ১৮ তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন ছিল। ২০০৫ সালে একটি নথিতে দেখা যায়, ভবনটি ২৩ তলা। এ ভবনটি কিভাবে ২৩ তলা হলো তার সমর্থনে কোনো কাগজপত্র রাজউকের রেকর্ডবুকে নেই। মন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানান। ত্রুটির জন্য যে বা যারাই অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান, মালিক বা সংশ্লিষ্ট লোকজন সবাইকে শাস্তি দেয়া হবে।
শ ম রেজাউল করিম বলেন, ক্ষমতা, পদপদবিতে যে যত প্রভাবশালীই হন না কেন, শাস্তি এড়াতে পারবেন না। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে। এ ভবনটির আশপাশে যেসব বহুতল ভবন আছে সেগুলোর ব্যাপারেও খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে বলে জানান মন্ত্রী। অনুমোদিত অংশের বাইরের ভবন ভাঙার সুযোগ থাকলে ভেঙে ফেলা হবে। এ ভবনটির (এফ আর টাওয়ার) আশপাশে যেসব বহুতল ভবন আছে সেগুলোর ব্যাপারেও খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। অনুমোদিত অংশের বাইরে ভবন ভাঙার সুযোগ থাকলে ভেঙে ফেলা হবে। কোন কোন ভবন পরিকল্পনা বা নিয়মের বাইরে তৈরি হয়েছে, তা ১৫ দিনের মধ্যে চিহ্নিত করা হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী।

নিরাপত্তার দায় ভবন মালিকের : মেয়র
এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ড নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে অবশ্যই নিরাপত্তার দায়িত্ব ভবন মালিককে নিতে হবে। গত শুক্রবার বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ে এফ আর টাওয়ার পরিদর্শন শেষে মেয়র এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন ও রাজউকের কাজের মধ্যে সমন্বয় নেই। আর এ সমন্বয়হীনতার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এখন থেকে আমরা অ্যাকশনে নামব। সিটি করপোরেশন বহুতল ভবনের আনুষঙ্গিক কাগজপত্র রাজউকের কাছে চেয়ে পাঠিয়েছে। ১০ দিনের মধ্যে সব ভবনকে কাগজপত্র দিতে হবে। এসব হাতে পেলে ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান শুরু করবে। অবশ্যই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অফিসগুলোকে জানতে হবে তারা যেখানে অফিস নিচ্ছে সেখানে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা আছে কি না। এখন থেকে নিজের নিরাপত্তা নিজেরা বিবেচনা করে দেখবেন। অফিসে ঢোকার আগে দেখে নিন, আগুন লাগলে বের হওয়ার বিকল্প পথ আছে কি না।


আরো সংবাদ



premium cement