বেতনের বেশির ভাগই যায় বাড়ি ভাড়ায়!
- মাহমুদুল হাসান
- ২২ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০
আমাদের কর্মসংস্থানের বেশির ভাগ রাজধানী কেন্দ্রিক হওয়ায় সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত কাজের সন্ধানে রাজধানীমুখী হচ্ছেন। প্রতিদিনই কর্মসংস্থান বা ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ঢাকায় আসছেন মানুষ। আর এসব মানুষের প্রায় ৮০ শতাংশই ঢাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। ফলে বাসার চাহিদা থাকায় নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই বাড়িওয়ালারা বাড়ি ভাড়ার বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছেন ভাড়াটিয়াদের কাঁধে। কোথাও যেন জবাবদিহিতা নেই।
এক জরিপে জানা যায়, ২৭ ভাগ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ ভাগ ভাড়াটিয়া প্রায় অর্ধেক, ১২ ভাগ আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা ব্যয় করেন বাড়ি ভাড়া খাতে। আর চার ভাগ ভাড়াটিয়া এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, দুই বছর আগে ভাড়া বাড়ানো যায় না। যাবে না জামানত নেয়াও। এর জন্য ভাড়াটিয়া ও মালিকপক্ষকে চুক্তিবদ্ধ হতে হয়। ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ৭ ধারা মতে, কোনো বাড়ির ভাড়া মানসম্মত ভাড়ার অধিক ভাড়া কোনোভাবেই আদায়যোগ্য হবে না। কিন্তু রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বিড়ম্বনা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো কারণ ছাড়াই ভাড়া বাড়ানো, বাড়িওয়ালাদের দাপট বা স্বেচ্ছাচারিতা সব মিলে অসহায় এ শহরের ভাড়া বাসার বাসিন্দারা।
রাজধানী ঢাকার বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে ২৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন ওবায়েদ আলম। সব মিলিয়ে তার বেতনের অর্ধেকের বেশি অংশ মাসের শুরুতে বাড়ি ভাড়া বাবদ বাসার মালিকের হাতে তুলে দিতে হয়। থাকেন মগবাজারের একটি বাসায়। প্রতি মাসে তাকে ভাড়া বাবদ দিতে হয় প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার টাকা। এর সাথে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎসহ আনুষঙ্গিক বিল রয়েছে।
এ সমস্যা শুধু ওবায়েদ আলমের একার নয়, রাজধানীতে বসবাসকারী বেশির ভাগ ভাড়াটিয়ার মাসের শুরুতে বেতনের বা আয়ের বেশির ভাগ টাকা বাসা মালিকদের হাতে তুলে দিচ্ছেন।
পুরনো বছর শেষে শুরু হয়েছে নতুন বছর। আর বছর শেষ হওয়া সাথে সাথে বাড়িওয়ালারাও বাড়িয়ে দিয়েছেন বাসা ভাড়া। লাগামহীন বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধিতে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন রাজধানী ঢাকার সাধারণ মানুষ। নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চ-মধ্যবিত্ত সবাই বাড়ি ভাড়ার এ পাগলা ঘোড়ার কাছে অসহায়। বর্ধিত বাড়ি ভাড়ার বোঝা নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন রাজধানীর এসব অসহায় ভাড়াটিয়া।
রাজধানীজুড়ে ঘুপচি ঘরে মানবেতর জীবনযাপন করেন পোশাক শ্রমিকেরা। গতকাল শেওড়াপাড়ার পাইকপাড়া এলাকায় টিনশেডের বস্তিতে কথা হয় পোশাক শ্রমিক রানার সাথে। তিনি জানান, ঘর ভাড়া দেন সাড়ে তিন হাজার টাকা। সাথে থাকেন আরো দু’জন শ্রমিক। তিনজনে মিলেমিশে ভাড়া দেন। নতুন বছরে তাদের ঘর ভাড়া ৫০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন মালিক। রানা বলেন, মালিক বলেছেন, ‘আমার নাকি বেতন বাড়ছে, তাই ঘরভাড়া বাড়াইছে। কিন্তু ক্যামনে বুঝাই বাড়তি বেতনের টাকা আমি পামু। ঘর ভাড়া, বাজার-সদাই করে মাস চলাই মুশকিল। এর কয়দিন আগেই গ্যাসের জন্য বাড়াইল, আগামী মাসে আবারো গ্যাসের জন্য বাড়াইব কইছে।’
টিন দিয়ে কোনোভাবে দাঁড় করানো এসব ঘরেই থাকেন পোশাক শ্রমিকরা। শ্রমিকদের অভিযোগÑ নতুন বেতন-কাঠামো হয়েছে শুনেই ঘরের সাইজের ওপর ভিত্তি করে ঘর মালিকেরা ২০০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া বাড়িয়েছেন। রাজধানী ও আশপাশের শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত বছরের শেষ থেকেই ঘরমালিক ভাড়া বাড়িয়ে দিতে শুরু করেছেন। নতুন মজুরি-কাঠামো হচ্ছে এমন সংবাদ টেলিভিশনে দেখেই তারা ভাড়া বাড়িয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন শ্রমিকেরা। হয়তো বেতনের ৫০০ টাকা বাড়েনি, কিন্তু ঠিকই তার চেয়ে বেশি ঘর ভাড়া গুনতে হবে।
যে শ্রমিকদের শ্রমে ও ঘামে তৈরী পোশাক শিল্প টিকে আছে, তাদের আবাসন সমস্যা সমাধানে শিল্পমালিকদের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। শ্রমিকদের জন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর নেই কোনো ডরমিটরি বা অন্য কোনো আবাসন ব্যবস্থা।
বনশ্রীতে দুই রুমের একটি বাসায় পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন বেসরকারি চাকরিজীবী রবিউল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘মাসের বেতন যা পাই তার অর্ধেকের বেশি মাসের শুরুতেই শেষ হয়ে যায়।’ প্রতি বছরই ভাড়া বেড়ে চলছে। রাজধানীতে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাসায় বসবাস করেন, কিন্তু অল্পসংখ্যক বাসা মালিকের কাছে তারা জিম্মি। দুই সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে ঢাকায় থাকেন রবিউল। অফিস থেকে বেতন বাবদ প্রতি মাসে ৩৫ হাজার টাকা পাই। এর মধ্যে বাসা ভাড়া ১৬ হাজার আর গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ বিল মিলে ১৯ হাজার টাকা পড়ে। বাকি টাকা দিয়ে সংসার চালাতে হয়। যার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া, সন্তানের পড়ালেখার খরচ, চিকিৎসা সবই করতে হয়। সরকারের উচিত আমাদের মতো মানুষের কথা বিবেচনা করে বাসা ভাড়া আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা। সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। জাঁতাকলে চ্যাপ্টা হওয়া এসব ভাড়াটিয়ার সমস্যা সমাধানে সিটি করপোরেশন মনিটরিংয়ের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পারে। দীর্ঘ দিন ধরে চলা আসা এ সমস্যার সমাধান এখনই না করা গেলে আগামীতে আরো অসহায় হয়ে পড়বে এসব ভাড়াটিয়া।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ক সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ।
এ বিষয়ে ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার বলেন, রাজধানীতে লাগামহীন বাসা ভাড়া বৃদ্ধি রোধে প্রয়োজন আইনের সঠিক প্রয়োগ। প্রতি বছরই ভাড়া বৃদ্ধি করে চলেছে বাসার মালিকেরা। তাদের আচরণের কাছে অসহায় হয়ে আছেন ভাড়াটিয়ারা। এমন সমস্যা সমাধানে আইন ও বিধি যথোপযোগী করে তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।