২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
ফিরে দেখা ২০১৮

উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় কতটুকু এগিয়ে ঢাকা

রাজধানীজুড়ে সারা বছর রাস্তার খননকাজ করায় অসহনীয় ধুলাবালুর ভোগান্তি পোহাতে হয় নাগরিকদের -

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন নিয়মিত মেট্রোপলিটন পলিসি, সুশাসন ও উন্নয়ন নিয়ে গবেষণা করছে। ২০১০ সাল থেকে তারা বিশ্বের বড় মেট্রোপলিটন শহরগুলোর ইকোনমিক কর্মসংস্থান ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি যাচাই করছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি। চলতি বছর তারা বিশ্বের ৩০০টি বড় শহরের ইকোনমিক পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করেছে। সম্মিলিতভাবে বৈশ্বিক কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধির ৩৬ ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির ৬৭ শতাংশ হচ্ছে এসব শহরে। ২০১৪-১৬ পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি চলতি বছরের তালিকায় উদীয়মান শহর হিসেবে ঢাকা রয়েছে ২৫তম স্থানে। এ অবস্থান বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ঢাকার অর্থনৈতিক উজ্জ্বলতাকে জানান দিচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেরও কেন্দ্র এখন ঢাকা। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) এক-তৃতীয়াংশের বেশি আসছে এখান থেকেই। মোট কর্মসংস্থানেরও ৩১ শতাংশ হচ্ছে ঢাকায়। যদিও এ উজ্জ্বলতা কমাতে পারেনি ঢাকার মলিনতা। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় এ মলিনতার ছাপ স্পষ্ট। দেশের প্রধান প্রবেশদ্বার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অবকাঠামোর কাক্সিক্ষত উন্নয়ন হয়নি। উত্তরা থেকে বিমানবন্দর ক্রসিং হয়ে খিলক্ষেত পর্যন্ত যানজট এখন নিত্যসঙ্গী। যানজটের কারণে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহারকারীদের পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে।
যানজটের ভোগান্তি কমাতে ঢাকায় এরই মধ্যে চালু হয়েছে ৯টি ফ্লাইওভার। এর মধ্যে আটটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। যানজট কমাতে এসব ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হলেও যানবাহনের গতি না বেড়ে উল্টো কমেছে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা বলছে, যানজটের কারণে গত এক দশকে যানবাহনের গড় গতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে কমে সাত কিলোমিটারে নেমে এসেছে; যেখানে হেঁটে চলার গড় গতি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার। শুধু যানজটের কারণেই দৈনিক ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে রাজধানীবাসীর।
খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, একটি পরিকল্পিত নগরীর আয়তনের ২৫ শতাংশ রাস্তা থাকতে হয়। ঢাকায় আছে মাত্র ৭ শতাংশ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যমতে, অপর্যাপ্ত এ রাস্তায় রাজধানীতে প্রাইভেট কারের সংখ্যা দেড় লক্ষাধিক। এ ছাড়া মিনিবাস চলে দেড় হাজার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা আট হাজার ও টেম্পো দেড় হাজার। এর বাইরে আছে কয়েক লাখ বৈধ-অবৈধ রিকশা। মলিনতা দৃশ্যমান চার পাশের নদ-নদী ও পরিবেশের ক্ষেত্রেও। নদী ও পরিবেশ দূষণের সাথে সঙ্কট রয়েছে আবাসন ও নিরাপদ পানির।
রাজধানী থেকে এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে অন্তত ৩৬টি খাল। যে ১৬টি খাল টিকে আছে, দখল ও দূষণে সেগুলোর অস্তিত্বও হুমকির মুখে। খালের জমি ভরাট করে ধীরে ধীরে হাউজিং কমপ্লেক্স, বাড়িঘর, কল-কারখানা নির্মাণ হচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে বর্ষা মওসুমে। টানা এক ঘণ্টার বৃষ্টিপাতে জলাবদ্ধতায় ডুবে যায় প্রায় বেশির ভাগ সড়ক।
পৃথিবীর সব দেশেই মেয়র ঠিক করেন, শহরটা কিভাবে চলবে। কিন্তু বাংলাদেশে হচ্ছে এর উল্টো। ফ্লাইওভার হবে কি হবে না, হলে কোথায় হবে, এসবের কোনোটিই মেয়রের হাতে নেই। বেশির ভাগ প্রকল্পই হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। ফলে আর্থিক ব্যয় বাড়ছে, অবকাঠামোয় জায়গা দখল হচ্ছে, কিন্তু কাক্সিক্ষত সেবা মিলছে না। বরং ক্রমেই জঞ্জালে রূপ নিচ্ছে মহানগর।
রাজধানীতে বাস করে দুই কোটির বেশি মানুষ। প্রতি বছর ৩-৪ শতাংশ হারে বাড়ছে নগরীর জনসংখ্যা। আনুপাতিক হারে বাড়ছে আবাসনের চাহিদাও। কিন্তু আবাসন খাতের অবকাঠামো এক দশক আগে যা ছিল, এখনো তাই। আবাসনের জন্য প্রকল্প নেয়া হলেও সময়মতো বাস্তবায়ন হচ্ছে না সেগুলো।
রাজধানীতে সারা বছর পানির সঙ্কট নতুন কোনো বিষয় না হলেও শীত এলেই এটি আরো প্রকট আকার ধারণ করে। অনেক এলাকায় সঙ্কট না থাকলেও ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে পাওয়া যায় ময়লা। দুর্গন্ধের কারণে ফোটানোর পরও অনেক ক্ষেত্রে খাওয়ার অযোগ্য বলে অভিযোগ রয়েছে।
ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিদিন ২৪৫ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করতে সক্ষম তারা। বর্তমানে ২৪০ কোটি লিটার পানির চাহিদা রয়েছে। চাহিদানুযায়ী উৎপাদনও হচ্ছে। সে অনুযায়ী রাজধানীতে পানি সঙ্কট থাকার কথা নয়। ওয়াসা নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গণশুনানিতেও পানি সঙ্কটের কারণে গ্রাহকেরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
একই অবস্থা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের হিসাব মতে, প্রতিদিন পাঁচ হাজার টনেরও বেশি বর্জ্য উৎপাদন হয়। এর মধ্যে গৃহস্থালির বর্জ্য ছাড়াও রয়েছে কারখানা, বাজার ও চিকিৎসা বর্জ্য। এগুলো অপসারণের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। কিন্তু জনবল সঙ্কট ও ডাস্টবিন স্থাপনের জায়গা দখল হয়ে যাওয়াসহ নানা অব্যবস্থাপনার কারণে রাজধানীর প্রায় সব সড়কেই যেখানে-সেখানে পড়ে থাকছে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। নগরীতে প্রয়োজন ২৬০ বর্গকিলোমিটার ড্রেনেজ লাইন, কিন্তু রয়েছে মাত্র ১৫০ বর্গকিলোমিটার। যেগুলো রয়েছে, পর্যাপ্ত সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বেশির ভাগ সময়ই ড্রেনেজ লাইনের বিরাট অংশই ময়লায় ভরাট থাকে।
রাজধানীকে কেন্দ্র করে দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন চলছে। তবে পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নকে। কারণ শহরকে চালু রাখার ক্ষেত্রে গণপরিবহনের ভূমিকা রয়েছে। এরই মধ্যে এমআরটি, বিআরটির কাজ শুরু হয়েছে। তবে এগুলোর অগ্রগতি ধীর।
ঢাকাকে আরো নাগরিকবান্ধব শহর হিসেবে গড়ে তুলতে হলে এর ওপর থেকে চাপ কমাতে হবে। জনসংখ্যার চাপ, অর্থনৈতিক চাপ এগুলোর বিকেন্দ্রীকরণ করা প্রয়োজন। এ জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। আর এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সমন্বয় থাকতে হবে, যার জন্য নেতৃত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে বাস্তবায়ন করা এসব প্রকল্পে সমন্বয়হীনতা অনাকাক্সিক্ষত। পাশাপাশি সুশাসনও নিশ্চিত করতে হবে। এতে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আর্থিক ও কারিগরি জটিলতা বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।


আরো সংবাদ



premium cement