২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল ২০২০ সালের মধ্যে শেষ হবে কি?

-

যানজট আর পরিবহন সঙ্কট থেকে মুক্তি দিতে ঢাকা শহরে তৈরি হচ্ছে মেট্রোরেল। সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক এই প্রকল্পে উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে মেট্রোরেলের লাইনের (এমআরটি-৬) কাজ সংশ্লিষ্ট সড়কে এখন দৃশ্যমান। অনেক স্থানেই এই রেললাইন স্থাপনের জন্য পিলার বসে গেছে। কোথাও কোথাও কাজ আরো বেশি এগিয়েছে।
২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেলের কাজ শেষ করতে চায় সরকার। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দেশের প্রথম মেট্রোরেল চালুর ক্ষেত্রে আগামী ২০ মাসে শেষ করতে হবে ৭৮ শতাংশ কাজ। অথচ প্রকল্প শুরুর প্রথম ১৯ মাসে কাজ শেষ হয়েছে মাত্র সাড়ে ২১ শতাংশ।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করার আশাবাদ জানালেও নির্মাণকাজ পরিদর্শন করে প্রকল্পটি ধীরগতিতে চলছে বলে মত দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। এমনকি মহাসড়ক বিভাগের পিছিয়ে থাকা ১০ প্রকল্পের মধ্যেও রয়েছে মেট্রোরেল। নির্মাণকাজে পিছিয়ে থাকায় ‘অব্যয়িত’ থেকে যাচ্ছে চলতি অর্থবছরের বরাদ্দের ‘একটা বড় অংশ’।
মাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন ৬-এর নির্মাণকাল নির্ধারিত ছিল ২০১২ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত। পরে প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় বিশেষ উদ্যোগে উত্তরা-আগারগাঁও অংশটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ও আগারগাঁও-মতিঝিল অংশটি ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের সংশোধিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সব মিলিয়ে চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল প্রকল্পের অগ্রগতি ২১ দশমিক ৫ শতাংশ। পুরো কাজ শেষ করতে মহাসড়ক বিভাগের হাতে সময় আছে মাত্র ২০ মাস।
দুই ধাপে চলছে উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেলের কাজ। সংশোধিত পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রথম ধাপের কাজ শেষ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে। প্রকল্প কার্যালয়ের তথ্য বলছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত উত্তরা-আগারগাঁও অংশের ৩৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ৬৫ শতাংশ শেষ করতে মাত্র আট মাস সময় হাতে আছে।
উত্তরা-আগারগাঁও অংশটির দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। ৩৯৩টি পিলার (খুঁটি) বসবে এই অংশে। এখনো ১৮৪টি পিলারের কাজ বাকি আছে। পিলারগুলোকে শক্ত ভিত দিতে পাইল নির্মাণ হচ্ছে ৭৬৬টি, যদিও বাকি আছে ২৭৩টি পাইলের কাজ। একইভাবে ১০৮টি টিআই গার্ডারের মধ্যে বাকি আছে ৩৩টি। চার হাজার ৫৭৭টি প্রিকাস্ট সেগমেন্ট কাস্টিংয়ের মধ্যে নির্মাণ শেষ হয়েছে মাত্র এক হাজার ৮৬৯টির। উড়ালপথের মধ্যে মাত্র আড়াই কিলোমিটারে স্থাপন হয়েছে ভায়াডাক্ট। দিয়াবাড়ী থেকে শুরু হয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ভবন পর্যন্ত মোট ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। হাতে মাত্র আট মাস সময় থাকলেও চেক বোরিং, টেস্ট পাইল, মূল পাইল বাদে স্টেশনের আর কোনো কাজ শুরুই হয়নি।
মেট্রোরেল চলবে বিদ্যুতে। ঝুলন্ত তার (সিম্পল ক্যাটনারি ওভারহেড ওয়্যার) থেকে বিদ্যুৎ পৌঁছবে ট্রেনের ইঞ্জিনে (ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট মোটর)। প্রকল্প কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বৈদ্যুতিক ও প্রকৌশল ব্যবস্থা সরবরাহ ও নির্মাণের জন্য চূড়ান্ত নকশা সম্পন্ন হয়েছে। উচ্চ ক্ষমতার বৈদ্যুতিক ক্যাবল স্থাপনের জন্য সবে শুরু হয়েছে খোঁড়াখুঁড়ি। মেট্রোরেলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে টঙ্গী ও মানিকনগর গ্রিড সাবস্টেশন। সাবস্টেশন দুটির অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ বর্তমানে এগিয়ে চলছে।
মোট ২৪ সেট ট্রেন চলবে উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোতে। ট্রেনগুলো নির্মাণ করছে জাপানি রোলিংস্টক নির্মাতা কাওয়াসাকি-মিতসুবিশি। প্রতিষ্ঠানটির সাথে মহাসড়ক বিভাগের চুক্তি অনুযায়ী, পাঁচ সেট ট্রেন ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ও বাকি ১৯ সেট ২০২১ সালের মধ্যে সরবরাহ করা হবে। মহাসড়ক বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ট্রেনগুলোর চূড়ান্ত নকশার কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। বগি নির্মাণের কাজ গত ১৬ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে।
মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনায় গঠিত ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক প্রকল্পের অগ্রগতি প্রসঙ্গে বলেন, মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ ঠিকমতোই এগিয়ে চলছে। দেশী-বিদেশী প্রকৌশলী ও শ্রমিকরা ২৪ ঘণ্টাই কাজ করছেন। আগামী ২০ মাসের মধ্যে ৭৮ শতাংশ কাজ শেষ করা কিভাবে সম্ভব, জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সাবেক এ সচিব বলেন, ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে মেট্রোরেলের কাজ শেষ হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঠিকাদারদের সেভাবেই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে তদারকি।
এদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির অর্ধবার্ষিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন দাখিল করেছে মহাসড়ক বিভাগ। প্রতিবেদনে ‘অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়’, এমন ১০টি প্রকল্প তালিকাভুুক্ত করা হয়েছে। এ তালিকার পাঁচ নম্বরে রয়েছে বাস্তবায়নাধীন উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল।
উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেলের দ্বিতীয় ধাপে নির্মাণ করা হচ্ছে আগারগাঁও-মতিঝিল অংশ, যার দৈর্ঘ্য ৮ দশমিক ১১ কিলোমিটার। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি এ অংশের নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন শেষে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে মেট্রোরেলের পুরো কাজ শেষ হবে। আর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ২০১৯ সালের ডিসেম্বরেই শেষ হবে।
আগারগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত পরিষেবা স্থানান্তর ও চেক বোরিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। ১৯৭টি ট্রায়াল পিটের মধ্যে ৩৫টি ট্রায়াল পিট এবং ৪৫০টি বোরড পাইলের মধ্যে তিনটি সম্পন্ন হয়েছে। কারওয়ান বাজার-মতিঝিল অংশে ১৫১টি ট্রায়াল পিটের মধ্যে ৩৭টি, ৬৫২টি বোরড পাইলের মধ্যে ছয়টি বোরড পাইল সম্পন্ন হয়েছে।
১৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এমআরটি লাইন-৬ বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন অ্যাজেন্সি (জাইকা) ও পাঁচ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।
উত্তরা-আগারগাঁও অংশ নির্মাণ করছে ইতাল-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি। অন্য দিকে, আগারগাঁও থেকে কারওয়ানবাজার অংশ জাপানের টেক্কেন করপোরেশনের সাথে যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশের আবদুুল মোনেম লিমিটেড। আর কারওয়ান বাজার-মতিঝিল অংশ যৌথভাবে নির্মাণ করছে জাপানি সুুমিতোমো মিতসুই কনস্ট্রাকশন ও ইতাল-থাই।
মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ শুরুর পর থেকে প্রকল্প এলাকায় সড়কের প্রস্থ কমে গেছে। সড়কে পাশাপাশি দুটি গাড়ি, বাস চলতে পারছে না। বর্তমানে জানজট এখন বেশি হচ্ছে ফার্মগেট থেকে শাহবাগ পর্যন্ত। প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ না হলে নিত্যদিনের এই ভোগান্তি আরো দীর্ঘ হবে বলে রাজধানীবাসীর আশঙ্কা।
মিরপুরের বাসিন্দা আসিফুর রহমান বলেন, রাস্তার বড় অংশ আটকে মেট্রোরেলের কাজ চলায় প্রতিদিন যানজটে পড়তে হয়। মেট্রোরেলের কাজ শেষ হলে যানজটের দুর্ভোগ কমবে এই আশায় সবাই হাসিমুখে বর্তমান ভোগান্তি মেনে নিচ্ছে। কিন্তু আগেও দেখা গেছে, একটি প্রকল্প শুরু হলে শেষ হতে চায় না। এটার ক্ষেত্রেও যেন এমন না হয়!
রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসনে ২০১২ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় সরকার। ২০২৪ সালের মধ্যে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১৬টি স্টেশনের নির্মাণকাজ শেষ করার কথা থাকলেও ২০১৯ সালের মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অন্তত ৯টি স্টেশনের কাজ শেষ করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। আর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল শাপলা চত্বর পর্যন্ত বাকি সাতটি স্টেশনের কাজ শেষ হবে ২০২০ সালের মধ্যে।
বর্তমানে উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে সময় লাগে তিন থেকে চার ঘণ্টা। মেট্রোরেল সেটি কমিয়ে আনবে ৩৭ মিনিটে। প্রতিটি স্টেশনে প্রতি ৩.৩৭ মিনিটে উভয় দিকে ট্রেন থামবে এবং সম্পূর্ণ এলিভেটেড ও বিদ্যুৎচালিত ট্রেন প্রতি ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করবে। প্রতি চার মিনিট পরপর এক হাজার ৮০০ যাত্রী নিয়ে চলবে মেট্রোরেল।
বুয়েটের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, মেট্রোরেলের মতো প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি দেখতে সময় লাগে। শেষের দিকে কাজের গতি অনেক বেড়ে যায়। তবে মেট্রোরেলের কাজ শেষ করার জন্য যে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি খুবই আটঘাট। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement